সালাউদ্দিন আহমেদ মুক্তি
গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে তার সুফল পৌঁছে দিতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। নিশ্চিত করতে হবে টেকসই উন্নয়ন। একটি দেশ যখন লক্ষ্য স্থির করে তখন তার সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও আসে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন সক্ষমতা। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হতে চায় বাংলাদেশ। ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত ও ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত ১০টি দেশের কাতারে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনের পথে যে বাধাগুলো রয়েছে সে সম্পর্কে আমরা কতটা সচেতন। শুধু প্রবৃদ্ধি অর্জনই কি সব? বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে অস্থিতিশীলতা। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। উৎপাদন ব্যাহত হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যায়। ফলে আন্তর্জাতিক সহযোগী গোষ্ঠী অনেক সময় হাত গুটিয়ে নেয়। অথচ বাংলাদেশকে উন্নয়নের জন্য বন্ধুপ্রতিম সহযোগীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে এর কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের দেশে গত কয়েক বছর উদারপন্থী বাজেট হচ্ছে। কিন্তু সেই বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা কি করা হয়েছে? বাজেটে শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, বরাদ্দ ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধিও সমানভাবে জরুরি। বিগত কয়েক বছরে বাজেটের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, প্রতি অর্থবছরের একপর্যায়ে এসে এডিপি কাটছাঁট করা হয়। সক্ষমতার অভাবের কারণেই এমন হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বাজেট বাস্তবায়নের আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অবকাঠামো। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ অনিশ্চিত। ফলে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এখনো উল্লেখযোগ্য হারে হয়নি। নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে যে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন তা করা যাচ্ছে না। নতুন করে বিনিয়োগ না থাকায় কাক্সিক্ষত উন্নয়ন যে বাধাগ্রস্ত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সর্বত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে উন্নয়নে যেমন গতির সঞ্চার হবে, তেমনি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও শক্তিশালী করতে হবে। দেশের অগ্রযাত্রায় গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়নেরও কোনো বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একে অন্যের পরিপূরক। উন্নয়নের স্বার্থে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক পরিবেশ। অন্যদিকে গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে উন্নয়ন করতে হবে। তবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্র যেমন সঠিক পথে পরিচালিত হবে, তেমনি উন্নয়ন কর্মকা- বাধাহীনভাবে এগিয়ে নিতে হবে। গণতন্ত্র, উন্নয়ন, মানবাধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলেই দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত হবে। উন্নয়নের চাকায় গতি সঞ্চার হবে। তবে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন। সুশাসনই হবে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ।
বাংলাদেশ ১৬ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ। অভ্যন্তরীণ বাজারও বিশাল। বাংলাদেশে সস্তা শ্রমের সংস্থান রয়েছে যা বিনিয়োগকারীদের কাছে কাম্য। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিদ্যুৎসহ জ্বালানি ক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতা অনেকাংশ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। বিনিয়োগ সংক্রান্ত আইনকানুন দুনিয়ার অনেক দেশের চেয়ে উদার হওয়া সত্ত্বেও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা এবং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার জন্য বিদেশি বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় আকর্ষিত হচ্ছে না। দেশি বিনিয়োগকারীরাও একই কারণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ না থাকায় দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। সামাজিক ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা সৃষ্টির আশঙ্কা সৃষ্টি করছে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব বাড়ার ঘটনা।
বাংলাদেশের অবস্থান অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিধর দুই দেশ চীন ও ভারতের মাঝখানে। চীনে শ্রমের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেক বিনিয়োগকারী তাদের কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তরে আগ্রহী। কিন্তু আইনের শাসনের ক্ষেত্রে সংকট থাকায় এবং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার ভয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে যাওয়ার সংশয়ে ভুগছেন। দেশের অর্থনীতিকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়া এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ধরে রাখতে হলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। এ জন্যই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়ে সরকারকে নিতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত।
আইনের শাসন বলতে মূলত আমরা বুঝি আইন ভঙ্গ করা ছাড়া কাউকে শাস্তি দেয়া যাবে না। কেউ আইন ভঙ্গ করলে তা সাধারণ আদালতে প্রমাণ হতে হবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে সবাই আইনের চোখে সমান। তৃতীয়ত, ব্যক্তি-অধিকার বিচারিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
দেশের মানুষ শান্তি চায়, সুশাসন প্রত্যাশা করে। অপরাধ করে কোন প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবান ব্যক্তি পার পেয়ে যাক- এটা কারোরই কাম্য নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও দমন এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারে ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। দেশের মানুষ এটাই চায়। এর মাধ্যমে নীরবে গোটা সমাজে স্বস্তিবোধ ফিরে আসে। সরকারের প্রতিও মানুষের আস্থা বাড়ে।
আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান, এখানে ছাড় দেয়া কিংবা বিরাগবশত চরম পদক্ষেপ নেয়া- দুটোরই কোন সুযোগ নেই। যে যতখানি অন্যায় করবে তার সাজা আইনসম্মতভাবে ততটুকুই নির্ধারিত। সব অপরাধীকেই আইনের আওতায় নিয়ে আসা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
ষ লেখক : সংসদ সদস্য, ময়মনসিংহ-৫ ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব, জাতীয় পার্টি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন