দ্বিতীয় পর্যায়ের শান্তি বৈঠকে রাশিয়া-ইউক্রেন, দু’দেশই কথা দিয়েছিল, যুদ্ধের মাঝে আটকে থাকা নিরীহ মানুষজনকে উদ্ধারের পথ করে দেয়া হবে। তবে যুদ্ধবিরতির সুযোগে ইউক্রেনের সেনারা রুশ সেনার উপরে হামলা চালায়। পাল্টা জবাব দেয় রুশ সেনা। যার ফলে উদ্ধার অভিযান ভেস্তে যায়। পরবর্তীতে গতকাল আবার মানবিক কারণে নতুন করে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেয় রাশিয়া। স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্ধারে ন’ঘণ্টার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রুশ সেনা। এদিন এক বিবৃতিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, তার দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা যুদ্ধ ঘোষণার সামিল।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, ইউক্রেনের মারিউপোল ও ভলনোভাখা শহর থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যাওয়ার সুযোগ দিতে যে সামরিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল তার অপব্যবহার করেছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। এ কারণে ওই যুদ্ধবিরতি স্থগিত করে আবার সামরিক অভিযান শুরু করা হয়। শনিবার রাতে কোনাশেনকভ বলেছেন, ঘোষিত যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ইউক্রেনের উগ্র জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র ব্যক্তিরা রাশিয়ার সেনাদের ওপর হামলা অব্যাহত রাখে এবং তাদেরকে হামলা করা থেকে বিরত রাখতে কিয়েভ ব্যর্থ হয়। এ কারণে শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাশিয়ার সেনাবাহিনী আবার অভিযান শুরু করে। পরে আবারও নতুন করে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত হয়। রাশিয়া জানায়, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের শহর দু’টি থেকে বের করে নিতে হবে যাতে পরবর্তীতে অভিযান চালানোর সময় বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় নিতে না হয়। কিন্তু রাশিয়ার বার্তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, দেশটির ঘোষিত নিরাপদ করিডোর দিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের বেরিয়ে যাওয়ার কাজে বাধা সৃষ্টি করে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী।
এদিকে, ইউক্রেনে হামলার চালানোর জেরে রাশিয়ার ওপরে পশ্চিমা নানা দেশ যে নিষোধাজ্ঞা আরোপ করেছে, প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন মনে করছেন তা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। ‘তবে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে সত্যিকার অর্থে সেরকম কিছু ঘটেনি,’ তিনি বলছেন। পুতিন হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেনের আকাশসীমার উপরে বিমান চলাচল বন্ধ বা ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা দিলে সেটিকে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কেউ যদি এমন করে তবে তাকে শত্রু হিসেবেই জবাব দেয়া হবে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স এরোফ্লোটের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সফরকালে তিনি এসব মন্তব্য করেন। ‘বর্তমান নেতৃবৃন্দকে বুঝতে হবে যে তারা যে পথে এগোচ্ছে, সেই পথেই যদি এগোতে থাকে তাহলে তারা রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে ফেলবে,’ মন্তব্য করেছেন তিনি।
রাশিয়াতে মার্শাল ল বা জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হবে কিনা এমন ধারণা নাকচ করে দিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, সামরিক কর্মকাণ্ড রয়েছে এমন নির্দিষ্ট কোন জায়গার বাইরে থেকে আগ্রাসনের ঘটনা ঘটলে শুধুমাত্র তখনই এমন পদক্ষেপ নেয়া হবে। ‘কিন্তু এমন পরিস্থিতি এখন নেই। আমি আশা করছি এমন কিছু হবে না।’ ইউক্রেনে রাশিয়া সামরিক অভিযান যতটা সফল হবে বলে পুতিন আশা করেছিলেন, আসলে সেরকম হয়নি, পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞদের এমন বিশ্লেষণ নাকচ করে দিয়ে মি পুতিন বলেছেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনী তার দায়িত্ব সম্পন্ন করবে। সে নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সবকিছু সেভাবেই এগোচ্ছে।’
রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তিকে বিশেষ সতর্কাবস্থায় রাখার জন্য রুশ সামরিক বাহিনীকে আদেশ দিয়েছেন পুতিন। ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে রাশিয়ার সাধারণ নাগরিকদের তলব করা হয়েছে এবং তারাও ইউক্রেনে রয়েছেন এমন অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ইউক্রেনে শুধু পেশাদার সেনারাই অভিযানে অংশ নিচ্ছে। ওদিকে সংঘাত বন্ধে কূটনৈতিক উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।
মারিউপোলে ফের উদ্ধারকাজ শুরু: মারিউপোলের শহর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শহরটিতে নতুন করে আরেকটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা (বাংলাদেশ সময় গতকাল দুপুর দুইটা থেকে রাত একটা) পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকবে। বেসামরিক বাসিন্দারা এই সময় শহর ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। মারিউপোলের শহর কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করেছে, যারা ব্যক্তিগত গাড়ীতে যাবেন, তারা যেন রেডক্রসের বাসের পেছনে পেছনে থাকেন। সব গাড়ির সব আসনে যাত্রীপূর্ণ করে নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
ইউক্রেনের ৫ শহরের পতন: ইউক্রেনে অভিযানের সময় গতকাল রাশিয়ান সৈন্যরা আরও ১১ কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছে। গতকাল রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগর কোনাশেনকভ একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন। ‘রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর ইউনিট আক্রমণাত্মক অভিযানের সময় প্রিয়তনে, জাভিটনে-বাজানে, স্টারোমলিনোভকা, ওকটিয়াব্রস্কে এবং নভোমাইস্কের শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। তারা আরও ১১ কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছে,’ কোনাশেনকভ বলেছেন।
বিশ্বশক্তি হিসেবে রাশিয়াকে সমীহ করে ন্যাটো: ন্যাটো রাশিয়ান জনগণের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে না বা একটি বিশ্বশক্তি হিসাবে রাশিয়ার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এই কথা বলেছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। সাক্ষাতকারটি গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। বরিস বলেন, ‘আমাদের রুশ জনগণের প্রতি কোন শত্রুতা নেই, এবং আমাদের একটি মহান জাতি এবং একটি বিশ্ব শক্তিকে অপমান করার কোন ইচ্ছা নেই,’ তিনি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন যে, ‘অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্য হওয়ার কোন গুরুতর সম্ভাবনা নেই।’ ‘এটি ন্যাটোর কোন সংঘাত নয়, এবং এটি হবেও না। কোন মিত্র ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে সৈন্য পাঠায়নি,’ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন।
এর আগে, তিনি ইউক্রেনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনাকে সমর্থন করার জন্য ন্যাটো মিত্রদের কাছে চয় দফা প্রস্তাব করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে, একটি আন্তর্জাতিক মানবিক জোটকে একত্রিত করা, কিয়েভে প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা, রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক চাপ সর্বাধিক করা, ইউক্রেনে রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের ‘যেকোনো ক্রমাগত স্বাভাবিকীকরণ’ রোধ করা, ডি-এস্কেলেশনের দিকে কূটনৈতিক পথ খুজে বের করা এবং সেইসাথে ইউরো-আটলান্টিক নিরাপত্তা জোরদার করা।
জনসনের মতে, পশ্চিম এবং সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই উদ্যোগগুলোকে সমর্থন করা। পরের সপ্তাহে, তিনি তার কানাডিয়ান সমকক্ষ জাস্টিন ট্রুডো এবং তার ডাচ সহকর্মী মার্ক রুটের সাথে আলোচনা করতে চান যারা সোমবার, ৭ মার্চ লন্ডন সফর করবেন। মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ব্রিটিশ রাজধানী ভিসেগ্রাড গ্রুপের (পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, সেøাভাকিয়া, হাঙ্গেরি) নেতাদের হোস্ট করবে যারা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ইউক্রেনের জন্য নিবেদিত একটি বিশেষ বৈঠকে অংশ নেবেন।
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিনের সাথে আলোচনা এরদোগানের: রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেপ এরদোগান গতকাল ফোনে কথা বলেছেন। তুরস্কের টিপিটি টেলিভিশন চ্যানেল এই তথ্য জানিয়েছে। উভয় পক্ষ ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন শনিবার বলেছেন যে, আলোচনার সময় এরদোগান মস্কো এবং কিয়েভের মধ্যে আলোচনার জন্য পরিস্থিতি তৈরির বিষয়ে প্রস্তাব দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।
উল্লেখ্য, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন ইউক্রেনের ডনবাস প্রজাতন্ত্রের প্রধানদের সাহায্যের অনুরোধের প্রতিক্রিয়ায় একটি বিশেষ সামরিক অভিযান ঘোষণা করেছিলেন। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, মস্কোর ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখল করার কোন পরিকল্পনা নেই, তবে দেশটিকে নিরস্ত্রীকরণ এবং ডিনাজিফাই করার লক্ষ্য রয়েছে। পরবর্তীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য এবং কিছু অন্যান্য দেশ বলেছে যে, তারা রাশিয়ান ব্যক্তি এবং আইনি সত্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। সূত্র : তাস, ইন্টারফ্যাক্স, বিবিসি, আল-জাজিরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন