ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্ব স্তম্ভিত। আমেরিকার অধিকাংশ জরিপ সংস্থা, রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ পৃথিবীর সব জরিপ সংস্থা, রেডিও, টেলিভিশন, বার্তা সংস্থা এবং প্রখ্যাত সব রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে, হিলারী ক্লিনটনই এই নির্বাচনে জয়লাভ করবেন। প্রতিটি সংস্থাই বলেছে যে, হিলারী ক্লিনটন ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন। কেউ বলেছেন যে, তিনি ৫ পয়েন্ট এগিয়ে আছেন, কেউ ৩ পয়েন্ট, আবার কেউ বলেছেন ২ পয়েন্ট। পয়েন্টের ব্যবধান যাই হোক না কেন, হিলারী যে এগিয়ে আছেন সে ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিলো না। এমন কি ভোট গ্রহণের ৫/৬ ঘণ্টা আগেও পরিচালিত একাধিক জরিপে দেখা গিয়েছিলো যে, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হিলারী ক্লিনটন সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে আছেন এবং ৮ তারিখের নির্বাচনে তিনিই প্রবেশ করতে যাচ্ছেন হোয়াট হাউসে। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনা, জরিপ ও নির্বাচনী পূর্বাভাসকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ২৯০টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে বিপুল বিজয় অর্জন করলেন, তখন সারা বিশ্ব স্তম্ভিত হয় এবং চমকে ওঠে অন্তত অর্ধেক আমেরিকাবাসী। নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, হিলারী পপুলার ভোট পেয়েছেন ৫ কোটি ৯২ লক্ষ ৯৪ হাজার ৬৪৯। পক্ষান্তরে ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ৫ কোটি ৯১ লক্ষ ৩৩ হাজার ৩৯৮। অর্থাৎ হিলারী ট্রাম্পের চেয়ে ১ লক্ষ ৬১ হাজার ২৯১ ভোট বেশী পেয়েছেন। তারপরেও হিলারী ক্লিনটন হেরে গেছেন। কারণ হলো ইলেকটোরাল ভোট ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় বলা হয় যে, ঞযব The Winner takes it all। অর্থাৎ যদি কোনো অঙ্গরাজ্যে ১০টি ইলেকটোরাল আসন থাকে এবং কোনো প্রার্থী যদি সেখানে ৬টি আসনে জয়লাভ করেন তাহলে ধরে নেয়া হবে যে, তিনি অবশিষ্ট ৪টি আসনেও জয়লাভ করেছেন। অর্থাৎ ১০টি আসনের সবক’টি আসনই তিনি পেয়েছেন। এই ইলেকটোরাল ভোটিংয়ের অদ্ভুত বিধানের বেড়াজালে পড়ে হিলারী পরাস্ত হয়েছেন। এ জন্যই বিশ্বব্যাপী এই বিস্ময় এবং হতাশা। এই হতাশার বহিঃপ্রকাশ নজিরবিহীন। আমেরিকার ইতিহাসে যা কোনো দিন ঘটেনি সেটাই ঘটেছে এবার। দেশটির একাধিক রাজ্যে এবং শহরে এই নির্বাচনী ফলাফলের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিবাদ চলছে। গাড়ী ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি মার্কিন রাজনৈতিক ইতিহাসে অশ্রুতপূর্ব ঘটনা। কিন্তু এবার সেগুলোও ঘটছে। তারপরেও বলতে হবে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প সংবিধান মোতাবেক আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এই নির্বাচনী ফলাফল আগামী দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটি বিচার করবে ইতিহাস। তবে ব্রেক্সিট বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বেরিয়ে যাওয়া সম্পর্কে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় সেই গণভোটের ফলাফলকে নিয়ে আজ যুক্তরাজ্যে যে ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে সেটি দেশটির জন্য কোনো শুভ সংকেত নয়। তবে সুখের বিষয় এই যে, জয়লাভের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশবাসীর উদ্দেশে যে তাৎক্ষণিক ভাষণ দিয়েছেন সেখানে তিনি বলেছেন যে, তিনি সমগ্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তিনি আমেরিকার সব মানুষকে সাথে নিয়ে দেশ গড়তে চান। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রের সাথে তিনি বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান।
প্রায় ১৮ মাস নির্বাচনী প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প যে সব বক্তব্য রেখেছেন এবং ওয়াদা করেছেন, সেগুলোর কতদূর বাস্তবায়ন তিনি করেন সেটি এখন দেখবার বিষয়। তিনি প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানো, সেনাবাহিনীর সক্রিয়-দায়িত্বরত সেনা সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে ৫ লাখ ৪০ হাজারে উন্নীত করা, বাবা-মা’দেরকে তাদের আয়কর থেকে চাইল্ড কেয়ার বিয়োগ করার সুযোগ দেয়া, শ্রমজীবী নতুন মা’দেরকে সবেতনে ছয় মাসের ছুটি মঞ্জুর করা, কংগ্রেসের সকল সদস্যের মেয়াদ সীমিত করার জন্য সাংবিধানিক সংশোধনী আনা, দক্ষিণ সীমান্তে একটি দেয়াল নির্মাণ এবং মেক্সিকোকে এর জন্য অর্থ প্রদানে বাধ্য করা, দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই বিদেশী অপরাধীদের সবাইকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ, আমেরিকার ১ কোটি ১০ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে দেশ থেকে বের করে দেয়া এবং নতুন কোনো অভিবাসী গ্রহণ না করা উল্লেখ যোগ্য। তিনি ন্যাটো ভেঙ্গে দিতে চেয়েছেন, টিপিপি বা নাফটা চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন, বিশ্ব জলবায়ু ও পরিবেশ চুক্তির পুনর্বিবেচনা চেয়েছেন। এখন এসব ওয়াদার বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জয়লাভের আগে ট্রাম্প যা কিছুই বলে থাকুন না কেন নির্বাচনের পর তাকে অবশ্যই কথা এবং কাজে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। নির্বাচনের আগে তিনি বিচারপতি, বিশ্বসুন্দরী, টিভি উপস্থাপক, যুদ্ধ-নায়কের শোকাহত পিতা-মাতা, এমনকি নিজ দলের শ্রদ্ধেয় নেতাদের সম্পর্কে তিক্ত কথা বলেছেন। মুসলিম ও হিস্পানিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছেন, নারীদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর উক্তি করেছেন, আমেরিকার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর প্রতি নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। নিজ আয়করের হিসাব বারবার প্রশ্নের মুখেও গোপন রেখেছেন। তাঁর কর্মকা-ে চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাঁকে আর সমর্থন না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন রিপাবলিকান দলেরই বহু ডাকসাইটে নেতা। তাঁর সর্বশেষ অডিও টেপে নারীদের প্রতি তাঁর চরম অরুচিকর মন্তব্যে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন তাঁর রানিং মেট পর্যন্ত। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিশ্ব রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। নির্বাচনের পূর্বে তার মুসলিম বিরোধী উক্তির জন্য মুসলিম জাহান ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন হয়। তাদের উদ্বিগ্নতার অবসান ঘটাতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমরা আশা করি, বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার যে সুসম্পর্ক রয়েছে সেটি তিনি অব্যাহত রাখবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন