না রা য় ণ চ ন্দ্র রা য় : শীত ঋতুর সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। প্রতি বছর হেমন্তের যখন বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠে তখন শীতঋতু হি.. হি..... হা.... হা...... হো..... হো...... করে হাসতে হাসতে ঢুকে পড়ে বাংলার ঘরে ঘরে। ঘন কুয়াশার চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। চির-চেনা জিনিসও অচেনা মনে হয়। অতি আপনজনকেও চেনার কোন উপায় থাকে না। ঘন কুয়াশার ফোঁটাগুলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো টপ টপ করে পড়তে শুরু করে মাটি ও ঘাসের ওপর। শীতের তীব্রতা যেন আরও বেড়ে যায়। নানি-দাদি ও মায়ের হাতে বোনা কাঁথায় শীত মানতে চায় না। লেপ বা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমালে মুহূর্তেই শীত উবে যায়। কিন্তু গরিবের পক্ষে লেপ বা দামি কম্বল কেনার মতো পয়সা-কড়ি নেই। বেলা তিন মুঠো ডাল-ভাত যোগার করতে যেখানে তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় সেখানে আবার উচ্চ বিলাসি স্বপ্ন দেখার সুযোগ কোথায়? তাদের তখন একমাত্র সম্বল হয়ে ওঠে প্রকৃতিতে সহজে পাওয়া আউশ অথবা আমন ধানের নাড়া, খাল ও বিলের শুকনো কচুরিপনা, খড়-কুঁটো এবং হাজারো স্থানে সেলাই করা ছেঁড়া কাঁথা। সন্ধ্যায় ও রাতে এবং কখনো কখনো দিনের বেলায় ক্ষেতের নাড়া এবং খড়-কুঁটো এক জায়গায় জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়।
শীতকালে গ্রামে-গঞ্জে খালে-বিলে ও নদী-পুকুরে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। গ্রামগঞ্জে পাওয়া যায় সব ধরনের টাটকা শাক-সবজি। বছরের অন্য সময়ে যেখানে তরিতরকারির বাজার থাকে চড়া সেখানে শীতের সময় শাক-সবজির দাম সবার হাতের লাগালের মধ্যেই থাকে। আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। আমরা দুধে-ভাতে বাঙালি। শীতের এই সময়টাতে গ্রামের কৃষক পরিবারে। যেমন : কারেন্টজাল, ধর্মজাল, জাকিজাল, টেলাজাল, ডোল্লাজাল, বাঁশের তৈরি-পল এবং ওচা প্রভৃতি। গ্রামের কৃষক পরিবারে দুধেল গাভী থাকায় সারা বছরই দুধ-ভাত খাওয়া সহজ হয়। আমরা যে দুধে ও মাছে-ভাতে বাঙালি এখানেই তার সার্থকতা নিহিত।
গ্রামের মাঠে-প্রান্তরে উভয় ধারে সারি সারি খেঁজুর গাছ দেখতে পাওয়া যায়। গাছিরা বিকেল হলে খেঁজুর গাছে মাটির অথবা সিলভার ও প্লাস্টিকের হাঁড়ি বেঁধে রেখে আসেন এবং ভোর হলে আবার সেই হাঁড়িগুলো নিয়ে আসেন। নিজেদের খাবারের জন্য কিছু রেখে বাকি রসগুলো বাজারে বিক্রি করেন। খেজুরের রস একটি সুস্বাদু তরল পানীয়। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা পায়েশ ও মিষ্টান্ন খেতে খুব মজা। শীতের সকালে উঠনের মিষ্টি রোদে বসে নানা রকমের ভর্তা ও গরম গরম মাছ-ভাত এবং বাহারি রকমের পিঠা-পায়েশ খাওয়ার দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা কখনো ভুলে যাবার নয়। রাতে তীব্র শীত অনুভূত হয়। দিনের বেলায় সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। সূর্য মামার লুকোচুরি খেলা চলে প্রতিনিয়ত। তীব্র শীতে একটু গরম উষ্ণতা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা জানায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ।
শীতে সব চেয়ে বেশি কষ্ট করে ভূমিহীন শ্রেণির মানুষেরা। তাদের ঘর-বাড়ি এবং ঠিকানা না থাকায় পথের ধারে ফুটপাতে ঘুমাতে হয়। একদিকে শীতের তীব্রতা অন্যদিকে শীতের কাপড়ের জন্য হাহাকার। সত্যি এ যেন গরীবের দুর্বিষহ জীবন। ‘মানষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য’ এই সত্যকে মনে-প্রাণে উপলব্ধি করে সমাজের বিত্তবানদের পাশাপাশি আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে শীতার্ত মানুষের পাশে এগিয়ে আসা উচিত।
শীত ঋতুতে শহরের অলিতে-গলিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যস্ততম সড়ক মহাসড়কের বাসস্ট্যান্ডগুলোতে ও মার্কেটের সামনে বাহারি রকমের পিঠার পসরা সাজিয়ে বসে পড়েন পিঠা-দোকানিরা। বেচা-কেনাও ভালো হয়। শীতের পুরোটা সময় জুড়ে পিঠার দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে। গ্রামের কৃষক পরিবারে শীতের সময় পিঠা-পায়েশ খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। শহরে বসবাসরত গ্রামের নিকট আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, মেয়ে এবং মেয়ে-জামাইকে দাওয়াত করে হরেক রকমের পিঠা-পায়েশ খাওয়ানো হয়। পুরো শীত জুড়ে চলে ঘরে ঘরে পিঠা উৎসব। এ সময় গ্রামে ও শহরে আয়োজন করা হয় গান-বাজনা ও নাচ-গানের আসর। পাশাপাশি আয়োজন করা হয় নাটক ও যাত্রাপালা অনুষ্ঠানের। গভীর রাত পর্যন্ত চলে আনন্দ উল্লাস। আনন্দে মেতে উঠে ছেলে-বুড়ো সবাই। গ্রামের প্রাচীন কোন বটবৃক্ষের ছায়ায়, নদীর কূলঘেঁষে, স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণে এবং খোলা কোন জায়গায় আয়োজন করা হয় পৌষ মেলা।
নাগর দোলার উঠা-নামা এবং বাঁশির পেঁ..... পোঁ..... পেঁ...... পোঁ..... ছন্দ সুর বার বার ছোট বেলার কথাই মনে করিয়ে দেয়। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে লেপ-তোষক বানানোর হিড়িক পড়ে যায়। এ সময় লেপ-তোষক কারিগরদেরও ব্যস্ততা বেড়ে যায়। গরীব দুঃখিদের জন্য শীত কষ্টের হলেও এর আনন্দও কিন্তু কম নয়।
আনন্দ-বেদনার অবস্থান যেহেতু পাশাপাশি তাই আনন্দ যাবে, বেদনা আসবে। বেদনা যাবে, আনন্দ আসবে। এটাই প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম। শীতের হাসি আনন্দ বয়ে যাক সর্বত্র। ছড়িয়ে পড়–ক সবার ঘরে ঘরে। ‘সকলের তরে সকলে মোরা/প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।’ এটাই হউক আমাদের প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন