শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে করণীয়

প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাওলানা আব্দুল্লাহ আল হাদী

॥ এক ॥
আধুনিক আরবীতে সন্ত্রাসবাদকে ইরহাব বলা হয়। পবিত্র কোরআনে সন্ত্রাসবাদকে বুঝাতে গিয়ে ফাসাদ, ফিতনা, মুফসীদুন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইংরেজীতে টেরোরিজমের বাংলা সন্ত্রাসবাদ। সন্ত্রাসের ইংরেজী প্রতিশব্দ ঞবৎৎড়ৎ। যারা সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করে তাদেরকে বলা হয় ঞবৎৎড়ৎরংঃ। সন্ত্রাস শব্দটির উৎপত্তি ত্রাস শব্দ থেকে। ত্রাস হচ্ছে, ভয়-ভীতি, আতংক ও ভীতিকর অবস্থা।
সন্ত্রাসের অর্থ হলো, অবৈধ ও অনৈতিকভাবে ত্রাস ও বিপর্যয় সৃষ্টির মাধ্যমে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় শৃংখলাকে বিনষ্ট করা। যে কোন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃতি হিংস্বাত্মক ত্রাসজনক পথ বেছে নেয়া। বোমাবাজ, জঙ্গীবাদ বিস্তার, যৌতুক আদায়, নারী নির্যাতন, নারী ও শিশু পাচার, হত্যা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, রাহাজানী, অগ্নি-সংযোগ, জবরদখল, হয়রানি প্রভৃতি সন্ত্রাসের পর্যায়ভুক্ত। পবিত্র কোরআনের পরিভাষায় সন্ত্রাসীদেরকে বলা হয় মফসীদুন। যে সব লোক সন্ত্রাস হয়ে পথে-ঘাটে, ঘর-বাড়িতে, নদ-নদীতে, মরুভূমিতে নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা চালায় এবং প্রকাশ্যে জনগণের জান-মাল হরণ করে তাদেরকেই সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
সন্ত্রাসের সূচনা হয় বিশ্বের প্রথম মানব হযরত আদম (আ.)-এর সন্তান কাবীলের মাধ্যমে নিছক ব্যক্তি স্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে শয়তানের ধোকায় স্বীয় সহোদরকে হত্যা করে পৃথিবীর বুকে সন্ত্রাসের সূচনা করে।- (সূরা- মায়িদা-৩০)
রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা সন্ত্রাসের মূল উৎস। সন্ত্রাস হচ্ছে ত্রাস ও নৈরাজ্যের মাধ্যমে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করা ও মানুষ হত্যা করা। সন্ত্রাস সম্পূর্ণভাবে ইসলাম বিরোধী তথা মানবতা বিরোধী কাজ। বর্তমান বিশ্বের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ একটি প্রধান সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় সমস্যা। সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে নিজেরদেরকে সমাজে শান্তি স্থাপনকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এদের সম্পর্কে সূরা বাকারার ১১ নং আয়াতে বলা হয়েছে- তাদেরকে যখন বলা হয় পৃথিবীতে অশান্তি সন্ত্রাস সৃষ্টি করো না, তারা বলে আমরাইতো শান্তি স্থাপনকারী।
সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন- দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর সেখানে বিপর্যয় বা সন্ত্রাস সৃষ্টি করো না।- (সূরা আরাফ, আয়াত- ৫৬)
যখন সন্ত্রাসী প্রস্থান করে তখন দুনিয়া অশান্তি বা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে এবং শস্যক্ষেত্র ও জীব জন্তুর বংশ নিপাতের চেষ্টা করে আল্লাহ্ সন্ত্রাস বিপর্যয় পছন্দ করে না।- (সূরা বাকারা, আয়াত- ২০৫)
কোন ব্যক্তিকে হত্যা করলে ব্যক্তি বা পরিবারের বিশেষ ক্ষতি হয়। কিন্তু ফিতনা বা সন্ত্রাসের কারণে গোটা সমাজ তথা সারা দেশ ও জাতির ক্ষতি সাধিত হয়। কখনো কখনো তার ক্ষতির প্রভাব দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। এই জন্য আল্লাহ্ তা’আলা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন- ফিৎনা বা সন্ত্রাস, বিশৃংখলা হত্যার চেয়েও গুরুতর।- (সূরা বাকারা, আয়াত- ১৯১)
যে সমাজে বা রাষ্ট্রে ফিতনা- ফ্যাসাদ ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই মানবতার অপমৃত্যু ঘটে। সাথে সাথেই শান্তির সুবাতাস বন্ধ হয়ে যায়। সে সমাজ ও রাষ্ট্র এক নরক কু-ে পরিণত হয়। এই কারণে মহান আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- সূরা মায়িদার ৩২ নং আয়াতে। মানুষ হত্যা করা নিষেধ সে হিন্দু হোক, মুসলিম হোক, বৌদ্ধ হোক ও খ্রিস্টান হোক। এই কারণেই বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ্ তা’আলা এই বিধান দিয়েছেন- যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোন মানুষকে হত্যা করল সে যেন গোটা মানব জাতীকে হত্যা করল এবং যে কারো জীবন রক্ষা করল সে যেন গোটা মানব জাতীর জীবন রক্ষা করল এবং সূরা বনী ইসরাঈলের ৩৩ নং আয়াতে উল্লেখ আছে।
আল্লাহ্ যার হত্যা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করিও না, অন্যায়ভাবে কোন মানুষকে খুন করা কিংবা তার সম্পদ গ্রাস করা কিংবা অপমানিত করা হারাম।
জঙ্গিবাদ তথা বোমাবাজীও সন্ত্রাসী হামলা করে যারা নাগরিক জীবনে নৈরাজ্য, অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে তার কারণ হল কোরআন হাদীসের অপব্যাখ্যা করে তাদের মগজ ধোলাই করা হয়।
সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্ব বিনির্মাণে আল কোরআনে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে সকলকে সন্ত্রাস না করার জন্য বলা হয়েছে। সন্ত্রাসের ভয়াবহতা এবং জাগতিক পরিণাম ও আখিরাতে ভয়ংকর শাস্তি সম্পর্কে আল কোরআনে মানব জাতিকে সতর্ক করেছেন। নি¤েœর এ সমস্ত আয়াতে যেমন : সূরা নাহল- আয়াত-৮৮, সূরা আরাফ : আয়াত-৫৬, সূরা রাদ : আয়াত-২৫, সূরা রুম : আয়াত-৪১, সূরা বাকারা : আয়াত-১৯১, সূরা ফজর : আয়াত-১২, সূরা হুদ : আয়াত-৮৫, সূরা শুয়ারা : আয়াত-১৮৩, সূরা কাসাস : আয়াত-৮৩, সূরা আনকাবুত : আয়াত-৩৪, সূরা হাশর : আয়াত-৫, সূরা ইউনুস : আয়াত-৪০, সূরা কাসাস : আয়াত-৭৭, সূরা নিসা : আয়াত- ৯৩।
কোন মুমিনকে হত্যার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম। (সূরা নিসা : আয়াত-৯৩)
যে ব্যক্তি কোন মুমিন ব্যক্তিকে জেনে বুঝে হত্যা করবে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। তাতে সে থাকবে চিরদিন। একজন মুসলিম কখনও তার আরেক মুসলিম ভাইকে হত্যা করতে পারে না। একজন মানুষকে হত্যা করা সমগ্র পৃথিবীকে ধ্বংস করার চেয়ে বড় গোনাহ্। নির্বিচারে মানুষ হত্যা ও ফ্যাসাদ বা সন্ত্রাসী কর্মকা- কোরআন হাদীসে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
হযরত সালেহ (আ.) সামুদ জাতির উদ্দেশ্যে বললেন- তোমরা পৃথিবীতে বিপর্র্যয় সন্ত্রাসী করিও না।- (সূরা আরাফ-৭৪)
সন্ত্রাসীরা সকলের নিকট ঘৃণিত, মহান আল্লাহ তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখেন তাদের উপর লানত। ইসলাম শান্তির ধর্ম, জাতি বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি ভালবাসা দয়া সহানুভূতি সহনশীলতা পারস্পরিক সম্প্রীতি ইসলাম শিক্ষা দেয়। ইসলাম রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত যে কোন ধর্মের নাগরিক নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। ধর্ম সম্পর্কে কোন জবরদস্তি নেই। কোন অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না।- (সূরা বাকারা-২৫৬)
সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদীদের সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর হুঁশিয়ারি বাণী
হাদীস : শেষ যমানা এমন একটি গোষ্ঠীর আর্বিভাব ঘটবে যারা হবে বয়সে নবীন, বৃদ্ধিতে অপরিপক্ব ও নির্বোধ। কোরআন পাঠ করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীও অতিক্রম করবে না। তারা সৃষ্টির সেরা মানুষের কথাই বলবে। কিন্তু ধর্ম থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে, যেমন ধনুক শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়।- (তিরমিযী শরীফ) সন্ত্রাসী ইসলাম ধর্মের সমর্থন করে না।
ইসলামের নাম ভাঙিয়ে যারা সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করে তাদেরকে ধিক্কার জানানো হয়েছে।
হাদীস : মহানবী (সা.) বলেন- সর্বোচ্চ কবীরা গোনাহ্ হল মানুষ খুন করা। এখানে মুসলিম-অমুসলিমকে পার্থক্য করা হয়নি। সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিকের জীবন বিপন্ন হয় রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট হয়। সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদীরা চূড়ান্ত পর্যায়ে কখনও বিজয় হতে পারে না। তাদের শেষ পরিণতি ইহকালে লাঞ্ছনা ও পরকালে কঠিন শাস্তি এ ব্যাপারে-
হাদীস : মহানবী (সা.) বলেন- কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম যে বিষয়ে বিচার করা হবে, তা হচ্ছে খুন অর্থাৎ হত্যাকা-। (নাসাঈ শরীফ)
হাদীস : হযরত আবু হুরায়রা (রাজি.) হাদীস বর্ণিত নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের প্রতি হাতিয়ার দিয়ে ইঙ্গিত না করে। কারণ তার অজান্তে শয়তান তার হাতে স্খলন ঘটাতে পারে আর সে অন্যায়ভাবে হত্যা করা অপরাধে জাহান্নামের কূপে পতিত হবে।- (বুখারী শরীফ)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন