শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

জট খুলছে না মালয়েশিয়ার

চুক্তির পর সাড়ে ৩ মাস পেরিয়েছে সিন্ডিকেটে মালয় এজেন্সির অসন্তোষ : প্রবাসীদের পাসপোর্টের জন্য হাহাকার

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৭ মার্চ, ২০২২, ১২:০০ এএম

বহু কাক্সিক্ষত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ঝুলে যাচ্ছে। কথিত ২৫ সিন্ডিকেটের আনাগোনায় দেশটির জনশিক্ত আমদানিকারক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো (সি গ্রেড) বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চেয়েছে। সিন্ডিকেটের আনাগোনা বন্ধ না হলে সি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বাংলাদেশ ব্যতীত অচিরেই অন্যান্য সোর্স কান্ট্রি থেকে শ্রমিক নেয়া শুরু করবে। এদিকে চলতি মাসেই নেপাল থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের সত্যায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল মালয়েশিয়ার সি গ্রেডের রিক্রুটিং এজেন্সির একজন স্বত্বাধিকারী এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

গত ১০ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতু সেরি এম সারাভানান আনুষ্ঠানিক এক চিঠিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদকে সমঝোতা স্বাক্ষরের জন্য আমন্ত্রণ জানান। জনশক্তি রফতানি সংক্রান্ত বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া এমওইউ চুক্তি স্বাক্ষরের সাড়ে ৩ মাস পেড়িয়ে গেলে ও নানা নাটকীয়তায় মালয়েশিয়ার কলিং ভিসার জট এখনো খুলেনি। বিগত ১৯ ডিসেম্বর কুয়ালালামপুরে এমওইইতে স্বাক্ষর করেন দেশটির পক্ষে মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান এবং বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন প্রবাসী মন্ত্রী ইমরান আহমদ। উল্লেখতি চুক্তিতে কোনো সিন্ডিকেটের নাম বা সংখ্যা উল্লেখ ছিল না। সিন্ডিকেট আর ননসিন্ডিকেট বেড়াজালে আঁটকে আছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।

জানা গেছে, এবারের সমঝোতা স্মারকে কিছু বিষয় পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জিটুজি প্লাস পদ্ধতি উল্লেখ থাকছে না, যুক্ত হচ্ছে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সি, কর্মীদের বাধ্যতামূলক বিমা থাকছে। আরও রয়েছে মালয়েশিয়ার সোশ্যাল সিকিরিটির আওতায় আজীবন সুবিধা পাওয়া। এছাড়া কর্মীদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা ও খরচ বহন করবে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান, চুক্তি মেয়াদেকর্মীদের দায়িত্ব নিতে হবে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সিকেও, বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮-৪৫ বছর পর্যন্ত। তবে কর্মীদের মালয়েশিয়া যেতে অভিবাসন ব্যয় বা খরচ কত হবে তা এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। চুক্তিসম্পন্ন হবার পর পরই একশ্রেণির দালাল চক্র গ্রামাঞ্চলের নিরীহ যুবকদের মালয়েশিয়ায় চাকরি দেয়ার নামে পাসপোর্ট ও টাকা সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছে। পরে বিএমইটির পক্ষ থেকে কাউকে টাকা-পয়সা ও পাসপোর্ট না দেয়ার জন্য সতর্ক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।

কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন কর্তৃপক্ষ দেশটির শ্রমবাজার চালু, প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের পাসপোর্ট সঙ্কট নিরসন এবং অবৈধ বাংলাদেশি কর্মীদের বৈধকরণের মেয়াদ বাড়ানোর ব্যাপারে কোনো ভূমিকার রাখতে পারেননি বলে জানা গেছে। মালয়েশিয়ার সারওয়াক থেকে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এতথ্য জানিয়েছে।

সরকারি সফরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ আজ রোববার যাচ্ছেন মালয়েশিয়ায়। দেশটির পুত্রাজায়ায় অনুষ্ঠিতব্য দু’দিন ব্যাপী সামরিক বাহিনীর সেমিনারে মন্ত্রী অংশ নেয়ার কথা। এরই ফাঁকে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানের সাথে সাক্ষাৎ করবেন বলে জানিয়েছেন কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্র। সাক্ষাতে এমওইউ চুক্তির বাস্তবায়ন ও প্রতিটি শ্রমিকে মালয়েশিয়া পৌঁছানো পর্যন্ত চূড়ান্ত ব্যয় নির্ধারণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হবার কথা। এদিকে, গতকাল কুয়ালালামপুর থেকে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান সরকারি সফরে বিদেশে অবস্থান করছেন। তাই এ যাত্রায় প্রবাসী মন্ত্রীর সাথে এম সারাভানানের সাক্ষাতের সম্ভাবনা নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, বৈশ্বিক করোনা মহামারির দু’বছর পর দেশটির বিভিন্ন খাতে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে ছয় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। পাসপোর্টের জন্য মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের মাঝে চলছে হাহাকার। পাসপোর্ট নবায়ন এবং নতুন পাসপোর্টের জন্য চার পাঁচ মাস আগে আবেদন করেও যথাসময়ে পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছে না অনেক প্রবাসী কর্মী। করোনার কারণে দেশটির পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্ট দেয়ার বিধান চালু করা হলেও অনেকেই এ প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট হাতে পেতে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে। ফলে মালয়েশিয়ার সরকারের দেয়া অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের বৈধতা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বৈধকরণের নিবন্ধনকৃত প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের চলতি মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত ফিঙ্গার দেয়ার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। কিন্ত যথাসময়ে পাসপোর্ট না পাওয়ায় অনেক কর্মীর বৈধতা লাভের বিষয়টি অনিশ্চয়তার দিকে গড়াচ্ছে। এ ব্যাপারে আরো ছয় মাস ফিঙ্গার দেয়ার সময় বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশনার গোলাম সরওয়ারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন কুয়ালালামপুরস্থ ভেস্ট মার্কেটিং এসডিএন বিএইচডি’র ডিরেক্টর রুহুল আমিন। সম্প্রতি সবুজ নামের এক প্রবাসী কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের নবায়নকৃত পাসপোর্ট আনতে গেলে পাসপোর্ট দেই দিচ্ছি বলে সারা দিন তাকে বসিয়ে রাখা হয়। সন্ধ্যার পর কাউন্টারে পাসপোর্ট চাইতে গেলে দু’জন কর্মচারী হাইকমিশনের ভেতরে সিসি ক্যামেরাবিহীন একটি কক্ষে সবুজকে ডেকে নিয়ে বেদম মারধোর করে তাড়িয়ে দেয়। পরে দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করে হাইকমিশনার গোলাম সরওয়ারের কাছে নালিশ দেয়া হলে তিনি সবুজের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তাকে সান্ত¦না দিয়ে বিদায় করেন। হাইকমিশনার অভিযুক্ত কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। এ ব্যাপারে গতকাল হাইকমিশনের শ্রম সচিব জহিরুল ইসলামের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। হাইকমিশনের প্রথম সচিব মিয়া মোহাম্মদ কেয়াম উদ্দিন গত ১৫ মার্চ এক সার্কুলারে ১৯ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত মাত্র চার দিন বিশেষ ব্যবস্থায় রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচিকে সামনে রেখে শুধু অনলাইনে আবেদনকৃত প্রবাসী কর্মীদের হাইকমিশন থেকে সরাসরি পাসপোর্ট ডেলিভারী নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি হামজাহ জয়নুদিন কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসী পরিষেবা বিভাগ স্যাটেলাইট সেন্টার উদ্বোধনকালে বলেন, রিক্যালেবাসি তিনাগা কিরজা কর্মসূচিতে ২ লাখ ৮০ হাজার ৮৮ জন অবৈধ অভিবাসী কর্মী নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। তিনি বলেন, দেশের প্রয়োজনীয় শ্রমের মাত্র ২০-৩০ শতাংশ পূরণ হলেও বাকি রইল ৭০ শতাংশ। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে রিক্যালিবাসি কর্মসূচি শুরু হয়েছে।

উল্লেখ, বিগত ১০ সিন্ডিকেটের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও নানা অনিয়মের দরুন ২০১৮ সালে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মাহথির মোহাম্মদ বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। গত ডিসেম্বর মাসে দু-দেশের মধ্যে এমওইউ চুক্তি স্বাক্ষর পর গত ২৩ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব প্রাইভেট এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সির সভাপতি দাতুক মেগাট ফাইরুজ জুনাইদির স্বাক্ষরিত একটি লেটার দাখিল করে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদের কাছে। সিসি হিসাবে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের হাইকমিশন গোলাম সারওয়ার, প্রথম সচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম এবং বায়রার সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান এর নাম উল্লেখ ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয় মেজর বড় ১০ সিন্ডিকেট ও বাংলাদেশের ২৫ সি ক্যাটাগরির লাইসেন্স সিন্ডিকেটের আন্ডারে মালয়েশিয়ার প্রাইভেট এমপ্লয়মেন্ট কাজ করতে রাজি নয়। এই সিন্ডিকেটের আন্ডারে শ্রমিক আসলে শ্রম আইন লঙ্ঘন ও শ্রমিক তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। মালয়েশিয়ার এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি আইন ১৯৮১ ধারা তুলে ধরা হয় তাতে। কোনোভাবেই আমরা ইন্টারেস্ট নয়। এ সিন্ডিকেটরাই ২০১৭-২০১৮ সালে সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। যদি বাংলাদেশে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের প্রাইভেট এজেন্সিগুলো এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শ্রমিক পাঠাতে চায়, তাহলে বাংলাদেশ সরকারের উচিত তাদের লাইসেন্স বাতিল করে আইনের আওতায় আনা। ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, যদি বাংলাদেশ সরকার ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে এই সমস্যা সহজে সমাধান হবার নয়। আমরা মালয়েশিয়া এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি ইন্টারেস্ট নয়, বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আনতে যতক্ষণ না সমস্যা সমাধান হচ্ছে। অতিসম্প্রতি প্রবাসী মন্ত্রী ইমরান আহমদ সাংবাদিকদের সাথে ঘোষণা দিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের আমি সিন্ডিকেটের পক্ষে নই বিপক্ষেও নই। আমি দেশ ও শ্রমিকদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে চাই।

এ দিকে বিদেশি কর্মী প্রবেশের মধ্যস্থতায় মালয়েশিয়ার ১ হাজার ৪০টি নিবন্ধিত সংস্থা করোনার মহামারির পরে অর্থনীতির অনেক খাত আবার চালু হওয়ার পরে দেশের সকল সেক্টরে শ্রমিকের গুরুতর ঘাটতি মেটাতে বিদেশি কর্মী নিয়োগে সরকারের উদ্যোগকে সময়োপযোগী বলে মনে করা হচ্ছে। ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব প্রাইভেট সার্ভিস অ্যাজেন্সিস মালয়েশিয়ার (পিএপিএসএমএ) মহাসচিব ড. সুকুমারন নায়ার বলেন, এ প্রচেষ্টায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এবং দেশে-বিদেশি কর্মীদের প্রবেশ ত্বরান্বিত করতে ১ হাজার ৪০টি বিদ্যমান নিবন্ধিত বিদেশি কর্মী নিয়োগকারী সংস্থাকে জড়িত করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে।

মালয়েশিয়ার কোম্পানি বা নিয়োগ কর্তারা খুব শিগগিরই সোর্স কান্ট্রিগুলো থেকে কলিং ভিসায় অনুমোদিত কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিটি সেক্টরে বিদেশি কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন জমা দিতে পারবেন বলে জানিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানান। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে মানবসম্পদ মন্ত্রী সারাভানান বলেছেন, খুব শিগগিরই মালয়েশিয়ার কোম্পানি বা মালিকদের কলিং ভিসায় বিদেশি কর্মী নিয়োগের জন্য অনলাইনে আবেদনের তারিখ ঘোষণা করা হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন