শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে

মো. সাজেদুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০২ এএম

আমাদের দেশে দিন দিন পলিথিনের ব্যবহার বেড়েই চলেছে, যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির দিকে। আশির দশকে প্রথম দেশের বাজারে পলিথিনের ব্যবহার শরু হয়। এখন পাইকারি বিক্রয়সহ প্রায় সব হাটবাজারেই অবাধে পলিথিন ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ সহজলভ্য ও এর দাম কম হওয়ায় দোকানিরাও যথেচ্ছভাবে সেগুলো ব্যবহার করে চলেছেন। একবার ব্যবহারের পর সেগুলো যত্রতত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে। অপচনশীল সর্বনাশা পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ভরাট হচ্ছে নগর-মহানগরের পয়ঃনিষ্কাশনের নালা-নর্দমা। ভেঙ্গে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পলিথিন বর্জ্যের কারণে বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ। ভরাট হচ্ছে খাল-বিল-নদী, দূষিত হচ্ছে পানি। পলিথিন খাল-বিল, নদী-নালায় জমা হয়ে তলদেশ ভরাট করে ফেলে। নাব্য নষ্ট হওয়ায় নৌপরিবহনে বিঘœ ঘটে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হয়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ পানিবদ্ধতা। দুর্ভোগের শিকার হয় নগরবাসী।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর ড্রেনেজ সিস্টেমে জ্যাম লাগিয়ে রাখা আবর্জনাগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ পলিথিন। পলিথিনের কারণে অন্য সব আবর্জনা জট পাকিয়ে থাকে। অপচনশীল পলিথিন যেখানে সেখানে ফেলায় তা বহুবছর কোনো না কোনো ড্রেনে গিয়ে আটকে থাকে কিংবা বুড়িগঙ্গানদীসহ আশপাশের কোনো জলাশয়ে গিয়ে জমে থাকে। এ কারণেই পলিথিন বর্জ্যে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের জলাশয়গুলো ভয়াবহ দূষণের শিকার।

রাস্তাঘাটে স্তূপ হয়ে জমে থাকা পলিথিন অনেক সময় পোড়ানো হয়ে থাকে। পলিথিন তৈরির চেয়ে আরও ভয়াবহ ক্ষতিকর হচ্ছে পুরনো পলিথিন পুড়িয়ে এর থেকে আবার নতুন পলিথিন তৈরি করা। এই পোড়া পলিথিন থেকেও ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ হয়। পলিথিন পোড়ালে এর উপাদান পলিফিনাইল ক্লোরাইড পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়ে বাতাস দূষিত হয়। এতে করে বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করে।

পলিথিন তৈরি হয় বিদেশ থেকে আনা অনেকটা সাবুদানার মতো গ্রানিউল নামক পদার্থ দিয়ে। পলিথিন রাসায়নিক তন্তুজাত দ্রব্য। অত্যন্ত বিষাক্ত ও ক্ষতিকর প্রোপাইলিনের সঙ্গে পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বনের তিন/চারটি মলিকুলের সংমিশ্রণে পলিথিন তৈরি হয়। পলিথিন এমন এক আনস্যাচুরেটেড কম্পাউন্ড, যার অনুগুলো ব্যাগ, ব্যাগ জাতীয় উপাদান তৈরির পরও কিছু কিছু বাহু মুক্ত অবস্থায় থেকে যায়। পলিব্যাগে বহন করা এবং পলিব্যাগে রাখা বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য মুক্ত অবস্থায় থাকা বাহুগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায়। প্রতিদিন এই বিষ অল্প করে শরীরে প্রবেশ করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিথিন থেকে নির্গত হয় বিষফেনোল নামক বিষাক্ত পদার্থ, যা মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। পলিথিন ব্যাপক ব্যবহার ও যত্রতত্র ফেলে দেয়ায় সারাদেশে রাস্তা-ঘাট ও খাল-বিল-নদী-নালা থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে পলিথিনের বিষক্রিয়া। মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এসব জলাশয়ের মাছের মাধ্যমে দূষণ মানবদেহে প্রবেশ করছে। ফলে চর্মরোগসহ ক্যান্সার পর্যন্ত হচ্ছে। সেসঙ্গে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র। ‘নরডল’ নামক এক প্রকার পলিথিন বর্জ্য সমুদ্রের পানিতে মিশে যাওয়ায় সামুদ্রিক জীববৈচিত্রæ হুমকির মুখে পড়ছে।

তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে পলিথিন ব্যাগকে চর্মরোগের এজেন্ট বলা হয়। এছাড়া পলিথিনে মাছ, মাংস মুড়িয়ে রাখলে এতে রেডিয়েশন তৈরি হয়ে খাবার বিষাক্ত হয়। পলিথিনের ব্যবহার সাগরে থাকা প্রাণ বা পরিবেশকেই শুধু হুমকিতে ফেলছে না, এটা মানবদেহের হরমোনের কার্যক্রমকেও বাধাগ্রস্ত করে। পলিথিন বন্ধ্যাত্বসহ গর্ভবতী মায়ের ভ্রæণ নষ্ট এবং কিডনি বিকল করে দিতে পারে। এছাড়া রঙিন পলিথিন জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর। এ থেকে নির্গত ক্যাডমিয়াম শিশুদের হাড়ের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। পলিথিন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গ্রীন হাউস গ্যাস নিসৃত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এছাড়া পলিথিনের প্রভাবে মানুষের প্রজনন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে দৈনিক গড়ে প্রায় ছয় হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। প্রতিবছর প্রায় ১৮ শতাংশ হারে বাড়ছে বর্জ্য। বিশাল এই বর্জ্যের বড় একটি অংশ হচ্ছে পলিথিন। পলিথিন দীর্ঘদিন ধরে মাটিতে পড়ে থাকলেও পচে না। অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় এর পরিত্যক্ত অংশ দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত ও অবিকৃত থেকে মাটি ও পানিকে দূষিত করে। মাটির ঊর্বরতা হ্রাস ও গুণাগুণ পরিবর্তন করে। কৃষিক্ষেত্রে পলিথিন সূর্যের আলো ফসলের গোড়ায় পোঁছতে বাধা দেয়। ফলে মাটির ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া না মারা যাওয়ায় জমিতে উৎপাদন কমছে।

পরিবেশবিদদের মতে, ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় পলিথিন তৈরিতে। পলিথিন মাটির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পচনশীল না হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করে সব ধরনের চাষাবাদে। পলিথিন মাটির অভ্যন্তরে চলে যাওয়ার ফলে মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। মাটির নিচেও তা পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে, মাটির গুণগত মান ও ঊর্বরতা হ্রাস পাওয়ায় শস্যের উৎপাদন কমে যায়। মাটির নিচের পলিথিনের কারণে গাছ খাবার পায় না। এ কারণে গাছ কম আক্সিজেনের উৎপাদন করায় বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড, সীসা এসবের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অক্সিজেনের স্বল্পতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে হাঁপানি কিংবা শ্বাসরোগ বেড়ে যায়।
পলিথিনের ভয়ানক ক্ষতির দিক চিন্তা করেই ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে এবং একই বছরের ১ মার্চ থেকে সারাদেশে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। ২০০২ সালে সরকার আইন করে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ৬ (ক) ধারাটি সংযোজন করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে, তাহলে ১০ বছরের কারাদÐ বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দÐও হতে পারে।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের সেই গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই আশার সঞ্চার করেছিলো। সেই বিকল্প হিসাবে পাটের তৈরি সামগ্রীর দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়তে শুরু করেছিলো, কাগজের তৈরি ঠোঙার ব্যবহারও বেড়ে গিয়েছিলো। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পলিথিনের ব্যবহার ধীরে ধীরে আবারও বাড়তে শুরু করে। ফলে ২০১০ সালে সরকার দ্বিতীয়বারের মতো বাজারে পলিথিন বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো। সেসময় ১৭টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যদিও এ জন্য অল্পকিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়। পলিথিন দমনে পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত চার হাজার ৭৮৭টি মামলা দিয়েছেন। এসব মামলায় অনেককে বড় অঙ্কের জরিমানাও করা হয়, অনেক পলিথিন জব্দও করা হয়।

পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই পলিথিনবিরোধী অভিযান চালানো হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হলো নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন এবং বাজারজাতকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কারখানা বন্ধ করার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ পলিথিন জব্দও করা হয়। কিন্তু এতোকিছুর পরও থেমে নেই পলিথিনের আগ্রাসন।

পলিথিনের বিকল্প হিসেবে চট ও কাগজের ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে হবে। পলিথিনের ক্ষতিকর দিক থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। এ বিষয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সাবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে, সোচ্চার হতে হবে।
লেখক: চিফ রিপোর্টার, উইকলি সিটিজেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন