বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

হিজাব নিয়ে সিদ্ধান্ত কি আদালত নিতে পারে?

মুসলিম-শিখদের অবদানের কথা ছবিতে উল্লেখ নেই কেন : ওমর আবদুল্লাহ যুক্তরাজ্যে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’র বিরুদ্ধে পিটিশন দায়ের করতে আহ্বান

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ মার্চ, ২০২২, ১২:০০ এএম

ভারতের একটি আদালতের এক রায় অনুযায়ী, হিজাব পরা হয়তো মুসলিমদের সংস্কৃতির অংশ হতে পারে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায় এর সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। এই রায়টি দিয়েছে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্নাটকের তিন বিচারকের একটি বেঞ্চ। এই রাজ্যের সরকার স্কুলে মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করেছিল, আদালত সেই নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখে এই যুক্তিতে যে ইসলামে হিজাব পরার কোন ‘বাধ্য-বাধকতা’ নেই। আদালতের এই রায়ের ফলে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা অনেকটা ক্ষুণœ হলো বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে, ভারতের নতুন একটি সিনেমা নিয়েও শুরু হয়েছে বিতর্ক। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নামের ওই সিনেমাটির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার মুসলিমদের বিরুদ্ধে নতুন করে প্রোপাগÐা ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

হিজাব নিয়ে তীব্র বিতর্কে এর পক্ষে-বিপক্ষে ভারত যখন মারাত্মকভাবে বিভক্ত, তখনই আদালত কর্নাটকের বিজেপি সরকারের পক্ষে রায় দিলো। তবে কর্নাটকের আদালতের এই রায় এখন চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে- হাইকোর্টের রায়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল রুজু করা হয়। কিন্তু আদালতের এই রায় নিয়ে আইনজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞরা এখন তাদের মতামত তুলে ধরছেন, তারা এই রায়ের তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করছেন, কারণ বহু জাতি-ধর্মের বৈচিত্রপূর্ণ দেশ ভারতে ধর্ম বিশ্বাসের প্রতীক জনসমক্ষে প্রদর্শন করা একেবারেই সাধারণ বিষয়। আদালতের এই রায়টির মূল ভিত্তি তথাকথিত ‘এসেনশিয়ালিটি টেস্ট’- অর্থাৎ কোন ধর্মের অপরিহার্য বিষয়গুলো আসলে কী। ভারতের আদালতগুলো এখন ধর্মীয় বিষয়ের বিতর্ক নিরসনে বেশি করে এই ‘এসেনশিয়ালিটি টেস্ট’ বা ‘অপরিহার্যতার পরীক্ষা’ ব্যবহার করছে। কর্নাটকের হাইকোর্ট ১২৯ পৃষ্ঠার যে রায় দিয়েছে, তার ভিত্তি ছিল মূলত এই প্রশ্নটিই। মামলার শুনানি মূলত আবর্তিত হয়েছে এই প্রশ্নকে ঘিরেই।

এই মামলার বাদী ছিলেন কর্নাটকের উদুপি জেলার একটি সরকারি কলেজের একদল মুসলিম ছাত্রী, যাদেরকে ক্লাসে হিজাব পরে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল। ছাত্রীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু কলেজ তাদের প্রতিবাদকে পাত্তা দেয়নি। ফলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। এই ছাত্রীরা যুক্তি দিয়েছিল যে, হিজাব নিষিদ্ধ করা কেবল বৈষম্যমূলকই নয়, এটি তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধর্ম পালনের স্বাধীনতারও লঙ্ঘন। তারা বলেছিলেন, তাদের ধর্ম বিশ্বাসে মাথা ঢেকে রাখার কথা আছে। সরকার এটিকে চ্যালেঞ্জ করে, তারা বলেছিল, আবেদনকারীদেরকেই প্রমাণ করতে হবে যে তাদের ধর্মে আসলেই হিজাব পরা ‘অত্যাবশকীয়।’ আদালতে এই মামলা নিয়ে ১১ দিন ধরে উত্তপ্ত বিতÐা হয়েছে, শুনানি মূলতবি হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত আদালত এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে, আবেদনকারীরা এটা প্রমাণে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছেন যে, হিজাব পরা ধর্মে ‘অত্যাবশকীয়’ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী রেবেকা জন বলছেন, ‘এখন আপনি ধর্মতত্তে¡র এমন সব জায়গায় ঢুকে পড়ছেন, যেটা সম্পর্কে বিচারক বা আইনজীবীরা খুব কমই জানেন।’ তিনি বলছেন, ‘ধর্ম পালনের ব্যাপার যখন আসে, তখন কিন্তু ধর্মীয় রীতি পালনের কোন একক পথ নেই- একটি নির্দিষ্ট ধর্মের ছায়াতলে হয়তো বহু মানুষ এসেছেন, কিন্তু প্রত্যেকেই যার যার মতো করে এই ধর্ম পালন করছেন।’ ‘এমনকি হিজাবও বহু ধরণের মানুষের কাছে বহু কিছুর প্রতীক। এটাকে নিন্দা করার একটা সহজ পথ হচ্ছে এটিকে একধরণের ‘নিপীড়ন’ বলে চালিয়ে দেয়া, কিন্তু গোটা বিশ্ব জুড়ে হিজাব এখন প্রতিরোধের প্রতীক। কাজেই কারও অবয়ব ঢাকার জন্য কোনটি অপরিহার্য সেটা আমরা ঠিক করে দিতে পারি না, নানা কারণে মানুষ এই হিজাব পরে।’

যুক্তরাষ্ট্র বা এরকম অন্য দেশের আদালতের চেয়ে এটা একেবারেই ব্যতিক্রম। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে যদি বাদী বলেন যে, কোন একটি রীতি তার ধর্মের অংশ, আদালত কোন প্রশ্ন ছাড়াই সেটা মেনে নেয়। কিন্তু ভারতে এই সিদ্ধান্ত এখন আদালত নিজেই নিয়ে নিচ্ছে, কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারে নির্বিচারে। দু’হাজার সতের সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক তালাক (তিন তালাক) নিষিদ্ধ করে। আদালত বলেছিল, তিন তালাক প্রথা ইসলামের অত্যাবশকীয় কোন অংশ নয়। ১৯৯৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে জমি নিয়ে এক বিরোধের নিস্পত্তি করতে গিয়ে বলেছিল, ইসলাম ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মসজিদ ‘অপরিহার্য’ নয়, কারণ নামাজ যে কোন জায়গায় পড়া যায়। কাজেই আদালত রায় দেয় যে, ঐ মসজিদের চারপাশের জমি হিন্দুদের দেয়া যায়।
দু’হাজার ষোল সালে কেরালার হাইকোর্ট কোরআনের পাঠের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে রায় দিয়েছিল যে, এতে লেখা আছে মাথা আবৃত করে রাখা ধর্মীয় কর্তব্য, সুতরাং এটি ইসলামে অপরিহার্য বলে বিবেচিত হবে। আদালত যে মামলার রায় দিতে গিয়ে একথা বলেছিল, সেই মামলার বাদী ছিলেন একদল মেডিক্যাল ছাত্রী। তাদেরকে পরীক্ষার হলে হিজাব পরতে নিষেধ করা হয়েছিল এই যুক্তিতে যে, এতে তারা পরীক্ষায় নকল করা বা জালিয়াতির সুযোগ পাবে। কর্নাটকের আদালতে যারা হিজাব পরার অধিকার চেয়ে মামলা করেন, তারা এই রায়টির কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এবার আদালত তাদের যুক্তি খারিজ করে দেয়।

‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’র বিরুদ্ধে পিটিশন দায়ের করতে আহŸান : যুক্তরাজ্যে ভারতের বিতর্কিত সিনেমা ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমা প্রদর্শনের কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেখানকার কাশ্মীরি নাগরিকরা। তারা ওই সিনেমা দ্বারা প্রচারিত মুসলিম বিদ্বেষের পরিপ্রেক্ষিতে যেকোন দুর্ঘটনা এড়াতে পিটিশন দায়ের করার আহŸান জানিয়েছেন। তেহরিক-ই-কাশ্মীরের (টিইকে) যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি রাজা ফাহিম কায়ানি সতর্ক করেছেন যে, ‘সিনেমার পরবর্তী প্রভাবগুলো উদ্বেগজনক এবং যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী কাশ্মীরিদের ক্ষতি করতে পারে।’ শুক্রবার এক বিবৃতিতে কায়ানি বলেছেন, ‘এই ইসলামোফোবিক মুভিটি যুক্তরাজ্যে কাশ্মীরি ছাত্র, পেশাদার, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুরু করার আশঙ্কা রয়েছে।’

‘সবাইকে তাদের এমপি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, সিনেমা ব্যবস্থাপনা এবং পুলিশকে এই প্রোপাগান্ডা সিনেমা প্রদর্শনের বিরুদ্ধে সতর্ক করার জন্য চিঠি এবং আবেদনপত্র লিখতে অনুরোধ করা হচ্ছে,’ টিইকে নেতা যোগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘কাশ্মীর ফাইলস একটি বিঘ্নিত এবং হিংসাত্মক চলচ্চিত্র যা ভারতীয় অবৈধভাবে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের (আইআইওজেকে) মুসলিম জনসংখ্যাকে হেয় করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।’ ‘আমরা কাশ্মীরি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নই তবে এই মুভিটির মাধ্যমে আইআইওজেকে-এর মুসলিম জনসংখ্যার বিরুদ্ধে সহিংসতা ঘটানোর আশঙ্কা রয়েছে, এ কারণে, যুক্তরাজ্যের প্রত্যেককে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য এবং এই সিনেমাটি প্রদর্শন না করার জন্য লোকেদের প্রভাবিত করার অনুরোধ করা হচ্ছে। ইসলামফোবিয়াকে চিরস্থায়ী করতে এবং মুসলমানদের ক্ষতি করতে এটি আরও একটি প্রোপাগÐা,’ কায়ানি বলেছিলেন।

মুসলিম-শিখদের অবদানের কথা ছবিতে উল্লেখ নেই কেন : সারা ভারতে যখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু দ্য কাশ্মীর ফাইলস, তখন ছবিটি নিয়ে নীরবতা ভাঙলেন অধিকৃত কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। ছবির নির্মাতাদের কটাক্ষ করে বললেন, ছবির গল্প সত্য থেকে অনেক দূরে। নির্মাতারা সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে গিয়ে মুসলিম-শিখদের বলিদানকে অস্বীকার করেছে।

ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা তথা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর বলেছেন, দ্য কাশ্মীর ফাইলস বাণিজ্যিক ছবি। তাতে কারও কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু নির্মাতারা যদি দাবি করেন, এটি সত্য ঘটনা অবলম্বরে তাহলে সেটা ভুল। যখন কাশ্মীরি পÐিতদের সঙ্গে এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। ফারুক আবদুল্লা তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না। জগমোহন তখন রাজ্যপাল ছিলেন। কেন্দ্রে ভি পি সিংয়ের সরকার ছিল। যাকে বিজেপি সমর্থন করেছিল। কুলগাম জেলায় সাংবাদিকদের এমন কথা বলেছেন ওমর আবদুল্লা। ওমর অবাক হয়ে গিয়েছেন, কী করে এত বড় সত্যিটা ছবিতে লুকানো হয়েছে। তার দাবি, ‘সত্যকে লুকাবেন না। এটা ঠিক নয়। যদি কাশ্মীরি পন্ডিতরা সন্ত্রাসের বলি হন, আমাদের তাতে সমবেদনা রয়েছে। কিন্তু আমাদের ভুললে চলবে না, মুসলিম-শিখরাও বন্দুকের নলের সামনে প্রাণ দিয়েছেন।’ উল্লেখ্য, নিজের মুখ্যমন্ত্রিত্বে ওমর আবদুল্লা একটি কমিশন গঠন করেন যার কাজ ছিল সন্ত্রাসের আধিপত্যের ফলে যা যা হয়েছে তার সত্য উদঘাটন করে ব্যবস্থা নেয়া। সূত্র : বিবিসি বাংলা, টিওআই, ট্রিবিউন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Khan ২০ মার্চ, ২০২২, ৫:০৬ এএম says : 0
হিজাব নিয়ে আদালত রায় দিতে পারে কিন্তু ভারতের আদালত দিতে পারবেনা কারণ ভারতের আদালত বিজেপির আদালত এই আদালত মুসলিম বিরুদ্ধী।
Total Reply(0)
মাহমুদ ২০ মার্চ, ২০২২, ৮:৫০ এএম says : 0
কোন আদালত ইসলামের বিধান পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন