ইখতিয়ার উদ্দিন সাগর : বর্তমানে দেশে বোরকা ও হিজাবের বাজার ২ হাজার কোটি টাকার উপরে। আর বিশ্ববাজারেও বোরকা ও হিজাবের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তবে দেশে যে সব উন্নতমানের বোরকা ও হিজাব দেখা যায় তার সবই প্রায় পাকিস্তান, ইরানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে আসে। অথচ এ খাত থেকে উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিরও সুযোগ আছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা মনে করেন। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের টুপির ব্যাপক সুনাম আছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কেবল টুপি রপ্তানি করেই বছরে আয় হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। টুপির মতো বোরকা এবং হিজাব রপ্তানির মাধ্যমে ৫ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সব মিলিয়ে ইসলামী পোশাকের ব্যবসা অর্থনীতির একটি নতুন রপ্তানি পণ্যে পরিণত হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গবেষণা তথ্যের বিবেচনায় দেশে বোরকা ও হিজাব ব্যবহারকারী নারীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ। এ পোশাক বাবদ একজন নারী বছরে গড়ে ১ হাজার টাকা ব্যয় করলেও দেশে বোরকা ও হিজাবের বাজার দাঁড়ায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর ফলে দেশের বড় বড় শপিংমলগুলোতেও জমে উঠেছে এ ব্যবসা। এ ব্যবসার প্রসার অনলাইন শপগুলোতে বেশি বেড়েছে। এছাড়া বর্তমানে এ খাত লাভজনক ব্যবসার পরিচিতি পাওয়ায় বাংলাদেশে এখন বোরকা ও হিজাবের নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠছে। বিশেষ করে পুরনো ঢাকা, মোহাম্মদপুর, মগবাজার, মিরপুর ও সাভারে কারখানা গড়ে উঠেছে।
বিজিএমই’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বাজার আমরা এখনো ভালোভাবে ধরতে পারিনি। ফলে বোরকা ও হিজাব রপ্তানি করে আয় খুবই কম হচ্ছে। ওই বাজার বর্তমানে চীনের দখলে আছে, তবে রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। টুপি রপ্তানির আয় অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। দেশে বোরকা ও হিজাবের কারখানা তুলনামূলক কম থাকলেও রপ্তানি বেড়ে গেলে কারখানাও বেড়ে যাবে বলে তিনি জানান।
এছাড়া বোরকা ও হিজাবের ব্যবসা লাভজনক হয়ে উঠার কারণে বর্তমানে রাজধানীর অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে সব ধরনের এলাকায় দোকান গড়ে উঠেছে। রাজধানীর অভিজাত শপিংমল বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা যায়, এ মার্কেটে ৮০ টির মতো হিজাব ও বোরকার দোকান রয়েছে। বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সই শুধু নয়, রাজধানীর নিউমার্কেট, বায়তুল মোকাররম, এলিফ্যান্ট রোড ও কাঁটাবন এলাকায় প্রায় ২ শতাধিক হিজাব ও বোরকার দোকান রয়েছে। এ ছাড়া মগবাজার ওয়ারলেছে বেশ কিছু বোরকা ও হিজাবের শো-রুম রয়েছে। মৌচাক মার্কেটসহ হিজাব ও বোরকার শোরুম গড়ে উঠেছে গুলশান, বনানী ও উত্তরা এলাকায়ও। ফুটপাতের দোকানগুলোয়ও হিজাবের স্টল চোখে পড়ার মতো।
বর্তমানে দেশে শতাধিক ই-কমার্স সাইট রয়েছে। কিছু পোর্টাল রয়েছে, যেগুলোয় শুধু হিজাব ও বোরকা বিক্রি হয়। এছাড়া ফেসবুকভিত্তিক (এফ-কমার্স) সাইটও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হিজাব আইকন, হিজাব শপ, আহাম হিজাব কালেকশন ও হিজাব হাউজ। ই-কমার্স সাইটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আজকের ডিল, আবায়া ক্লদিং, সিনবাদ ডটকম ও ডিঅ্যান্ডজি।
জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সউদী আরব, দুবাই ও জর্ডান থেকে হিজাব ও বোরকা আমদানির পর স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। পোশাকটি আমদানি করা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও চীন থেকেও। চাহিদা বাড়ায় এখন স্থানীয়ভাবেও অনেকেই বোরকা তৈরি করছেন। একেকটি বোরকা সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
২০১২ সালে ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ সার্ভে’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, সুইজারল্যান্ডের উন্নয়ন সংস্থা এসডিসি ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। ওই গবেষণায়ও বাংলাদেশী তরুণীদের হিজাব ও বোরকায় ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি উঠে আসে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ মুসলিম তরুণীই হিজাব পরিধান করে। এদের অধিকাংশই হিজাবকে গুরুত্বপূর্ণ পোশাক মনে করেন। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য মতে, দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ বোরকা ও হিজাব পরিধান করছে। এর মধ্যে গ্রামীণ নারীদের প্রায় ৬০ শতাংশই পোশাকটি পরছেন। অঞ্চলভেদেও হিজাব-বোরকা পরার প্রবণতায় তারতম্য রয়েছে। বিশেষ করে সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় ৭০ শতাংশ নারীই বোরকা ও হিজাব পরিধান করেন।
বর্তমানে তরুণীরা কেন বোরকা ও হিজাব ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে? এই প্রশ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রীর সাথে কথা হলে তারা জানান, বর্তমানে এ পোশাকে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা রয়েছে, এই সাথে বর্তমান সময়কার বাজারে হিজাব ও বোরকার ডিজাইনে আধুনিক ফ্যাশনের ছোঁয়া লেগেছে। ফলে তরুণীদের মধ্যে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
নিউ মার্কেটের বোরকা বিক্রেতা খাইরুল ইসলাম জানান, ক্রেতাদের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে স্টাইলিশ ফ্যাশনেবল হিজাব ও বোরকা। এর মধ্যে রয়েছে কটি স্টাইল, অ্যারাবিয়ান স্টাইল, কাপতান, ওয়ান পার্ট, টু পার্ট, থ্রি পার্টসহ নানা ডিজাইনের বোরকা। হিজাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এমব্র্রয়ডারি হিজাব, ক্যাপ হিজাব, ম্যাক্সি হিজাব, গ্লিটার হিজাব ও জিগজ্যাগ গ্লিটার হিজাব।
এদিকে টুপি থেকে রপ্তানি আয় বাড়ার কারণে বাংলাদেশের গ্রামে ও শহরে টুপি তৈরির কারখানা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করে স্বাবলম্ব^ী হচ্ছে এ খাত থেকে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রফতানি আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে এখাত। ঢাকা, জিঞ্জিরা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীর বাবুরহাটসহ সারা দেশে প্রায় ৮ শতাধিক টুপির কারখানা গড়ে উঠেছে। ছোট কারখানার মালিক বছরে ১০ লাখ টাকার টুপি বিক্রি করে।
বর্তমানে ছোট কারখানাতেই শুধু নয়, গার্মেন্টেও টুপি তৈরী হচ্ছে। এমনই একটি কারখানা রাজধানীর পুরনো ঢাকার হরনাথ ঘোষ রোডে ‘আলিফ ক্যাপ গার্মেন্টস’। এ কারখানার টুপি রপ্তানি হচ্ছে শ্রীলঙ্কা, মরক্কো, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশে। আলিফ টুপির কারখানায় বছরে প্রায় ৬ লাখ টুপি বিদেশে রফতানি করে। তবে বাজারে তাদের টুপির চাহিদা প্রায় ১২ লাখ। বাংলাদেশের টুপির মান এবং ডিজাইন আকৃষ্ট করে বলেই হজের মৌসুমে সউদী আরবে আগত হাজীরা বাংলাদেশের টুপি ক্রয় করেন। আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, থাইল্যান্ড, কাতার, ওমান, মালয়েশিয়া, দুবাইয়ের হাজীরা বাংলাদেশী টুপির সবচেয়ে বড় ক্রেতা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক কর্তকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, বোরকা ও হিজাবের বাজার বিশ্বে ভালো থাকলেও দেশে উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম। উৎপাদন বাড়িয়ে বছরে রপ্তানির মাধ্যমে এ খাত থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। টুপি রপ্তানি ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের আরো গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
পুরনো ঢাকার টুপি ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম জানান, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একসময় এদেশের টুপির বাজারজাত হতো, কিন্তু নানা কারণে সে বাজার দখল করে নিচ্ছে চীন। প্রযুক্তিগত কারণে সে বাজার ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, তারা জানান, সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য হিসেবে টুপির চাহিদা কম নয়। সরকার প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিলে এ খাত থেকে প্রচুর আয় করা সম্ভব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন