হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে যখন ঈদের নামাজ পড়ার বিধান নাজিল হয়, তখন মুসলমানদের জামাত ও তাদের সংখ্যাধিক্য প্রকাশ করার জন্য হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদগাহে মহিলাদেরও উপস্থিত হওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। হযরত উম্মে আতিয়্যাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন আমাদেরকে বের হওয়ার আদেশ দেওয়া হতো, আমরা কুমারী মেয়েদের, এমনকি ঋতুবতী মহিলাদেরও ঘর থেকে বের করতাম। অতঃপর পুরুষদের পিছেনে থেকে তাদের তাকবিরের সাথে সাথে তাকবির পড়তাম এবং তাদের দোয়ার সাথে সাথে আমরাও ঐ দিনের বরকত ও পবিত্রতা লাভের দোয়া করতাম।’ (সহিহ বুখারী, হাদীস: ৯৭১)।
এ হাদীস এবং অন্যান্য আরও হাদীস শরীফে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, ঋতুবতী মহিলাগণও ঈদগাহে উপস্থিত হতো। অথচ, শরীয়তে ঋতুবতী মহিলাদের জন্য নামাজ পড়া সম্পূর্ণ হারাম। সুতরাং, তাদের ঈদগাহে বা জামাতে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি যদি শুধুমাত্র নামাজের জন্য হতো, তবে ঋতুবতী মহিলাগণ ঈদগাহে উপস্থিত হতো না। মূলতঃ প্রথম যুগে নামাজসহ অনুষ্ঠানাদিতে মহিলাদের উপস্থিত হওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বেদ্বীনদের সম্মুখে মুসলমানদের জনসংখ্যা ও জনশক্তি বৃদ্ধি করা এবং তালিম গ্রহণ করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিত্যনতুন আদেশ নিষেধ নাজিল হতো, তা যেন পুরুষ-মহিলা সকলে সমভাবে জানতে পারে, সে কারণে তাদেরও উপস্থিত হওয়ার অনুমতি ছিল।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মহিলাদের যথারীতি মসজিদে এসে জামাতের মাধ্যমে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা ছিল। তখন প্রথমে পুরুষ এরপর বাচ্চা ছেলেরা ও এরপর মহিলারা নামাজ পড়তে দাঁড়াতেন। পরবর্তীতে পর্দার হুকুম নাজিল হয় এবং মহিলাদের জামাতে আসতে নিরূৎসাহিত করা হয়। রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর দাসিদের মসজিদে আসতে বাধা দিওনা, তবে তাদের জন্য নিজ ঘর-বাড়িই উত্তম স্থান’ (আবু দাউদ, হাদীস: ৫৬৭)।
মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘হে মহিলারা! তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান কর’, অর্থাৎ পর্দায় থাক। অতঃপর এক হাদীসে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মহিলাদের জন্য ঘরের আঙ্গিনায় নামাজ আদায়ের চেয়ে তার গৃহে নামাজ আদায় করা উত্তম। আর নারীদের জন্য গৃহের অন্য কোনো স্থানে নামাজ আদায়ের চেয়ে তার গোপন কামরায় নামাজ আদায় করা অধিক উত্তম’ (আবু দাউদ, হাদীস: ৫৭০)।
মহিলাদের আগমনে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে, তা প্রতিরোধ করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ জার হয়ি যে, কোনো মহিলা মসজিদে আসতে চাইলে সে যেন সুগন্ধির নিকটেও না যায়। অপর এক নিদের্শে বলা হয়, যে মহিলা সুগন্ধি ব্যবহার করেছে সে যেন আমাদের সাথে এশার নামাজ না পড়ে’ (সহিহ মুসলিম, হাদীস: ৪৪৩ ও ৪৪৪, আবু দাউদ, হাদীস: ৫৬৫)।
পরবর্তী সময়ে হযরত উমর (রা.) এর খিলাফতকালে পর্দার গুরুত্ব ও মহিলাদের ঘরে নামাজ পড়ার উৎসাহ ও ফজিলতপূর্ণ হাদীস শরীফের দিকে লক্ষ রেখে আমীরুল মো’মেনীন হযরত ওমর (রা.) ইজতেহাদ করে মহিলাদের মসজিদে এসে জামাতে নামাজ পড়তে নিষেধ করে দেন। তখন তাতে কোন সাহাবীই আপত্তি করেননি। এতে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এই নিষেধাজ্ঞায় সম্পূর্ণ একমত ছিলেন। মহিলারা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) এর নিকট গিয়ে এ ব্যাপারে অভিযোগ করেন, তখন হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যদি হুযুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের এ অবস্থায় পেতেন, তবে অবশ্যই তিনিও তোমাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করতেন’ (সহিহ বুখারী, হাদীস: ৮৬৯, মুসলিম, হাদীস: ৪৪৫, আবু দাউদ, হাদীস: ৫৬৯)।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যায়, সাহাবীগণের অনেকেই মহিলাদের মসজিদে আসার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে পরিস্থিতির আলোকে হযরত উরওয়া (রহ.), হযরত কাছিম (রহ.), হযরত ইব্রাহীম নাখয়ী (রহ.) প্রমুখ বিশিষ্ট তাবিঈ নিষেধের পক্ষে চলে যান। ইমাম ও মুজতাহিদগণ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো নামাজে আসতে মত প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে শুধু বয়স্কা বৃদ্ধা মহিলাদের জন্য অনুমতি ব্যক্ত করেন। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী উলামায়ে কেরাম মহিলাদের জন্য সকল নামাজে আসার নিষেধ বার্তা প্রকাশ করেছেন। উল্লেখিত অবস্থা ও সিদ্ধান্তের আলোকে উলামায়ে কেরাম মত প্রকাশ করেছেন যে, মহিলাদের জন্য ঈদের নামাজ ওয়াজিব নয়। উপরন্তু ঈদের দিনে মহিলারা অলংকারাবৃতা ও সুসজ্জিতা হয়ে থাকবে, তাই তাতে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা বিদ্যমান। তাই মহিলাদের ঈদের জামাতে শামিল হওয়ার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে তা থেকে নিরূৎসাহিত করাকেই উত্তম বলে অভিজ্ঞ আলিম সমাজ অভিমত ব্যক্ত করেছেন (ফাতওয়া ও মাছাইল ৩য় খ: ৪০২।)
গায়াতুল আওতার কিতাবের মর্মে জানা যায়, পরবর্তী যুগের উলামাগণ স্ত্রীলোকের জামাতে হাজির হতে মাকরূহে তাহরীমীর দলিল পেশ করেছেন। চাই ঈদের জামাত হোক বা জুম্মার জামাত হোক। বৃদ্ধা স্ত্রীলোকেরও ঐ হুকুম। কিন্তু বৃদ্ধা স্ত্রীলোক সম্বন্ধে কেউ কেউ মতভেদ করে থাকলেও দুররুল মুখতার কিতাবে আছে বর্তমান জামানায় ফিৎনা প্রকাশ পাওয়ার দরুন বৃদ্ধা স্ত্রীলোকদেরও জামাতে যাওয়া মাকরূহে তাহরীমী।
হযরত উম্মু হুমাইদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা একবার হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমতে হাজির হয়ে আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনার সাথে নামাজ পড়ার আমার খুবই ইচ্ছে হয়। সাইয়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, আমি জানি, আপনি আমার সাথে নামাজ পড়তে ভালো বাসেন। কিন্তু মনে রাখবেন, বন্ধ ঘরে আপনার নামাজ পড়া খোলা ঘরে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম। আর খোলা ঘরের নামাজ বারান্দার নামাজের চেয়ে উত্তম। আর বারান্দার নামাজ মহল্লার মসজিদের নামাজের চেয়ে উত্তম। আর মহল্লার মসজিদের নামাজ আমার মসজিদে (মসজিদে নববী শরীফ) নামাজের চেয়ে উত্তম। এই ইরশাদ শ্রবণের পর হযরত উম্মু হুমাইদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা স্বীয় ঘরের সবচেয়ে নির্জন কোণে বিশেষভাবে নামাজের জায়গা তৈরি করেন এবং ইনতিকাল পর্যন্ত সেখানেই নামাজ পড়তে থাকেন (মুসনাদে আহমদ, সহিহ ইবনে খুযাইমা ১৬৮৯, সহিহ ইবনে হিব্বান, সূত্র: আত তারগীব- ১/১৩৫)।
ইমামে আ’যম হযরত আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহিকে মহিলাদের মসজিদে যাওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যুবতী মহিলাগণ কোনো নামাজেই যে কোনো সময়েই হোক না কেন বের হতে পারবে না। (অর্থাৎ মসজিদে জামাতে উপস্থিত হতে পারবে না) আর বৃদ্ধা মহিলাগণ ফজর ও ইশার নামাজ ব্যতীত কোনো নামাজেই উপস্থিত হতে পারবে না। হযরত ইমাম আবু ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, বৃদ্ধা মহিলাগণ প্রত্যেক নামাজের জামাতে উপস্থিত হতে পারবে। কিন্তু উলামায়ে মুতাআখখেরীনদের (পরবর্তী) ফতওয়া হলো, বর্তমানে যুবতী হোক অথবা বৃদ্ধা উভয়ের জন্যই প্রত্যেক নামাজের জামাতে উপস্থিত হওয়া মাকরূহ তাহরীমী ফিৎনা প্রকাশ পাওয়ার কারণে (তাতার খানিয়া ১ম জিলদ, পৃষ্ঠা-৬২৮, খুলাছাতুল ফতওয়া ১ম জিলদ, পৃষ্ঠা-১৫৫, বাদায়েউস সানায়ে ১ম জিলদ, পৃষ্ঠা-১৫৭)।
এ আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, (১) কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও কিয়াসের বাইরে কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। (২) প্রথম যুগে মহিলাদের মসজিদে যাওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য বেদ্বীনদের সম্মুখে মুসলমানদের জনসংখ্যা ও জনশক্তি বৃদ্ধি দেখানো এবং তালীম গ্রহণ করা। (৩) মহিলাদের জন্য ঘরে নামাজ পড়া অধিক ফজিলত। (৪) হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মহিলাদের মসজিদে যেতে নিষেধ করেন ও উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) তা সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করেন। (৫) পরবর্তীতে ইমাম আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বিনা শর্তে মহিলাদের জামাতের জন্য মসজিদে যাওয়া মাকরূহ তাহরীমী ফতওয়া দেন এবং এর উপর উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজেই মহান আল্লাহ পাক যেন আমাদের সকলকে হক্ব মত ও হক্ব পথে কায়েম রাখেন এবং উক্ত ফতওয়া মুতাবিক আমল করে মহান আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাছ মারেফত এবং মহব্বত হাছিল করার তৌফিক দান করেন। [সংকলিত]
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন