রমজান খুব নিকটেই কড়া নাড়ছে। সে প্রতিবার আসে আবার বিদায় নেয়। এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে। এই সময়ে বিজ্ঞজনেরা আজলা ভরে রহমত কুড়িয়ে নেন। চোখের লোনা জলে বুক ভাসিয়ে প্রভুর ক্ষমা প্রাপ্ত হন। নিজের সওয়াবের ভান্ডার পূর্ণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। নিজের ইবাদত গুলোকে আরো সুন্দর এবং পরিশুদ্ধ করে নেন। এভাবে পুরো মাস জুড়ে মাওলার প্রিয় হওয়ার সাধনা চলতে থাকে। রমজানের আগ থেকে তাদের প্রস্তুতি থাকে যেন একটু সময়ও অপচয় না হয়, বেখেয়াল আর গাফলতি পেয়ে না বসে। পুরো রমজানের ছক এঁকে নেন। আমি আপনিও কিন্তু চেষ্টা করলে পুরো রমজানের ইবাদত, সময় ব্যয়ের একটি পরিকল্পনা করে নিতে পারি। যদি আমি ক্ষমা লাভ করতে চাই, কল্যাণ লাভে ধন্য হতে চাই, ক্ষমা এবং জান্নাতের গ্যারান্টি পেতে চাই তাহলে আমার তাই করা উচিত।
পরিকল্পনা: রমজানে আমার লক্ষ্য কী, তা ঠিক করে নেওয়া। অবশ্যই আমি পুরো রমজানে সবগুলো রোজাই আদায় করব। এখন আমার টার্গেট ঠিক করা যে, এই উপবাস, এই ১৩-১৪ ঘন্টা, কোথাও ২০-২২ ঘন্টা উপোস থেকে আমি কী হতে চাই, কী পেতে চাই। এই চাওয়ার উপরই নির্ভর করবে আমার প্রস্তুতি, আমার অনুশীলন, আমার প্রাপ্তি। আমরা নিশ্চয় এই রোজাগুলো আদায় করে মহান রবের প্রিয়পাত্র হতে চাই। মহান রবের প্রিয় হওয়া মানব জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, সবচেয়ে বড় সফলতা। এই বড় প্রাপ্তির জন্য সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত, দৃঢ় মনোবল, কঠিন অনুশীলনের প্রয়োজন। কোন দামী সফলতা সহজে অর্জিত হয় না, হতে পারে না।
প্রস্তুতি: আমার রমজানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আগে ভাগেই প্রস্তুতি নিতে হবে। উপস্থিত মূহুর্তে প্রস্তুতি নিতে গেলে অনেক ত্রুটি, ফাক ফোকর থেকে যায়। আগে থেকে প্রস্তুতি নিলে, কোথায় কোথায় কী ঘাটতি আছে, তা বিশ্লেষণ করা যায়। ঘাটতি পূরণ করে সামনে আগানো সহজ হয়। এর মধ্যে নিজের গুনাহের কাজগুলো সংশোধন করার দৃঢ় এরাদা করা, ভাল কাজ বেশি বেশি করার সুদৃঢ় মনোবল চাঙ্গা করা, রমজানের মেহমান পবিত্র আল কোরআন অর্থ সহ কপি সংগ্রহ করা, কোরআন বুঝে পড়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। যে কাজগুলো ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আগে থেকে এগুলো ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি।
অনুশীলন: রমজানের রোজা সঠিকভাবে আদায়ের জন্য আগে ভাগেই মেহনত শুরু করা প্রয়োজন। সাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখা, রাত জেগে ইবাদাত করার অভ্যাস গড়ে তোলা, দানের হাত কে প্রসারিত করা। খেলোয়ার যত ভালই হোক না কেন মাঠে নামার কয়েকদিন আগ থেকে কঠোর অনুশীলন শুরু করে। অনুশীলন যত নিবিড় ও আকর্ষনীয় হয় প্রতিদন্ধীদের সাথে বিজয় তত সুনিশ্চিত হয়। কথায় আছে ঘাম সফলতা এনে দেয়। সেনাবাহিনীতে একটি কথা আছে, ঘাম রক্ত বাঁচায়। তাই অনুশীলন ভাল করুন আপনার আমার রোজাও সুন্দর থেকে সুন্দরতর হবে।
নামাজ হোক জীবন্ত: আমাদের ইবাদাত তথা আমাদের নামাজ একটু দায়সারা গোছের। নামাজ আদায় করতে হবে তাই করি। নামাজের প্রাণ আছে কি না তাই দেখার, চিন্তা করার, এসতেসাব করার সময় নেই। নামাজ যত সুন্দর হবে, অন্যান্য ইবাদত তত সুন্দর হবে। নামাজ হলো সকল ইবাদাদের প্রাণ। নামাজ মহান রবের সাথে বান্দার সরাসরি মোলাকাত। যার নামাজে মধুরতা আছে সে নামাজ সহ সকল ইবাদাতে স্বাদ অনুভব করে। মহান রবের সাথে নিবিড় ভাবে কথা বলে। নিজের মনের আকুতি কাকুতি বন্ধুর কাছে নিভৃতে পেশ করে। আমাদের নামাজ যেন মরা লাশ না হয়। নামাজকে জীবন্ত করি। প্রত্যেক নামাজের কেরাত, রুকু, সেজদা সহ সকল কাজ সুন্দর ভাবে মনোযোগের আদায় করি, আমার নামাজ জীবন্ত, প্রাণবন্ত হবে। এই নামাজ আমার জন্য মহান রবের মিরাজ হবে। আমার জীবন থেকে সকল পাপ পঙ্কিলতা দুর করে দেবে। আমার নামাজ আমার জন্য সফলতা বয়ে আনবে।
দোয়া হোক আবেগঘন: দোয়া মুমিনদের হাতিয়ার. মুমিনদের শক্তি। দোয়ার একজন মুমিন হৃদয়ে শান্তি অনুভব করে। তার সাহায্যের জন্য যাকে বলা প্রয়োজন, দোয়ার মাধ্যমে কেবল তাঁর কাছেই নিবেদন পেশ করে। এই দোয়া কবুল হয়ে গেলে দোয়াকারী মুমিন বান্দা হয়ে যায় অজেয়। তার শক্তি, হিম্মত কেউ ডিঙ্গাতে পারে না। ভয় নামক কোন শব্দ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। দোয়া মানেই নিজেকে মহান আল্লাহর নিকট সপে দেওয়া, তাই দোয়া সেরা ইবাদত। সকল ইবাদতের মূল বা নির্যাস। মহান রবের নিকট হাত উঠানোর সময় নিজেকে খুব দীনহীন ভাবে পেশ করা উচিত। নিজের আবেগ অনুভুতিকে শানিত করা উচিত। যেনতেন ভাবে মুখে বিড়বিড় করে কিছু বলা নয়। আবেগঘন আর দরদ পূর্ণ মন নিয়ে দোয়া করা উচিত। কেননা এই দোয়ার মধ্যেই রয়েছে আমার সফলতা। আমার দোয়া যত মধুময় হবে মহান রব তত খুশি হবেন। আমার দোয়া কবুল করবেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু বলেন, তিন প্রকার লোকের দোয়া ব্যর্থ হয় না। ১. রোজাদার ব্যক্তির ইফতারের সময়কার দোয়া ২. ন্যায় পরায়ন শাসকের দোয়া ৩. মজলুম ব্যক্তির দোয়া। আমার এই সময় খুব নিকটে যখন আমি রোজা রাখি। এই রমজানের সময়টাকে আমার দোয়ার সময় হিসেবে বেছে নেই। খুব ধ্যান ও খেয়ালের সাথে মাওলার নিকট আমার নিবেদন পেশ করি।
কোরআন হোক নিত্যসঙ্গী: রমজান মাস কোরআন নাজিলের মাস। কোরআনের বরকতে রমজান বরকতময়। কোরআনে সম্মানে রমজান মর্যাদাপূর্ণ। কোরআনের অক্ষর ছাপার কারণে এক টুকরো কাগজ চুমো খাওয়ার যোগ্য হয়ে যায়। কোরআনের গেলাফ হওয়ার কারনে এক খন্ড কাপড় অনেক দামী হয়ে যায়। কোরআন পড়ার রেহাল হওয়ার কারণে একটি কাঠের খন্ড অনেক দামী হয়ে যায়। আমি যদি কোরআনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পারি। আমার আপনার মর্যাদা মহান রবের নিকট কত হবে! একবার ভেবে দেখেছেন কি? মহান রব আমাকে আপনাকে ভালবাসবেন। মহান রবের ভালবাসা পেলে দুনিয়া এবং আগেরাতে আমার, আপনার চেয়ে আর কে বেশি সফলকাম হতে পারে!
সময়ের অপচয় রোধ: জীবন সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টার সমষ্টি। এই ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র সময়ই আমার জীবন। জীবনের একটি মুহুর্ত বেখেয়াল, অবহেলায় কাটিয়ে দেওয়া মানে এই সময়টা নষ্ট করে ফেলা। সে আর কখনো ফেরত আসবে না। এক একটি মুহুর্ত জীবনে একবারই আসে। প্রত্যেকটি দিন আগমন করে আমাকে আহবান করে তাকে ভালভাবে ব্যবহার করার জন্য। সে এও বলে দেয়, হিসাবের দিনেই কেবল সে আবার আমার সামনে হাজির হবে। যে ব্যক্তি সময়ের সদব্যবহার করে, দুনিয়ার জীবনে সে সফলতা পায়। আমার রমজান ৩০ দিনের হলে ২৫,৯২,০০০ সেকেন্ডের সমষ্টি। রমজানের চাঁদ উদিত হওয়ার সাথে সাথে তা কমতে শুরু করে। আমার কাছে রমজানের প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান। আমি, আপনি যদি হিসাব করে এই সেকেন্ডগুলো কাজে লাগাতে পারি, তবে আমি আপনি অবশ্যই সফল হতে পারব। একজন পরীক্ষার্থী যেমন প্রত্যেকটি সেকেন্ডের হিসাব রেখে উত্তর লিখতে থাকে। তেমনি আমার আপনারও এই মূল্যবান সময়ের যথাযথ কদর করে রোজা পালন করলে, এই বছরের রমজান আমার আপনার জীবনে এক ব্যতিক্রম রমজান মনে হবে এবং এক ব্যতিক্রম ফল বয়ে আনবে। তাই গল্প গোজব, আড্ডা, টিভি দেখা, ফেসবুক অনলাইনে সময় ব্যয়, অবসরে শুধু ঘুমানো, এখানে সেখানে ঘুরাফেরা করা ইত্যাদি কাজগুলো বর্জন করি। তবে আমার রমজান হবে প্রাণবন্ত।
দানের হাত প্রসারিত: রমজান গুনাহ মাফের মাফ, রমজান সওয়াব কামাই করার মাস। এই মাসে মহান রব যেমন খুব সহজেই একজন বান্দাকে মাফ করে দেন। তেমনি তার সাওয়াবও অনেক অনেক গুন বাড়িয়ে দেন। এই মাসেই বেশির ভাগ বিজয় অর্জিত হয়েছে। তাই এই মাস বিজয়েরও মাস। এই মাস শত্রুর সাথে বিজয়ের মাস। এই মাস নফসের সাথে বিজয়ের মাস। আবার এই মাস দানের মাস। এই মাসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরাইল আ: কে কোরআন শুনাতেন আবার জিবরাইল আঃ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোরআন তেলাওয়াত শুনাতেন এই সময়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতেন মুক্ত বায়ুর তুলনায় অধিক কল্যাণময় দানশীল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময়ই দানশীন ছিলেন। রমজান মাসে এই দান হত মুক্ত বায়ুর চেয়েও অধিক। আমরা রমজানে বেশি খাই, বেশি খরচ করি। কিন্তু দান সাদাকা সেই হারে বৃদ্ধি পায় না। আমাদের উচিত ভোগের চেয়ে বেশি ত্যাগী হওয়া।
কথা হোক কম: যখন আপনি আমি কথা কম বলব, তখন অনেক অনর্থক এমন কি ফাহেশা কথা থেকে বেঁচে যাব। জীবনের অনেক সময়ও বেঁচে যাবে। বেশি কথা বললে, গীবত, পরনিন্দা, মিথ্যা এ ধরণের অনেক কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতে পারে। যে সময় আমি অযথা গল্প কথায় লিপ্ত হব, এই সময়টাকে আমি কোরআন তেলাওয়াত, তাফসির অধ্যয়ন, হাদিস পাঠ, বিভিন্ন মাসনুন দোয়া, ইস্তেগফার, দরুদ শরীফ পাঠ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিখানো বিভিন্ন জিকিরে লিপ্ত হতে পারি। অনায়াসে অনেক বরকেতের ভাগিদার হতে পারি।
কাজে গতিময়তা: কাজ ছাড়া জীবন অচল, আমরা কেউ চাকুরী করি, কেউ ব্যবসা, কেউ কৃষিকাজ ইত্যাদি। এই রমজানে আমার কাজের সময়কে কমিয়ে আনি। কাজের গতি বাড়িয়ে দেই। কাজের গতি বাড়িয়ে কাজের সময়কে কমিয়ে আনি। এই বেঁচে যাওয়া সময়টিকে আমি ইবাদাত, কোরআন তেলাওয়াত, দরুদ, ইস্তেগফার পাঠে ব্যয় করি। তাহলে দেখা যাবে কাজের এই গতিময়তা পুরো বছর আমাকে বরকত দিবে। আমার অনেক সময় হাতে থাকবে, বিশেষ ভাবে মাওলাকে ডাকার জন্য আমার সময়ের অভাব হবে না।
স্যোসাল মিডিয়া বর্জন: রমজান মাস আমার জন্য আমার মহান রবের এক মহান উপহার। এই মাস সওয়াব কামাই করার মাস। এই মাস সোস্যাল নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকার মাস নয়। আপনার বিশেষ কোন প্রয়োজনে আপনি নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকতে পারেন। কিন্তু ফেসবুক, টুইটার, ইনস্ট্রাগ্রাম, ইউটিউভ ইত্যাদি মাধ্যমগুলো যথা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। আপনি হয়তো ভাল কিছু দেখতে চান, ভাল কিছু শুনতে চান। এই ভাল দেখার সাথে, ভাল শোনার সাথে কিছু খারাপও আপনার নজরে এসে যাবে। এই সময় আমি আপনি নেটওয়ার্ক হীন অন্য ইবাদাতে মশগুল হই। যার নেটওয়ার্ক আমার আর আমার রবের সাথে সংযোগ করে দিবে।
হালাল রিজিক তালাশ: আমার রিজিকের সাথে আমার ইবাদদের প্রাণ জড়িয়ে আছে। হারাম খেয়ে হারাম পরিধান করে কোন ইবাদাতই কবুল হয় না। দুনিয়ার স্বার্থে আমাদের হালাল হারামের চিন্তাও ভোতা হয়ে গেছে। কি কি কারণে আমার রিজিক হারাম হয়ে যায় নিজেরা একটু জানি এবং মানার চেষ্টা করি। আমার রিজিকে কোন ভেজাল থাকলে তা শোধরানোর চেষ্টা করি। তাহলে আমার ইবাদাতগুলো কবুলযোগ্য হবে।
চিন্ত ভাবনা: আমার শুধু উপোস থাকা নয়। অবশ্যই উপোস থাকব, সাথে রমজান নিয়ে চিন্তা করব, ইহতেসাব করব। তাহলে আমার রোজার ভুলগুলো শোধরাতে পারব। আমার রোজা মহান রবের নিকট পছন্দ হবে। রোজা সওয়াবতো ফেরেস্তারা চিন্তা করতে পারে না। ফেরেস্তাদের কলম রোজার প্রতিদানের পরিমাণ লিখতে অক্ষম। রোজা মহান মাওলার জন্য রাখা হয়, মহান রব নিজেই তার প্রতিদান দিবেন। সেই মহা প্রতিদান পেতে আমাকে অবশ্যই যত্নশীল হতে হবে। চোর ডাকাত যেন আমার এই পথে হানা দিতে না পারে। ঘরের মাল সামানা নিয়ে যাওয়ার জন্য সিধ কাটতে না পারে আমাকে সজাগ থাকতে হবে। তবে রোজার শেষে কল্যাণ, ক্ষমা আর বরকত আমার পায়ে এসে চুম্বন করবে। মহান রব আমাদের তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন