করোনার বিধিনিষেধ না থাকায় দুই বছর পর এবার ঈদ উৎসব প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ঈদুল ফিতরের ছুটিতে রাজধানীসহ সারা দেশের বিনোদন কেন্দ্রগুলো বেশ জমে উঠেছে। ঈদের ছুটির পর গতকাল শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটিতেও রাজধানীর প্রতিটি বিনোদন কেন্দ্রে ছিল উপচেপড়া ভিড়। বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে তিল ধারণের ঠাই নেই।
ঈদের দিন বিকাল থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে রাজধানীর বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে। গতকাল ৪র্থ দিনেও সে ভিড় অব্যাহত ছিল। রাজধানীতে শিশু-কিশোরসহ সব বয়সী মানুষের হৈ হুল্লুড়ে মুখর ছিল জাতীয় চিড়িয়াখানা, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, শিশুমেলা, হাতিরঝিল, লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, জাতীয় সংসদ ভবন চত্বর, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাহদুরশাহ পার্ক, বলধা গার্ডেন, দিয়াবাড়িসহ সব বিনোদন কেন্দ্র ও ঐতিহাসিক স্থান। ঘরবন্দি অবস্থা থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে উত্তরা দিয়াবাড়ি, হাতিরঝিল, পূর্বাচলে ছুটে যান স্জনদের নিয়ে। হাতিরঝিলে ওয়াটার বোটে, পূর্বাচলের বালু নদীতে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ভাড়া করে গান বাজিয়ে উৎসব করতে দেখা গেছে অসংখ্য মানুষকে। ঈদের ছুটিতে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় বিনোদন কেন্দ্রগুলোয় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ঈদ উপলক্ষে প্রতিটি বিনোদন কেন্দ্র নতুন করে সাজানো হয়েছে।
ঈদের দিন থেকেই মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় ছিল প্রচন্ড ভিড়। এ ভিড় সামল দিতে কতৃপক্ষের হিমশিম খেতে হয়েছে। গতকালও চিড়িয়াখানায় ছিল দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। সপ্তাহিক ছুটির দিনে চিড়িয়াখানায় এমনিতেই ভিড় হয়। তারউপর ঈদের আমেজ থাকায় গতকাল ভিড় ছিল অনেক বেশি। হাজার হাজার দর্শনার্থী ঘন্টার পর ঘন্টা চিড়িয়াখানার গেটে দাঁড়িয়ে থেকেও ভিতরে ঢুকতে পারেনি। সকাল থেকেই পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ছুটে আসে বিনোদনপ্রেমীরা। অতিরিক্ত মানুষের চাপে চিড়িয়াখানার প্রধান সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। ফুটপাথ দিয়েও হাঁটাচলার সুযোগ ছিল না।
রাজধানীতে সাধারণ আর মধ্যবিত্তের বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া হাতিরঝিলে জনস্রোত ছিল চোখে পড়ার মতো। সব বয়সী মানুষকে দেখা গেছে হাতিরঝিলে ভিড় জমাতে। হাতিরঝিলে সন্ধ্যার পর রঙিন আলোর ঝলকানিতে এক স্বপ্নময় পরিবেশের তৈরী হয়। তরুণ-তরুণীরা তখন উচ্ছ্বাসে মেতে ঊঠে। অনেকে বন্ধুদের সাথে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউবা ওয়াটারবোটে চড়ে বেড়ায়। আবার অনেকে ঘুরে ঘুরে আনন্দ উপভোগ করে।
মামা ফজলুল হকের সাথে হাতিরঝিলে এসেছে ছয় বছরের আকিব। অন্য শিশুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করে। তারপর বায়না ধরে বেলুন, খেলনা এসব কিনে দেয়ার। মামাও তার ভাগ্নের আবদার মিটিয়ে চলে। এরপর বায়না ধরল ‘হাতিতে চড়বে’। আসল হাতি না হলেও কৃত্রিম হাতির পিঠে চড়িয়ে মামা তার ভাগ্নের বায়না পূরণ করেন।
পুলিশ প্লাজার পেছনে কৃত্রিমভাবে তৈরি হাতির ওপর চড়ে খেলছে শিশুরা। অনেকেই হাতির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। কেউবা টিকটক তৈরিতে ব্যস্ত। কেউ কেউ বাইক নিয়ে পুরো হাতিরঝিল মহড়া দিচ্ছেন।
ঈদের চতুর্থ দিনেও পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শন লালবাগ কেল্লায় দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে শিশু-বৃদ্ধসহ সব বয়সীরা এখানে এসেছেন ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে। বন্ধু-বান্ধবসহ পরিবারের লোকজন নিয়ে অনেকেই ঘুরতে এসেছেন ঐতিহাসিক এই স্থানটিতে।
দুপুর ২টা থেকে সেখানের প্রবেশ পথে মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। তবে দুপুর আড়াইটায় খুলে দেওয়ার পর দর্শনার্থীরা সেখানে প্রবেশের সুযোগ পান।
রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে আসা রোকসানা আক্তার বলেন, দু’বছর পর বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে এসেছি। করোনার কারণে গত দু’বছর আমরা বের হতে পারিনি, ভালোভাবে ঘুরতেও পারিনি। ঈদের ছুটিতে ঘুরে বেড়ানো, একইসঙ্গে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যই এখানে এসেছি।
কেল্লার ভিতরে কেউ প্রিয়জনদের সঙ্গে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কেউবা সেখানের স্থাপনাসমূহের সঙ্গে কেউ ছবি তুলছেন, সেলফি তুলছেন। কেউ আবার ভিতরে থাকা বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখছেন। শায়েস্তা খানের আমলের এসব ইতিহাস-ঐতিহ্য দেখে অনেকেই আনন্দিত। শায়েস্তা খানের মেয়ে পরী বিবির মাজারসহ বেশ কিছু স্থাপনা দেখে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা।
রমনা পার্কেও দেখা গেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উপচেপড়া ভিড়। কেউ দোলনায় দুলছেন, শিশুরা খেলছে, কেউবা রমনার সবুজ ঘাসের ওপর বসে গল্প করছেন। ঘুরতে আসা আরিফুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে শিশুদের তো আর খেলার কোনো জায়গা নেই। তবে এখন রমনা পার্কটি সুন্দর হয়েছে। শিশুদের খেলার জন্যও আলাদা জায়গা রয়েছে। এখানে এসে শিশুরা অনেক মজা পায়।
রাজধানীর সবুজবাগ থেকে সপরিবারে এসেছেন জুয়েল রানা। তিনি বলেন, আমরা দুপুরের আগেই এসেছি। বাসা থেকে রান্না করে খাবার নিয়ে এসেছি। সারা দিন রমনা পার্কে শিশুরা খেলছে। দুপুরে মাটিতে চাদর বিছিয়ে আমরা এখানে খাবার খেয়েছি। রমনা পার্কে এখন ঘুরে বেড়ানোর মতো পরিবেশ হয়েছে। খুবই ভালো লাগছে।
নাছিম উল আলম, বরিশাল থেকে জানান, ঈদ পরবর্তী বিনোদনে দক্ষিনাঞ্চলের প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে যাচ্ছেন স্থানীয় ও দূর দূরান্ত থেকে আসা সব বয়সী মানুষ। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে শুরু করে বরিশালের দূর্গাসাগর দীঘি, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, শের এ বাংলা যাদুঘর, বঙ্গবন্ধু উদ্যান ও মুক্তিযোদ্ধা পার্কসহ প্রকৃতি নির্ভর বিনোদন কেন্দ্রগুলো এখন সকাল-সন্ধা মানুষে ঠাশা।
রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা হাজার হাজার পর্যটকের কলরবে প্রাণবন্ত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। করোনা মহামারীর দু’বছরের মন্দা কাটিয়ে এবার কুয়াকাটার হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা কিছুটা আশার আলো দেখছেন। ঈদের আগে থেকেই এ সমুদ্র সৈকতের আবাসন সুবিধাগুলো আগাম বুকিং হতে শুরু করে। ঈদের পরদিন থেকেই বিপুল পর্যটকের ভীড়ে মুখরিত কুয়াকাটা। তবে ফেরি বিহীন সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ পর্যটক সকালে এসে বিকেলে ফিরে যাচ্ছেন কুয়াকাটা থেকে। ফলে হোটেল-মোটেলের ওপর চাপ কিছুটা কম পড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
রাজধানী ঢাকা ছাড়াও উত্তরবঙ্গ এবং খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়ার পর্যটকরা এখানে আসে। ফলে আবাসিক হোটেল প্রায় ৮০ ভাগ কক্ষই এখন পর্যটকে ঠাশা। ঈদের পরদিন বিকেল থেকেই কুয়াকাটার প্রায় ১৮ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত জুড়েই পর্যটকদের কলরব। গতকাল শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত অর্ধলক্ষাধীক পর্যটক কুয়াকাটায় আসে জানায় হোটেল-মোলে ওনার্স এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ।
এখানে সকালে সূর্যোদয় আর সন্ধায় সূর্যাস্ত দেখার বিরল সুযোগ পর্যটকরা মন প্রাণভরে উপভোগ করছেন। সাথে রাখাইন পল্লী, ইকোপার্ক, নারকেল বাগান, ফাতরার বনসহ উপকূলীয় বনে ঘুরে বেড়ানোর মত প্রকৃতির সান্নিধ্যে সকলেই নিজেদের উজার করে দিচ্ছেন। পর্যটকদের নিরাপত্তা সহ সব ধরনের নিয়ম শৃংখলা রক্ষায় পুলিশ ও প্রশাসনের তরফ থেকে নজরদারিও অব্যাহত রয়েছে। সব মিলিয়ে ছুটির কয়টি দিন অনেকেই প্রাণ খুলে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্নস্থানে বেড়িয়ে পড়েছেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে।
মীরসরাই (চট্টগ্রাম) উপজেলা সংবাদাদতা জানান, ঈদের আনন্দকে দ্বিগুণ করতে মীরসরাইয়ের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে উপজেলার প্রতিটি পর্যটন স্পট ও বিনোদন কেন্দ্রে মানুষের ঢল নেমেছে। করোনা পরবর্তী নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশে এই ঈদে মানুষের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাস পরিলক্ষিত হচ্ছে।
করোনা মহামারীতে গত দুই বছর ঘর থেকে বের হতে পারেনি মানুষ। তাই এবার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে দল বেঁধে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লেক মহামায়া এবং দেশের সর্বাধিক রুপসমৃদ্ধময় ঝর্ণা খৈয়াছরা ও রুপসি ঝর্ণায়, মহুরী প্রজেক্ট, আরর্শি নগর ফিউচার পার্কে দর্শনার্থীদের ঢল পড়ে গেছে ঈদের পরদিন থেকেই। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ঝর্ণা গুলো ফুলে ফেঁপে অনেক মোহনীয় হয়ে থাকে। আর তাই সৌন্দর্য্য পিপাষুদের অনেকে এই সময় ঝর্ণার জলে অবগাহনে যেন আত্মহারা।
সরেজমিন মীরসরাই বিভিন্ন পর্যটন ঘুরে দেখা যায় পর্যটকের আনাগোনা। আরর্শি নগর ফিউচার পার্কে ঘুরতে আসার আলম-সাইমা দম্পতি জানান, এই ঈদে বাচ্চাদের নিয়ে আরর্শি নগর ফিউচার পার্কে ঘুরতে এসেছি। বাচ্চারা ও মজা করছে অনেকদিন পরে এইভাবে বেড়াতে এসে নির্মল বাতাস উপভোগ করছি। মীরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনহাজুর রহমান বলেন, এবারের ঈদের লম্বা ছুটি ছিলো। তাই বৃষ্টি উপেক্ষা করেও হাজার হাজার মানুষ ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ছুটে আসেন মীরসরাই পর্যটন স্পটগুলোতে। এই পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিশ্চিত করতে মীরসরাই থানা পুলিশ ও জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন