শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বাড়ছে অনলাইন কেনাকাটা

আস্থা ফেরাতে সরকার-ইক্যাবের উদ্যোগ কঠোর মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ চায় গ্রাহকরা ষ নিবন্ধন ছাড়া ব্যবসা করতে পারবে না কোনো প্রতিষ্ঠান

ফারুক হোসাইন | প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০০ এএম

শখের বসে গড়ে উঠলেও বাংলাদেশে ঘরে বসে অনলাইনে পণ্য কেনাকাটা এখন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালে এটিই ছিল কেনাকাটার প্রধান মাধ্যম। সম্ভাবনাময় এবং হঠাৎ জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কারণে গোটা খাতটি এখন ভুগছে আস্থার সংকটে। প্রতারিত গ্রাহকরা অভিযোগ করার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। এরপর থেকেই আস্থার সঙ্কটে ভোগা খাতে গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে কাজ শুরু করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ই-কমার্স খাত সংশ্লিষ্টরা। এজন্য ইতোমধ্যে প্রতারিত গ্রাহকদের অর্থ ফেরত প্রদান, ই-কমার্স ব্যবসার জন্য নিবন্ধনসহ বেশ কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বৈধভাবে কাজ করছে কি না, কিংবা গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে কি না বা কোন অনিয়ম হচ্ছে কি না, সেটা আগে দেখা সম্ভব ছিল না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য। কিন্তু এখন আমরা তাদের কাজ ট্র্যাক করতে এবং মনিটর করতে পারবো।
আস্থা ফেরাতে সরকারকেও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করছে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে গ্রাহকদের পরিশোধ করতে পারে। কিংবা দায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাহলে পরবর্তীতে আর কেউ এমনটি করবে না।

ই-ক্যাবের সভাপতি শমী কায়সার ও সেক্রেটারি আব্দুল ওয়াহেদ তমাল গ্রাহকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নিজেদের আর্থিক নিরাপত্তার স্বার্থে অস্বাভাবিক অফার দেয়া পণ্য কেনাকাটায় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান ‘‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নিরর্দেশিকা ২০২১‘’ প্রতিপালন করছেনা সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা থেকে বিরত থাকার অনুরোধও করেন তারা। এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেয়ার পর কিউকমের ৫৯ কোটি টাকার মধ্যে ৫১ কোটি টাকা, আলেশা মার্টের ৪২ কোটির মধ্যে ২০ কোটি টাকা, ছোট ছোট আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৭৩ কোটি টাকার বেশি প্রতারিত হওয়া গ্রাহকদের ফেরত দেওয়া হয়েছে। আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত দিতে সম্মত হয়েছে বলেও জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ডিজিটাল কমার্স পলিসি, নিবন্ধন প্রক্রিয়া ও সরকারের হস্তক্ষেপের ফলে নতুন করে ফের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে ফিরতে শুরু করেছেন ক্রেতারা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই খাতে অস্থিরতা শুরুর পর ক্রেতারা অনলাইন কেনাকাটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে বেশ কিছু সিদ্ধান্তের পর থেকে বের বাড়তে শুরু করেছে কেনাকাটা। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠিত ও অস্থিরতার মধ্যে আস্থা ধরে রাখা বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এখন বাজারে জায়গা করে নিতে পেরেছে। এর মধ্যে অন্যতম বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান আলিবাবার বাণিজ্যিক অংশীদার দারাজ ডটকম, চালডাল, ফুডপান্ডা, পাঠাও ফুড, বিক্রয় ডটকমসহ আরও কয়েকটি।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে- দেশে ওয়েবভিত্তিক অনলাইন শপ আছে এক হাজার থেকে ১৩’শ এর মতো। ফেসবুকভিত্তিক আছে ১০ হাজারেরও বেশি। ফেসবুকভিত্তিক পেজগুলোর বাইরে শুধু ওয়েবসাইটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেই গত ১ বছরে ১ লাখেরও বেশি মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থান হয়েছে। আর ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইক্যাব) এর তথ্য অনুযায়ী, এই খাতে সারাদেশে গত কয়েকবছরে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষের। বছরে এখন অনলাইনে পণ্য বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার কোটি টাকার উপরে। গতবছর প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার পণ্য কেনাবেচা হয়েছে অনলাইনে। সাধারণ সময়ে প্রতিদিনই অনলাইনে ডেলিভারি দেয়া হয় ২০ হাজারের বেশি। আর এখন চাল-চালসহ নিত্যপণ্য বিক্রি করা অনলাইন প্রতিষ্ঠান চালডাল ডট কম একাই ডেলিভারি দিচ্ছে ১২ হাজারের বেশি অর্ডার। রমজানের শুরু থেকে আবারও রমজান ও ঈদের কারণে অনলাইনে পণ্যের অর্ডার ও ডেলিভারি তিন থেকে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো।

তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ই-কমার্স সেক্টরকে ২০২৫ সালে যে জায়গায় চিন্তা করা হচ্ছিল, করোনা পরিস্থিতি সেই জায়গায় ৫ বছর আগেই পৌঁছে দিয়েছে। এখন পাড়ার মুদি দোকান থেকে শুরু করে দেশের বড় বড় শপিং মলগুলোর দোকানদারও অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছেন। শহরের ধনী-শিক্ষিত মানুষ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষক-চাষীরাও শিখেছেন এই মাধ্যমে কেনাবেচা। আর করোনাকালে যেখানে অন্যসব সেক্টরের কর্মসংস্থানে অনিশ্চয়তা, ছাটাই হয়েছে সেখানে অনলাইন মার্কেটে চাকরি হয়েছে অনেকেরই। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা সম্ভাবনাময় খাতটিকে খাদের কিনারে ঠেলে দিয়েছিল। তারা মনে করেন সরকার কঠোর হলে প্রকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোই টিকে থাকবে।

চালডাল ডট কমের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জিয়া আশরাফ বলেন, করোনার পর থেকেই আমরা প্রচুর অর্ডার পাওয়া শুরু করেছি। ধীরে ধীরে আমরা সক্ষমতা বাড়িয়েছি। এখন ঢাকায় আমরা ১২ হাজার অর্ডার পর্যন্ত সার্ভ করতে পারি। এক বছরে আমাদের ক্যাপাসিটি অনেক বেড়েছে। তিনি বলেন, আমরা চাই মানুষ যেনো নিত্যপ্রয়োজনীয় যে কোন পণ্য চাইলেই ঘরে বসে নিতে পারেন।

ই-কমার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ ই-ক্যাবের প্রেসিডেন্ট শমী কায়সার বলেন, আমরা প্রকৃত ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের সামনে নিয়ে আসতে চাই এবং মন্দ ব্যবসায়িক কৌশল প্রয়োগের পথ খোলা রাখতে চাইনা। এ ব্যাপারে ই-ক্যাব সরকারের সাথে কাজ করছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। অভিযুক্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে নজরদারীতে রাখা হয়েছে।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ: ২০২১ সালে কাছাকাছি সময়ে ই-ভ্যালি এবং ই-অরেঞ্জসহ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সাথে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। ব্যাপক সংখ্যক অভিযোগের প্রেক্ষাপটে সরকার বিষয়টির দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়। সে সময় দেখা যায়, দেশে ই-কমার্স পরিচালনার কোন নীতিমালা ছিল না এবং ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের নিবন্ধনের ব্যবস্থাও ছিল না। এমন অবস্থায় গতবছর জুলাই মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসি-২০২০ নামে একটি নির্দেশিকা প্রণয়ন করে, যাতে অর্ডার নেয়া, ডেলিভারি এবং অর্থ পরিশোধ সংক্রান্ত নীতিমালা তুলে ধরা হয়।

ই-কমার্স খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও প্রতারণা ঠেকাতে সেপ্টেম্বর মাসে সরকার একটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেসময়ই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে এ খাতের উদ্যোক্তাদের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হবে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ফলে এখন থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে সকল কোম্পানিকে নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি ব্যবসায়িক পরিচিতি নম্বর নিতে হবে। এমনকি যারা সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে ব্যবসা করবেন তাদেরও এই আইডি লাগবে বৈধভাবে ব্যবসা করার জন্য। এর নাম দেয়া হয়েছে ডিজিটাল-কমার্স বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা ডিবিআইডি। এজন্য ডিবিআইডি নামে একটি অ্যাপ চালু করা হয়েছে বলে বলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, এই নিবন্ধনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর মাধ্যমে পরিচিতি নম্বর ধরে সরকার উদ্যোক্তার কর্মকাণ্ড ‹ট্র্যাক› করতে পারবে। তারা কে কী কাজ করছে তা সরকার জানত না। এখন আমরা তাদের কাজ ট্র্যাক করতে এবং মনিটর করতে পারবো।
শুরুতে এটি হবার কথা ছিল ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন বা ইউবিআইডি। কিন্তু পরে সেটি বদলে ডিবিআইডি করা হয়। তিনি কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ইউবিআইডি করার চিন্তা থেকে আপাতত আমরা সরে এসেছি। কারণ আমাদের অনেক ই-কমার্স উদ্যোক্তা আছেন যাদের ট্রেড লাইসেন্স নেই, কেউ আছেন যারা ফেসবুকে ছোট আকারে ব্যবসা করেন, তাদের ইউনিক বিজনেস আইডি দেয়া যেত না। সে কারণে সবাইকে যাতে আমরা সাধারণভাবে নিবন্ধন দিতে পারি সেজন্য এটিকে আরো সরল করে ডিবিআইডি করা হয়েছে।

নিবন্ধন নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, এখন থেকে কোন ই-কমার্স উদ্যোক্তার যদি ডিবিআইডি না থাকে তাহলে তাকে বৈধতার স্বীকৃতি দেবে না সরকার।

এদিকে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ই-কমার্সে আটকে থাকা গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, বিজ্ঞপ্তির পর শুনানি শেষে যেখানে যে টাকা আটকে আছে, তা গ্রাহকদের ওয়ালেটে রিফান্ড করা হবে। ই-ক্যাবকে সাতদিনের মধ্যে মার্চেন্টদের তালিকা দিতে বলা হয়েছে। তারা যদি তালিকা প্রোভাইড (সরবরাহ) না করেন, তাহলে গ্রাহকদের ওয়ালেটে টাকাগুলো ফেরত দেওয়া হবে।###

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
মাজহারুল ইসলাম ১১ এপ্রিল, ২০২২, ৭:০৬ এএম says : 0
প্রতারকদেরকে দূর করা গেলে অনলাইন কেনাকাটা্ আরও রাড়বে
Total Reply(0)
হাসান সোহাগ ১১ এপ্রিল, ২০২২, ৭:০৯ এএম says : 0
এখন থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে সকল কোম্পানিকে নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি ব্যবসায়িক পরিচিতি নম্বর নিতে হবে। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ
Total Reply(0)
ইলিয়াস ১১ এপ্রিল, ২০২২, ৭:২১ এএম says : 0
সরকারের নজরদারি বাড়লে মানুষের আস্থাও বাড়বে
Total Reply(0)
পলাশ ১১ এপ্রিল, ২০২২, ৭:২২ এএম says : 0
সরকারের উদ্যোগগুলো সত্যি প্রসংশনীয়
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন