বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বইয়ের পাঠক তৈরি করতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৯ এএম

ছোটবেলা থেকেই আমি বই পড়তাম। আমার জš§দাত্রী মার অবর্তমানে বই পড়ার এ নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন আমার এক বড় বোন। পড়াতে কোনো বাছবিচার ছিল না। সব ধরনের বই পড়ারই আমার আগ্রহ ও অধিকার ছিল। মহাকবি ইকবাল যেমন প্রচুর কাঁদিয়েছেন, তেমনি কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় দাঁত ভাঙ্গার উপক্রম করেছিলেন। আর কবি ফররুখ আহমদ তো জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বিদ্যমান। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস প্রচুর বই পড়া হয়ে যেত বাড়িতেই। জমা হতো প্রচুর ম্যাগাজিন, পত্র-পত্রিকা। যেমন পয়গাম, আজাদ, ইত্তেফাক, দেশ, উল্টোরথ, রিডার ডাইজেস্ট ইত্যাদি। এগুলোর সবই আদ্যপান্ত পড়ে নিতে পারতাম স্বল্প সময়ের ভিতরেই। ঘরে অন্যদের সঙ্গে এসব নিয়ে দস্তুরমত মাতামাতি চলত। এক নিঃশ্বাসে সবই না পড়লে স্বস্তি হতো না। সে ট্র্যাডিশন এখনও চলছে সমান তালে।

এক সময় পড়ার মাধ্যমে সমরেশ বসু, সৈয়দ মুজতবা আলী, মীর মোশাররফ হোসেন, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম, মৌলানা তাহের একেবারে আপন হয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া বঙ্গ সাহিত্যের বিবিধ রতন মনে ছাঁচ গেঁথে দিয়েছেন তাদের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, সমালোচনায়। ইংরেজিতেও দৌড় কম ছিল না। চার্লস, শেক্সপিয়ার, শেলী, বায়রন এমন স্বল্প সংখ্যক লেখকের লেখা পুস্তকাদি পড়ার ও বুঝার চেষ্টা করেছি। উর্দু ও অন্য ভাষার বইপত্রের প্রতিও আকর্ষণ কম ছিল না, যদিও খুব একটা সুবিধা করতে পারিনি এসব বিষয়ে। তবে এটা ঠিক, সব মিলে বই, পত্রপত্রিকা পড়ার একটা মন তৈরি হয়েছে আমার সে ছোটকাল থেকেই। ভূমিকাটি হয়তো কিছুটা লম্বা হয়ে গেল। আসলে বলতে চেয়েছিলাম বই পড়ার আনন্দের কথা। যারা পড়েন তারা অবশ্য ভালভাবেই এ আনন্দের কথা অনুধাবন করতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস।

আজকের দিনে পাঠক কমে গেছে। এ আক্ষেপ সবার। প্রকাশক, লেখক, গ্রন্থপ্রণেতা, বিক্রেতা, প্রত্যেকের অনুযোগ পাঠক হ্রাস পাওয়ার ব্যাপারে। তবে কি নব প্রজন্ম উদাসীন বই পড়ার ব্যাপারে? বিষয়টি চিন্তনীয়। আজ বাজারে রাশি রাশি বই, ঘনঘন বই মেলা, কত উপহার সংবলিত ম্যাগাজিন তবুও পাঠক কম। কেমন যেন মনে হয়। ভালো ছাপা, ভালো কাগজ, ভালো লেখা, সুন্দর ঝকঝকে অফসেটে, তবুও পাঠকের অভাব। এটা বিস্ময়ের ব্যাপার।

আমাকে কেউ বই উপহার দিলে খুব খুশি হই। নিজেও আমার নিজের বা পরের লেখা বই কাউকে উপহার দিয়ে আনন্দ পাই। ভাবি, একটা বই-ই-তো দিলাম, তাতো পড়বে কিছু লোক। এক সময় বই উপহার দেয়াটা খুব গর্বের ব্যাপার ছিল। অথচ আজকাল বিশেষ করে বিয়ে-সাদীতে বই উপহার দিলে অনেকে অখুশি হন। অনেকেরই মুখে শুনা যায়, গিফট আইটেম বা ব্যবহারী জিনিস না দিয়ে বই দিলে এগুলো আবার কে পড়ে আর কে দেখে। রাখার জায়গাই বা কোথায়? কী যে রুচি! এ ধরনের মন্তব্য আজকাল মোটেই দুর্লভ নয়। অন্ততঃ আমাদের প্রায়ই শুনতে হয় এ জাতীয় কথা।

তবে এটাও ঠিক যে, এ প্রজšে§র একাংশ ভালো পাঠক আছে। কিছু আছে যারা ভালো বই পড়ে, অন্যকেও পড়ায়। একাংশ আছে ট্যাঁশ, কেচ্ছা জাতীয় বই পড়ে আনন্দ পায়। আমি কিন্তু ভালো বই পেলে সময় বের করে বসে যাই পড়ার টেবিলে। এ রকম একজন ভালো পাঠক প্রাক্তন মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ আবুল মাল আবদুল মুহিত। বইয়ের পোকা। বয়সে প্রবীণ কিন্তু মনে প্রাণে বইয়ের পাঠক। একদিন ঢাকা যাত্রাকালে সিলেট বিমানবন্দরে আমার সাথে দেখা। আমিও একই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলাম। আমার সদ্য প্রকাশিত একটি বইয়ের কপি তার হাতে তুলে দিতেই তিনি একের পর এক পাতা উল্টিয়ে দেখতে শুরু করলেন। ঐ দিন ফ্লাইট বিলম্বজনিত কারণে বইটি তাঁর খুব উপকারে এসেছে বলে আমি মনে করলাম। কারণ, তিনি যতক্ষণ বিমান বন্দরে বসেছিলেন কারো সঙ্গে কোনো কথাবার্তা না বলে শুধু বইটি পড়ছিলেন। মাঝেমধ্যে তাঁর ঠোঁটে ও মুখে হাঁসিও দেখা গিয়েছিল। আমার ধারণা, হয়তবা বইতে তিনি নতুন কিছু পেয়ে থাকতে পারেন, যা তাঁকে কিছুটা হলেও আনন্দ দিয়েছে। অবশ্য আমার আগের লেখা বইগুলো পড়ে তিনি বেশ প্রশংসা করেছিলেন, আমিও তাতে অনুপ্রাণিত হয়েছি। একটি জাতীয় দৈনিকে তিনি কিছু লিখেছিলেনও আমার লেখালেখির ব্যাপারে।

আমার এক বন্ধু উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা। কোনো এক মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করে অবসরে গেছেন ক’মাস পূর্বে। তিনি সৈয়দ মুজতবা আলীর খুব ভক্ত। তাঁর রচনাবলী দিয়ে সচিব মহোদয়ের দিনের পড়া শুরু হয়। সকালে গোসল তারপর প্রাতঃরাশ এবং খবরের কাগজ। এরপর অফিস। অফিস শেষে বাসায় ফিরে অন্ততঃ খাওয়া দাওয়ার পর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে হাঁটতে বের হন। ২/৩ বা ৪ মাইল হাঁটাহাটি করে বাসায় ফিরে মাগরীবের নামাজ আদায় করে বই হাতে নেন। পড়ার টেবিলে বসে টিভির সংবাদ দেখেন আর বই পড়তে থাকেন। বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা কম। বই-ই তার নিত্য সঙ্গী। বইয়ের পোকা কাউকে পেলে বই নিয়ে আলোচনা করেন। মাঝেমধ্যে কাঁচা বাজারে যান তরী-তরকারী, মাছ-মাংসের সাথে বই, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন ক্রয় করে নিয়ে আসেন। তার সহধর্মিনী শেফালীও বই পড়েন প্রচুর এবং পড়ে তা মনে রাখার চেষ্টা করেন। মাঝেমধ্যে প্রসঙ্গ টেনে কথা বলেন। এমন পাঠক দুর্লভ। এদের সঙ্গে বসলে সময় কোন দিকে বয়ে যায় বুঝাই যায় না।


আমি আরও বেশ ক’জন পাঠকের সাথে কথা বলেছি, ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি, তাদের মধ্যে হায়দার খান, লে. কর্নেল আলী আহমদ, মুক্তাবিস উন নূর, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, রাগীব হোসেন চৌধুরী, ড. নাজমানারা খানুম, আব্দুল হামিদ মানিক, ইসমত হানিফা চৌধুরী এরা ভীষণ পাঠক। বইয়ের পোকা বলা চলে কবি আশরাফ আলম ও হাফিজুর রহমান ভুইয়া এবং অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আসহাব উদ্দিনকে, বাংলা ও ইংরেজি দু’ভাষাতেই সাবলীল। দারুণ পাঠক।

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ব্যস্ততা সবারই বাড়ছে। আর হয়তোবা এ কারণেই পাঠকের সংখ্যা অভাবনীয়ভাবে কমে আসছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়, নিশ্চয়ই। অনেকের মধ্যে আজকাল বই পড়ার চরম অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বই এর দোকানে টেক্সটবুক, রেফারেন্স বুক, নোট বুকের বেশ ক্রেতা আছেন। কিন্তু গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস কবিতার বই বেশিরভাগই পড়ে থাকে বইয়ের দোকানে। আর তা ধুলো বালুতে মলিন হয়। অবশ্য বিতর্কিত বইয়ের ব্যাপার ভিন্ন। এসব বই কাটে ভালো।

আজকাল লোকে যেমন বই কম পড়েন, তেমনি উপহারও দেন কম। এমন কথা প্রায়ই শুনা যায়, আজকাল বই কেউ আর পড়ে না, তাহলে দিয়ে লাভ কী? এর চাইতে অন্য কোনো গিফট আইটেম দেওয়াই ভালো, স্ট্যাটাসও বাড়বে। আবার কেউ কেউ বলেন বইয়ের ‘এত দাম’, দিয়ে পোষায় না। অথচ, বাস্তবে একশত টাকা দিয়ে একটা ভালো বই বাজারে দুর্লভ নয়। আসলে রুচির পরিবর্তন। এটা কিন্তু শুভলক্ষণ নয়, বর্তমান সামাজিক পরিবেশে।
‘বই ভালো বন্ধু’ এ শ্লোগানের মাধ্যমে পাঠক তৈরি করা যায়। একজন পাঠক তৈরি করতে পারেন একাধিক পাঠক। সুপরিকল্পিতভাবে ধাপে ধাপে নতুন পাঠকের মাঝে বই পড়ার নেশা একবার তৈরি করে দিতে পারলেই হয়। একখানা বই পড়ে একাধিক লোক যদি তা নিয়ে আলোচনা করেন, তবে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। এতে করে বেশ কিছু ভালো পাঠক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আজকের দিনে সময়ের অভাব, এ দোহাই অনেকে দিতে পারেন। তবুও দিনের চরম ব্যস্ততার মধ্যে কিছু সময় যদি অন্তত কয়েক পাতা করে পড়া যায়, তবে কিছুদিন পর বই পড়ার সময় এমনিতেই বেরিয়ে আসবে। সময় পেতে কষ্ট হবে না।

বিভিন্ন পাড়া মহল্লা বা ক্লাবে লাইব্রেরি আছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারাও চেষ্টা করলে বই পড়ার এবং পাঠক সৃষ্টি করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমরা নিজেরা যদি একে অপরকে বই উপহার দিতে থাকি তাহলে বিলম্বে হলেও পাঠকের সংখ্যা বাড়বে। এটা এক নীরব আন্দোলন, যার ফলাফল অতিশয় শুভ। আমি মাঝেমধ্যে বন্ধু-বান্ধবদের বিশেষ করে যারা প্রবাসে থাকেন তাদেরকে বই পাঠিয়ে থাকি। এর মধ্যে আমার লেখা ক’টা বইও থাকে। আবার আমাকে কেউ বই ও বিদেশি পত্রপত্রিকা উপহার দিলে যারপর নাই খুশি হই। ভালো কোনো কিছু পড়লে অন্যকে বলি। জানি, কেউ পছন্দ করে থাকেন, কেউ পছন্দ করেন না, তবুও বলি আশাবাদী হয়ে। আমার বিশ্বাস, এভাবে পাঠক শ্রেণি গড়ে উঠবে। এভাবেই মন তৈরি হবে। পৃথিবী হবে মানুষের বসবাসযোগ্য। আজকের হানাহানি, হিংসা, দ্বেষ, লোভ ও ভোগবাদে আক্রান্ত সমাজে স্থিরতা, শান্তি ও প্রগতির বার্তা মানবতার উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যে ভালো বইয়ের পাঠক তৈরি করাটা অত্যন্ত প্রয়োজন এবং সময়োপযোগী।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন