আমাদের কাছে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া ব্যাপারটা খুব সাধারণ আর স্বাভাবিক বিষয়। যদিও অসুখে ভোগা ব্যাক্তি মাত্রই জানেন এর মর্ম। তবে আপনি যখন কোনো নবজাতক শিশুর অভিভাবক, তখন এই মলত্যাগ অনেক সময় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মনে বাসা বাঁধতে পারে অনেক প্রশ্ন। এই লেখাতে চেষ্টা করব এরকম কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আপনার উদ্বেগ নিরসনের।
১। বাচ্চার জন্ম হয়েছে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, এখনো পায়খানা করেনি কেন?
উত্তর- শারীরিক অন্য সব দিক দিয়ে সুস্থ নবজাতকের প্রথম পায়খানা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে করা উচিত। আর প্রসাবের জন্য আটচল্লিশ ঘণ্টা দেখা যেতে পারে। তবে অনেক সুস্থ বাচ্চা চব্বিশ ঘণ্টার কিছু পরেও মল ত্যাগ করতে পারে। আমরা কয়েকটা জিনিস দেখি। প্রথমত, শিশুর পায়ুপথের কোনো ধরনের অস্বাভাবিকত্ব আছে কিনা। হয়ত তার মলদ্বারই জন্মগতভাবে ত্রুটিযুক্ত হয়ে আছে। অনেক সময় রাবারের বিশেষ নল পায়ুপথে প্রবেশ করিয়ে কিংবা এক্সরে করে ভিতরের সমস্যা ধরা পড়ে। দ্বিতীয়ত, জীবনের প্রথম কালো পায়খানা দেরিতে করলে পরবর্তীতে ‘হাইপো-থাইরয়েড’ রোগের ইংগিত বহন করে। শিশু চিকিৎসকের জন্য এটা ধরতে পারা খুব জরুরি। কারণ সময়মত এর চিকিৎসা শুরু করতে পারলে মানসিক প্রতিবন্ধকতা সম্পূর্ণ এড়ানো যায়। তৃতীয়ত, কিছু আপাত দুর্লভ জন্মগত রোগে পায়খানা হতে দেরি হয়। হার্শপ্রাং অসুখ, সিস্টিক ফাইব্রোসিস ইত্যাদি এমন কিছু রোগ।
২। বাচ্চা এত ঘনঘন পায়খানা করে কেন? অথবা, চার-পাঁচ দিন হয়ে যায়, বাবু পায়খানা করে না। এটা কোনো সমস্যা?
উত্তর- স্বাভাবিক ওজনের সুস্থ বাচ্চা শুধুমাত্র বুকের দুধ খেয়ে দিনে কুড়ি-পঁচিশবার পর্যন্ত পায়খানা করতে পারে। আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে, ওজন ঠিকমত বাড়ছে কিনা এবং চব্বিশ ঘণ্টায় কমপক্ষে আট-দশবার প্রস্রাব করছে কিনা। একইরকম সুস্থ অনেক শিশু চার-পাঁচ দিন পরপর পায়খানা করতে পারে। তবে একটি ব্যাপার জেনে রাখা ভালো। ‘হাইপো-থাইরয়েড’ রোগ হলেও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। এই বাচ্চাগুলো সাধারণত অতিরিক্ত ঘুমকাতুরে শান্ত, বেশিদিন জন্ডিস, জিহŸা বের করে রাখা, নাভি ফুলে যাওয়া (হার্নিয়া) নিয়েও আসতে পারে। যেসব মা বাচ্চাদের কৌটার দুধ খাওয়ান তাদের দুধে পানির পরিমাণ ঠিকমত হচ্ছে কিনা এটাও আমরা জানতে চাই।
৩। বাচ্চা একেকদিন একেকরকম পায়খানা করে। পায়খানার কোন রঙটা স্বাভাবিক?
উত্তর- অনেকে জেনে অবাক হবেন, শিশু চিকিৎসকের কাছে পায়খানার রঙের চার্ট পর্যন্ত থাকে। স্বাভাবিক পায়খানাই অনেক রঙের হতে পারে। আপনি অযথা দুশ্চিন্তা না করে শুধু দুইটি রঙ খেয়াল রাখবেন। এক- চুনের মত সাদা পায়খানা। নবজাতকের সাদা পায়খানা যকৃতের খুব জটিল কয়েকটি রোগে (বিলিয়ারি এট্রেসিয়া, নিওনেটাল হেপাটাইটিস) হতে পারে। দুই- লাল পায়খানা, অর্থাৎ সাথে রক্ত যাচ্ছে কিনা, খেয়াল রাখুন।
৪। বাচ্চা অনেকদিন ধরে পানির মত পায়খানা করছে। পায়খানার রাস্তা লাল হয়ে গেছে। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়েছে, কিন্তু সারছে না কেন?
উত্তর- একটা মজার প্রাকৃতিক ব্যাপার অনেকেই জানেন না। মায়ের বুকের দুধের প্রথম অংশে পানি থাকে বেশি, কিন্তু চর্বি, আমিষ থাকে কম। আর শেষের দিকে ঘন দুধে চর্বি, আমিষে তৃপ্তি হয়, পেট ভরে আর পায়খানা ঘন হয়। অনেক মা শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ান, কিন্তু অল্প সময় নিয়ে, অথবা একটু ডান দিকের স্তন, আবার একটু বাম দিকে এভাবে। এই বাচ্চারা প্রকৃতপক্ষে বেশি বেশি পানি খাচ্ছে আর একটু পরপর পানি ছাড়ছে। পেট তাড়াতাড়ি খালি হয়ে পড়ে। তৃপ্তি হয় না। তাই সারাক্ষণ কাঁদতে থাকে। মায়ের করনীয় হচ্ছে, একবারে সময় নিয়ে একদিকের বুক পুরোটা খাওয়াতে হবে। তাহলেই পায়খানা ঘন হয়ে যাওয়ার কথা। অযথা অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।
৫। বাচ্চার পেটে প্রচুর গ্যাস। সারারাত কান্না করে। গ্যাসের ওষুধ বা পায়খানা নরমের ওষুধ লাগবে?
উত্তর- লাগবে না। এই সমস্যাটির নাম ‘ইনফেন্টাইল কোলিক’। এর কারণ সবসময় জানা যায় না। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে সিমেথিকন, গ্রাইপ ওয়াটার জাতীয় ওষুধের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তিন থেকে ছয় মাসে এই সমস্যা সেরে যাওয়ার কথা। মা বাচ্চাকে ঠিকমত কাত করে ধরে বুকে লাগাচ্ছেন কিনা, বুকের বোটা বেশী করে মুখে প্রবেশ করাচ্ছেন কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। মা বাচ্চাকে কোলে করে ঢেঁকুর তোলাতে পারেন। এক্ষেত্রে একটি পরামর্শ দিতে পারি। আমাদের পাকস্থলি থাকে পেটের বাম দিকে। বুকের খাঁচা যেখানে শেষ হয় তার ঠিক নিচে। ঢেঁকুর তোলানোর সময় লক্ষ্য রাখুন চাপ’টা যেন পেটের বাম দিকে ঠিক এই জায়গাতে পরে। আশা করা যায়, বাবু কিছুটা আরাম পাবে।
একজন শিশু চিকিৎসক হিসেবে জানি, শিশুর আপাত ‘ছোট’ সমস্যা মায়ের কাছে কতটা দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। সঠিক পরামর্শই পারে এই উদ্বেগ নিরসন করতে পারে।
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ,
শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, মাতুয়াইল, ধাকা-১৩৬২।
ফোনঃ ০১৩১৬৯৮১৫৬৭ (হোয়াটস অ্যাপ)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন