আগামী জাতীয় নির্বাচন দেড় বছর পর অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে অনেক আগেই বিরোধীদল তো বটেই বিভিন্ন মহলেও আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনার মূল কারণ হচ্ছে, বিগত দুইটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষে ও গ্রহণযোগ্য না হওয়া। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন দুটি সাংবিধানিকভাবে সঠিক হলেও বিনাভোট, ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া আধিপত্য এবং ভোটারদের ভোট দিতে না পারার বিষয়গুলো দেশে এবং বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বেশিরভাগেরই মত, নির্বাচন দুটি ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার’ হয়নি এবং তা গ্রহণযোগ্য নয়। এই মতের ওপর ভিত্তি করেই এখন বিরোধীদলগুলো বলছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের অধীনে অংশগ্রহণ করবে না। কেবলমাত্র নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক কিংবা জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই তারা অংশগ্রহণ করবে। বৃহত্তম বিরোধীদল চাইছে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং অন্যান্য বিরোধীদল চাইছে জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। যদিও তত্ত্বাবধায়ক নাকি জাতীয় সরকার এ নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা মতদ্বৈততা রয়েছে, তারপরও এই দুই সরকারের যেটিই হোক, তার অধীনেই তারা নির্বাচনে অংশ নেবে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নয়। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দল তার অধীনেই নির্বাচন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, বিরোধীদলগুলোর দাবী বাস্তবায়িত হবে, নাকি ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই নির্বাচন হবে। এ হিসাব সামনে রেখে আগামী দেড় বছর দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, যে ফরম্যাট বা সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন তার লক্ষ্যই হচ্ছে, দেশের গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত করে এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া। আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকাকালে এদিকে খুব একটা মনোযোগ দেয়নি। তারা কেবল তাদের ক্ষমতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। জনগণের মতামত বা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার বিষয়টি উপেক্ষা করেছে এবং করছে। তাদের কাছে জনগণ খুব কমই মূল্য পেয়েছে।
দুই.
আমাদের দেশে যেসব রাজনৈতিক দল পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে তাদের কখনোই আন্তরিকতা নিয়ে কথা উঠেছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন জনগণের মতকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজেদের মতকেই গণতান্ত্রিক হিসেবে মনে করেছে। আর বিনাভোটে নির্বাচিত সরকার তো জনমত তোয়াক্কা করে না। এরশাদ সরকারের পতনের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেকটি দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি সানন্দে গ্রহণ করে। এটা গ্রহণ করে এজন্য যে, তখন এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে একযোগে আন্দোলন করলেও তাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটি ছিল না। প্রত্যেকেই মনে করেছে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না। এ মনোভাব থেকেই প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল সর্বসম্মতভাবে একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ফর্মূলা উদ্ভাবন করে এবং মেনে নেয়। এতে জনগণেরও বিপুল সমর্থন ছিল। তারা সকলেই মনে করেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারই পারবে একটি গণতান্ত্রিক সরকার উপহার দিতে। হয়েছেও তাই। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই সরকার অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন উপহার দেয়, যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠেনি। গণতন্ত্রের সূচনাকাল থেকেই যেহেতু গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বদলেছে এবং তাতে বিভিন্ন তত্ত্ব ও পদ্ধতি যুক্ত ও বিযুক্ত হয়েছে, তাই গণতন্ত্রের মৌলিক নির্যাস বজায় রেখে জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটানোর জন্য নির্বাচন ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার তত্ত্ব যুক্ত হওয়া দোষের কিছু ছিল না। কোনো কোনো দেশ এ পদ্ধতি গ্রহণও করে। গণতন্ত্রে সংযোজিত নতুন এই সংযোজন দেশ শাসনের পদ্ধতি নয়। এর কাজ শুধু একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে এ পদ্ধতিতে দেশ বেশ ভালভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সব কিছু গড়বড় হয়ে গেল, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। রায়ের এক অংশ গ্রহণ করে অন্য অংশ বর্জন করে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল তা বাতিল করে দেয়। সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচন পদ্ধতিটি যুক্ত করা হয়েছিল, তা বাতিল করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কয়েক বছর ধরে বিস্তর যুক্তি-তর্ক হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই এ পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে। এর বিপরীতে ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে বরাবরই বলা হয়েছে এবং হচ্ছে, গণতন্ত্রের সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্রে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সাথে তুলনা করে বলা হচ্ছে, সেখানে গণতন্ত্রের এই ধারাই বজায় রয়েছে। তবে এ তুলনার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। উন্নত দেশগুলো তাদের মতো করে গণতন্ত্রকে ধারণ করেছে এবং তাতে তাদের জনগণ খুশি। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। অর্থাৎ সেখানে ‘পিপলস রুল’ অনুযায়ীই গণতন্ত্রকে মানা হচ্ছে। তাদের জনগণ যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে নির্বাচন চাইতো, তাহলে নিশ্চয়ই এই পদ্ধতিতেই নির্বাচন হতো। সেসব দেশে এ পদ্ধতিতে নির্বাচন করার প্রয়োজনীয়তা নেই এ কারণে যে, তাদের জনগণ দেখছে, ক্ষমতায় যে দল থাকে তার অধীনে নির্বাচন হলে তা নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়। বিনাভোটে বা সরকার গঠন করার মতো বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হয় না। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে জোর জবরদস্তির মাধ্যমে ভোট ছিনিয়ে নেয়ার বিন্দুমাত্র অশঙ্কা থাকে না। ক্ষমতাসীন দল হেরে গেলেও বিরোধীদলকে অভিনন্দন জানিয়ে ক্ষমতা থেকে চলে যায়। আমাদের দেশে কি জনগণের এ চাওয়া মানা হচ্ছে? এখনও যেখানে দেশের বেশির ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন চাচ্ছে, সরকার কি তা আমলে নিচ্ছে? নিচ্ছে না। হ্যাঁ, দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এটি গণতন্ত্রের সুষ্ঠু একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া আবার একেক দেশে একেক রকম। যেমন আমেরিকায় যে প্রক্রিয়ায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, ইংল্যান্ড বা ভারতসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে সে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয় না। তারা তাদের জনগণের রায়কে শক্তিশালী করার জন্য তাদের মতো করে পদ্ধতি যুক্ত করে নিয়েছে। গণতন্ত্রে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে এ কারণে যে, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে জয়-পরাজয় মেনে নেয়ার ইতিবাচক ও পারস্পরিক আস্থার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য। উন্নত বিশ্বে এ আস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলেই, তারা এ ধারণা বহাল রেখেছে। এটি যে পরিবর্তন করা যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়েই এটি বিশুদ্ধ হয়। যেমন গণতন্ত্রের সূচনাকালে পত্রপত্রিকা বা গণমাধ্যম বলে কিছু ছিল না। ফলে গণতন্ত্রে ‘ফ্রিডম অব প্রেস’ যুক্ত করার প্রয়োজন হয়নি। সেখানে ‘ফ্রিডম অব স্পীচ’ বা বাকস্বাধীনতা যুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমের প্রসার ঘটায় গণতন্ত্রে ‘ফ্রিডম অব প্রেস’ বিষয়টিও যুক্ত করা হয়। গণতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন বিষয় সংযোজন ও বিয়োজন করতে হয়। গণতন্ত্রের উপাদানে অ্যাবসলিউট বা অপরিবতর্নীয় বলে কিছু নেই। এই ধারাবাহিকতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক যদি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না চায়, তাহলে অসুবিধা কি? এতে যে গণতন্ত্র ভুলুণ্ঠিত হয়ে যাবে, এমন মনে করার কারণ নেই। গণতন্ত্র তো জনগণের ইচ্ছা ও অনিচ্ছার উপরই নির্ভর করে চলে। তাদের ইচ্ছার প্রতিফলনই ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। এ নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। এর মাধ্যমে যারা জিতে ক্ষমতাসীন হয়, তাদেরও সতর্ক হয়ে কিংবা ক্ষমতাকে স্থায়ী করার মানসিকতা কিছুটা হলেও কম থাকে। কারণ, পরবর্তী নির্বাচনে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। বিগত পাঁচ বছরের ক্ষমতাসীন হয়ে তারা জনগণের জন্য কি করেছেন এবং তারা সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট কিনা, তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রায় দিতে পারেন। সন্তুষ্ট হলে তাদেরকেই পুনরায় নির্বাচিত করবে, অসন্তুষ্ট হলে ক্ষমতায় যাওয়ার মেন্ডেট দেবে না। অন্য কোনো দলকে দেবে। অন্যদিকে, দলীয় সরকারের অধীনে কেমন নির্বাচন হয়, তা তো বিগত ১৩ বছর ধরে জনগণ দেখছে। তাদের ভোটাধিকার বলে কিছু থাকছে না।
তিন.
গণতন্ত্রে খণ্ডিত, সীমিত ও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ নেই। ব্যতিক্রম হলেই দেশে নানা নেতিবাচক উপসর্গ দেখা দেয়। গণতন্ত্রকামী মানুষ তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশও তাতে অসন্তুষ্ট হয়। এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেশে ও বিদেশে দেখা দেয়। আমাদের দেশের মানুষ যে সীমিত গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতা হরণ করার মতো নানা আইন কানুন প্রণয়ন করা নিয়ে অসন্তুষ্ট, তা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। তবে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ, বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশের সচেতন মহল এসব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিভিন্ন সময়ে তার প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন এবং সরকার ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতান্ত্রিক ধারা পুরোপুরি বলবৎ না করে শ্লোগান সর্বস্ব গণতন্ত্রের কথা কেউই পছন্দ করে না। তখন দেশের টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। উন্নয়ন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। তারা ফুলেফেঁপে উঠে। সরকারঘেঁষা এ শ্রেণী প্রভাবশালী হয়ে দেশের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আইনের শাসন কিংবা সুশাসনের অভাবে তারা যা খুশি তা করার সুযোগ পেয়ে যায়। দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করে। কি হারে দুর্নীতি হয় তার চিত্র প্রায় প্রতিনিয়তই পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এর কারণ যে ক্ষয়ীষ্ণু গণতন্ত্র এবং জবাবদিহির অভাব, তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। যেখানে গণতন্ত্র নূব্জ্য হয়ে পড়ে, জবাবদিহিতা থাকে না, সেখানে একটি শ্রেণীর দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া স্বাভাবিক। কিছু মানুষের উন্নতি কোনোভাবেই সামগ্রিক উন্নতির সূচক হতে পারে না এবং এ নিয়ে সরকারের আত্মতুষ্টিতে ভোগা দেশের সাধারণ মানুষকে উপহাস করার শামিল। বলাবাহুল্য, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা কেউই পছন্দ করে না। বিশ্বের প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলোরও পছন্দ করার কারণ নেই। তারা সরাসরি তাদের অপছন্দের কথা না বললেও, কূটনৈতিক উপায় ও বিভিন্ন সহযোগিতার পাইপ লাইন সীমিত করে দিয়ে তা প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে পুলিশসহ র্যাবের ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞাই দিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, গণতন্ত্রহীনতা, সীমিত গণতন্ত্র বা খর্বকৃত গণতন্ত্র দিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায় না। এতে কিছু বড় বড় স্থাপনা গড়ে উঠতে পারে, তবে তা সার্বিক উন্নয়নের প্রতীক হতে পারে না। যদি হতো, তবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোতে এখনো কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন ব্যবস্থাই বলবৎ থাকতো। তারা মুক্ত গণতন্ত্রে ফিরে আসত না। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুপ্রাচীনকাল থেকেই শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব বিরাজমান। তবে তাদের মধ্যে যে শুভবুদ্ধির কিছু মানুষ ছিল না, তা নয়। তারা উপলব্ধি করেছে, কিভাবে জনগণের মতামতের ওপর ভিত্তি করে একটি সার্বজনীন শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের জীবনযাপন সহজ ও ব্যক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা যায়। প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি সময় আগে শাসক গোষ্ঠী নিজেদের সাধারণ মানুষের চেয়ে এলিট বা অভিজাত ভাবতেন। সাধারণ মানুষকে ক্রীতদাস হিসেবে শাসন করতেন। এতে সাধারণ মানুষের অধিকার বলে কিছু ছিল না। প্রতিবাদ করা দূরে থাক মুখ ফুটে কিছু বলারও সাহস করত না। এ প্রেক্ষিতে, গ্রীক দার্শনিক ক্লিসথেনিস ‘পাওয়ার অব পিপল’, ‘রুল অব পিপল’ বা ডেমোক্রেসি নামে একটি থিওরি এলিট শাসকদের সামনে তুলে ধরেন, যেখানে সাধারণ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা কিংবা শাসক নির্বাচান করার অধিকার থাকবে। প্রতিক্ষেত্রে শাসকরা সাধারণ মানুষের সেবক হয়ে কাজ করবে। তার এই ‘অ্যাথেনিয়ন ডেমোক্রেসি’ থিওরির কারণে এলিট শ্রেণীর মধ্যে এ উপলব্ধি আসে যে সাধারণ মানুষকে আর ক্রীতদাস হিসেবে শাসন করা যাবে না এবং এই ডেমোক্রেসি একটি ভাল পদ্ধতি। সেই থেকে ডেমোক্রেসি হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের কাছে পরম কাক্সিক্ষত বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। কাল পরিক্রমায় এর সাথে নতুন নতুন তত্ত্ব, পদ্ধতি যুক্ত এবং সংজ্ঞারও পরিবর্তন হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাটি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। তিনি গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করে বলেছেন, ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল।’ এ সংজ্ঞায় জনগণকে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। আর সরকার জনগণের সেবক। এভাবে পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়ে গণতন্ত্র এখন অনেক বেশি পরিশীলিত এবং সাধারণ মানুষের অধিকারকে আরও বেশি সুরক্ষিত করেছে। আমাদের দেশও স্বাধীন হয়েছে গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে।
চার.
এ কথা সর্বজনবিধিত, গণতন্ত্রই বিশ্বে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। মানুষ তার অধিকার নিশ্চিতকরণে গণতন্ত্রকেই একমাত্র উপায় হিসেবে অবলম্বন করে চলেছে। গণতন্ত্রের পরে অনেক তন্ত্র নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে, শেষ পর্যন্ত সেগুলো টিকে থাকেনি। এমনকি যারা স্বৈরশাসন কায়েম করেছিল, তারাও জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার কাছে পরাভূত হয়েছে। আবার অনেক স্বৈরশাসকও গণতান্ত্রিক ধারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের দেশেই এর উদাহরণ রয়েছে। যে এরশাদ সরকার ৯ বছর স্বৈরশাসন চালিয়েছিল তাকেও এক সময় গণতন্ত্রকে মেনে নিতে হয়েছে। এখন তার গঠিত দল গণতন্ত্রের কথা বলছে। আমরা যদি একগুঁয়ে, রগচটা, নিষ্ঠুর, স্বৈরাচার হিটলারের কথা ধরি তাহলেও দেখা যাবে, গণতন্ত্রের প্রতি তার আকাক্সক্ষা ছিল। ছোটবেলায় হিটলার তার খেলার সাথীদের বলতেন তাকে ‘প্রেসিডেন্ট’ বলে শ্লোগান দিতে। এর বিনিময়ে সে তাদের মিষ্টি খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিত। মিষ্টি খাওয়ার লোভে তার খেলার সাথীরাও মিছিল করে হিটলারকে প্রেসিডেন্ট বলে শ্লোগান দিত। হিটলার খুশি হয়ে তাদের মিষ্টির দোকানে নিয়ে যেতেন। তাদের মিষ্টি খাওয়াতেন। মিষ্টি খাওয়ানোর পর দোকানদার পয়সা চাইলে হিটলার বলতেন, দ্যাখছো না, ওরা আমাকে প্রেসিডেন্ট বলছে! প্রেসিডেন্টকে মিষ্টির দাম দিতে হয় না। ১৯৩৪ সালে যখন হিটলার জার্মানির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তখন এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার প্রথম কাজ কি হবে? জবাবে হিটলার বলেছিলেন, আমার প্রথম কাজ হবে ছোটবেলা যে মিষ্টির দোকানদারকে পয়সা দেইনি, তার পয়সা দেয়া। হিটলারের ছোট্ট এই ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, তাকে যতই নিষ্ঠুর বলে আখ্যায়িত করা হোক না কেন, তার দেশের মানুষের ন্যায্য পাওনা ও অধিকারের ব্যাপারে তিনি সচেতন ছিলেন। গণতন্ত্রের নির্যাস তার অবচেতন মনেও ছিল। আসলে গণতন্ত্র এমনই, কেউ তা পছন্দ না করলেও, অলক্ষ্যেই গণতন্ত্র তাদের মনে ছায়া ফেলে। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানেই। সময়ের আবর্তে জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে গণতন্ত্রে অনেক চিন্তা-ভাবনা যোগ-বিয়োগ হতে পারে। মানুষের অধিকার সুরক্ষিত করতে তা করতেই হবে। তার অর্থ এই নয়, গণতন্ত্রকে বাদ দিতে হবে এবং জনগণ যা চায় না, তা যোগ বা বিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেহেতু এখনও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন চায়, তাই এই পদ্ধতিতেই নির্বাচন ব্যবস্থা করা উচিত।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন