রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে খুন, অপহরণ, ডাকাতি-দস্যুতা ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ আগের তুলনায় কিছুটা কমলেও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের ভয়াল বিস্তার। সীমান্ত পথে আসা মাদকের জোয়ারে ভাসছে পুরো চট্টগ্রাম। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাদকের ভয়াবহতা রোধে নানা কর্মসূচি নেয়া হলেও তাতে সুফল মিলছে না। গতকাল (রোববার) জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এমন তথ্য জানিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা কামনা করেন। কর্মকর্তারা জানান, অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মাদক চোরাচালানীদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়, বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় ১১ জন খুন হয়েছে। অপমৃত্যুর শিকার হয়েছেন ২১ জন। একই মাসে ৫টি ডাকাতি, ১০টি দস্যুতা, ৩১টি চুরির ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১০টি, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ৪২টি। অপহৃত হয়েছেন ৬ জন। গত ডিসেম্বর মাসের তুলনায় জানুয়ারীতে অপরাধ কম হয়েছে এবং কোন কোন অপরাধ আগের বছরের জানুয়ারী মাসের চেয়েও কমে গেছে। তবে নানামুখি উদ্যোগ নেয়ার পরও মাদকের বিস্তার কমছে না বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে ভয়ঙ্কর অপরাধের সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। পুলিশের হিসাবে গত বছর মহানগরীতে ৫টি ডাকাতি, ৬১টি দস্যুতা, ৬৭টি ছিনতাই ও ২৬২টি চুরি ঘটনা রেকর্ড হয়। ওই বছর খুন হয়েছেন ১০৫ জন, অপহৃত হন ৫১ জন। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৩৫৭টি। পুলিশের উপর হামলার ঘটনা ঘটে ৩০টি। তার আগের বছর নগরীতে ৫টি ডাকাতি, ৬৩টি দস্যুতা, ৩১০টি চুরি ও ৫২টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ওই বছর খুন হয়েছেন ১২০ জন, অপহৃত হন ৫৩ জন। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা রের্কড হয় ৩৮৭টি। পুলিশের উপর হামলার ঘটনা ঘটে ৩১টি।
চট্টগ্রাম জেলাসহ রেঞ্জের ১১ জেলায়ও ভয়ঙ্কর অপরাধের হার কিছুটা কমে আসছে। বিগত ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১৩৮টি ডাকাতি, ১৬৯টি দস্যুতা, ১৯৩টি ছিনতাই ৯৩৯টি চুরি ঘটনা রেকর্ড হয়। একই বছর রেঞ্জের ১১ জেলায় খুন হয়েছে ৭৯২ জন, অপহৃত হয়েছেন ১৫৯ জন। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৪ হাজার ২৪০টি। একই বছর দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা রেকর্ড হয় ৯টি আর পুলিশের উপর হামলার ঘটনা ঘটে ২২৪টি।
ওই বছরের তুলনায় গত বছর এসব অপরাধ কিছুটা কম হয়েছে। গেল ২০১৫ সালে ১০৭টি ডাকাতি, ১৩৩টি দস্যুতা, ১৫১টি ছিনতাই ও ৯০৮টি চুরির ঘটনা রের্কড হয়। একই বছর খুন হয়েছেন ৬৮৮ জন, অপহৃত হয়েছে ৯৮ জন। দাঙ্গার ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ২৮টি আর পুলিশের উপর হামলার ঘটনা ঘটে ১৬৩টি। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড হয় ৩৮৮৬টি। গত বছর বিভিন্ন অপরাধে মোট মামলা হয় ১৩ হাজার ৬১৮টি, আর আগের বছর (২০১৪) মামলার সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৫০৩টি।
নগর পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ভয়ঙ্কর অপরাধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মাদকের বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না। পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার নিয়মিত অভিযান সত্তে¡ও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের আগ্রাসন। বিশেষ করে ইয়াবা এবং ফেনসিডিলের জোয়ার কোনভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না। মিয়ানমার থেকে সাগর, পাহাড় ও সড়কপথে বানের পানির মতো ইয়াবার চালান আসছে। বড় বড় চালান ধরা পড়লেও বেশিরভাগ চালান নিরাপদে গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। ভারত থেকে আসছে ফেনসিডিল, গাঁজাসহ হরেক রকম মাদকদ্রব্য। সীমান্ত পথে আসা এসব মাদক ট্রেনে, বাসে চট্টগ্রাম আসছে। মহানগরী এবং জেলার সর্বত্রই এখন নেশার ছড়াছড়ি। অজপাড়াগাঁয়েও মিলছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, মদ, গাঁজা, হেরোইন। মাদকাসক্তের কারণে অপরাধ বাড়ছে, বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি। বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। শিশু-কিশোররাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাদক পাচারের সাথে শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত। এ সিন্ডিকেটে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য। চোরাকারবারীরা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। আর এ কারণে তাদের শক্ত নেটওয়ার্ক ভাঙা যাচ্ছে না। চোরাচালানী চক্রের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করা হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। আর এ কারণে অভিযানের মুখে কিছুটা নিষ্ক্রিয় হলেও অভিযান থেমে যাওয়ার পর আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে চোরাচালানী সিন্ডিকেট। মাদক চোরাচালানীরা এ অঞ্চলে তাদের শক্ত ভিত রচনা করেছে। বিমানযোগে আসা স্বর্ণের চালান চোরাচালানীর হাতে। মাদক ও আদম পাচারে বিনিময় হচ্ছে স্বর্ণের বার। ফলে দিনে দিনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে মাদক চোরাচালানীরা।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাদকবিরোধী নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। জানুয়ারি মাসে র্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে মাদকবিরোধী অভিযানে ৪৪১টি মামলা হয়। মাদকসহ গ্রেফতার করা হয় ৫১৫ জনকে। জানুয়ারি মাসে কোস্টগার্ড পূর্ব জোন ১ লাখ ১ হাজার ৭০০ পিস ইয়াবা, ৩১৬ বোতল বিদেশি মদ, ৯৫৫ ক্যান বিয়ারসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে। র্যাব-৭ চট্টগ্রামের উদ্যোগে জানুয়ারি মাসের অভিযানে ৩৮ লাখ ১৪ হাজার ৯৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। ফেনসিডিল উদ্ধার হয়েছে ২ হাজার ১০০ বোতল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ১৭ হাজার লিটার চোলাই মদ, ৩ হাজার ৮৮০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো উপঅঞ্চলের অভিযানে ধরা পড়ে ৪২ হাজার ইয়াবা, ১৬ বোতল বিলাতি মদ ও ৯ কেজি গাঁজা। চট্টগ্রাম কাস্টমসের উদ্যোগে ৯৪ বোতল বিদেশি মদ, ১১৫ কার্টন সিগারেট, ৪৩২ ক্যান বিয়ার উদ্ধার করা হয়। জেলা পুলিশের অভিযানে ২০ হাজার ৪৯৫ পিস ইয়াবা, ৬ কেজি গাঁজা, ৩ হাজার ১৮৯ লিটার চোলাই মদ উদ্ধার হয়। বিজিবির অভিযানে ১০০ বোতল ফেনসিডিল, ৩৭ বোতল কফ সিরাপ উদ্ধার করা হয়। টানা অভিযানে বিভিন্ন রকমের মাদকদ্রব্য উদ্ধার হলেও মাদক চোরাচালানীদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।
জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় সভাপতির বক্তব্যে মাদকের ভয়াল বিস্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করে জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন। মাদকের ভয়াবহতা বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সচেতনতা বাড়ানো, শাস্তি প্রদানসহ নানা পদেক্ষেপ নেয়ার পরও মাদকের ভয়াবহতা কমছে না। এজন্য জনপ্রতিনিধিদের আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।
এদিকে পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার সমালোচনার কারণে মাঠ পর্যায়ে পুলিশের কাজের ‘স্পিরিট’ কমছে উল্লেখ করে বলেন, এতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। হাফিজ আক্তার বলেন, সা¤প্রতিক সময়ে পুলিশের নানা সমালোচনা হচ্ছে। আমাদের কয়েকজন সদস্য এসব কর্মকাÐের সাথে যুক্ত। এক লাখ ৭১ হাজার সদস্যের মধ্যে দুই-চারজনের জন্য পুরো পুলিশ বাহিনীর বদনাম হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রতিদিনই থানা পর্যায়ে নিয়মের বাইরে না যাওয়ার জন্য পুলিশ সদস্যের নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে বলেও জানান পুলিশ সুপার।
ব্যাপক সমালোচনার কারণে মাঠ পর্যায়ে পুলিশদের কাজ করার স্পৃহা কমছে। আমি এতে ভীত। এরকম হলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। সে জন্যে পুলিশের সমালোচনার পাশাপাশি ভালো কাজেরও ইতিবাচক লেখনির জন্য সাংবাদিকদের সহযোগিতা চান তিনি। সভায় চট্টগ্রামের সাবির্ক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। অন্যান্যদের মধ্যে সভায় বক্তব্য রাখেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মমিনুর রশিদ, চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ, রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল প্রমুখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন