এ, কে, এম, ফজলুর রহমান মুন্্শী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এই বিষয়টি খুবই প্রণিধানযোগ্য যে, নামাজ শুধু কেবল তাসবিহ ও জিকরে ইলাহীর নামই নয়, বরং এর মাঝে আনুষঙ্গিক অনেকগুলো আরকানও রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সার্বিক আমল এবং সাহাবায়ে কেরামের নিয়মতান্ত্রিক কাজকর্ম ছাড়া পবিত্র কোরআনেও এই সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে। যুদ্ধ এবং ভয়ের সময় নামাজ কসর করা এবং আরকানগুলো সংক্ষিপ্ত করার অনুমতি আছে। তারপর যখন ভয় দূরীভূত হয়ে যাবে, তখন নামাজকে বিধিবদ্ধভাবে আদায় করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “তোমরা নামাজসমূহ বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজকে হেফাজত কর এবং আল্লাহর সামনে আদবের সাথে দাঁড়াও, যদি তোমরা ভয় কর, তাহলে পদব্রজে হোক, অথবা আরোহী অবস্থায় হোক নামাজ আদায় কর। তারপর যখন ভয় চলে যাবে, তখন আল্লাহকে ডাক এভাবে, যেভাবে তোমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, যা তোমরা পূর্বে অবগত ছিলে না।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-৩১) এই আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সেই জিকরে ইলাহীর একটি নির্দিষ্ট তরিকা ছিল। যার ব্যবহারিক সুরতই হচ্ছে নামাজ এবং এর বিশ্লেষণই সূরা নিসাতে বিবৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে যুদ্ধের সময় এক রাকাত ইমামের সাথে নিয়মমাফিক আদায় করার পর দ্বিতীয় রাকাত সম্বন্ধে ইরশাদ হয়েছে, “(সুতরাং এক রাকাত) নামাজ আদায় করার পর আল্লাহকে দাঁড়িয়ে, বসে ও এক কাতে শয়ন করে স্মরণ কর, তারপর যখন নিশ্চিন্ত ও নির্ভয় হয়ে যাবে, তখন নামাজ আদায় কর।” (সূরা নিসা : রুকু-১৫) এই আয়াতে দুটো বিষয় বিবেচনা যোগ্য। (ক) এক রাকাত যা নিয়মমাফিক আদায় করা হয়েছে, তাকে নামাজ বলা হয়েছে, এবং দ্বিতীয় রাকাত যা দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়েছে এবং শত্রু প্রতিরোধের অবস্থায় পরিসমাপ্তি হয়েছে, তাকে শুধু আল্লাহর জিকির বলা হয়েছে। (খ) যুদ্ধের সময় সহজভাবে একামতে সালাতকে শব্দ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। অথচ জিকরে ইলাহী, তাসবিহ-তাহলিল এবং নামাজের কোনো কোনো আরকানও এর মাঝে শামিল রয়েছে। বরং শুধু এতটুকু বলা হয়েছে যে, তারপর যখন নির্ভয় অবস্থা দেখা দেবে তখনই নামাজ কায়েম কর। এর দ্বারা বোঝা যায় যে, ‘একামতে সালাত’ অর্থ জিকির, তাসবিহ, তাহলিল, হামদ, সানা ও তিলাওয়াতে কোরআন হতে ভিন্নতর। অর্থাৎ নামাজ কায়েম করার মাঝে জিকির, ফিকির, তাসবিহ, হামদ, সানা এবং কিরাত ছাড়াও আরো কিছু আরকান শামিল রয়েছে। যা যুদ্ধাবস্থায় মওকুফ হয়ে গিয়েছিল। এই সাময়িক অসুবিধা দূরীভূত হয়ে যাওয়ার পর পরিশেষে নিয়মমাফিক নামাজ আদায় করার পথ নির্দেশনা দান করা হয়েছে। এই আরাকান সম্পর্কে সূরা বাকারাতে বলা হয়েছিল যে, ‘যখন ভয় দূর হয়ে যাবে, তখন আল্লাহকে সেভাবেই স্মরণ কর, যেভাবে তিনি হুকুম করেছেন।’ এখন আমাদেরকে দেখতে হবে যে, নামাজ কোন কোন আরাকানসহ নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। এর জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সারাজীবন কীভাবে আদায় করেছেন? এবং সাহাবাদেরকে কীভাবে নামাজ শিক্ষা দিয়েছেন? কেননা নামাজের সার্বিক অবস্থার কথা অবিচ্ছিন্নভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময় হতে এখন পর্যন্ত চলে এসেছে। এ ব্যাপারে প্রত্যেক দোস্ত, দুশমন, স্বপক্ষীয় ও বিপক্ষীয় প্রত্যেক বন্ধুই জানেন যে, মুসলমানদের মাঝে সকলেই বিনা এখতেলাফে নামাজ আদায়ের ধারাবাহিকতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এরপরও ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের জন্য কোরআনুল কারিম হতে এ ব্যাপারে প্রমাণ তুলে ধরা খুবই ভালো হবে। আমরা নামাজ আদায়ের সময় আল্লাহপাকের বারগাহে বিনীতভাবে দ-ায়মান হই। আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে “নামাজসমূহ হেফাজত কর। বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজ, এক আল্লাহর সামনে বিনীতভাবে দ-ায়মান হও।” (সূরা বাকারাহ, রুকু-৩১)
আর আল্লাহর নাম স্মরণ করেই নামাজের প্রারম্ভ হয়। ইরশাদ হচ্ছে, “এবং যে স্বীয় প্রতিপালকের নাম স্মরণ করেছে এবং নামাজ আদায় করেছে।” (সূরা আলা : রুকু-১) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, “এবং স্বীয় প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা কর।” (সূরা : মুদ্দাসসির : রুকু-১) আর ‘আল্লাহু আকবার’ শব্দটি নামাজে বার বার যে উচ্চারণ করা হয়, তা মূলত এই নির্দেশেরই প্রতিফলন মাত্র। তারপর আমরা আল্লাহপাকের হামদ ও সানা পাঠ করি এবং তারই সকাশে স্বীয় গোনাহের মাগফিরাত কামনা করি। ইরশাদ হচ্ছে, “যখন তুমি দাঁড়াবে তখন স্বীয় প্রতিপালকের প্রশংসাসূলভ তাসবিহ পাঠ কর।” (সূরা তুর : রুকু-২) তারপর আমরা কোরআন তিলাওয়াত করি। ইরশাদ হয়েছে : “আল-কোরআনের যতটুকু সম্ভব পাঠ কর।” (সূরা মুযযাম্মিল রুকু-২) কিরাআতুল কোরআনে আমরা আল্লাহপাকের আসমা ও সিফাতের উল্লেখ করি এবং সুনির্দিষ্টভাবে আল্লাহর প্রশংসা বর্ণনা করি যার দ্বারা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব (তাকবির) প্রকাশ পায়। ইরশাদ হচ্ছে, “তোমরা আল্লাহ অথবা রাহমান বলে, যে নামেই ডাক না কেন, সকল উত্তম নামসমূহই তার। অধিক উচ্চৈঃস্বরে অথবা অধিক নি¤œস্বরে নামাজ আদায় কর না, বরং মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন কর এবং বল যে, সকল প্রশংসা ওই আল্লাহর যিনি কোনো ছেলে গ্রহণ করেননি এবং তার সা¤্রাজ্যে কাহারো অংশীদারিত্ব নেই এবং দরিদ্রতার কারণে তার কোনো সাহায্যকারীরও প্রয়োজন হয় না এবং তোমরা তার যথার্থ শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা কর।” (সূরা বনী ইসরাঈল : রুকু-১২)
আল্লাহপাকের হামদ সূরা ফাতিহাতে পরিপূর্ণভাবে বিধৃত আছে। এ কারণে প্রত্যেক নামাজের সকল রাকাতের শুরুতে এই সূরাটি পাঠ করা হয়। তারপর সঙ্গতি অনুসারে কোরআনুল কারিমের যে কোনো আয়াত বা সূরা পাঠ করা হয়। তারপর আদবসহ আল্লাহপাকের সামনে অবনত হয় (রুকু)। তারপর মাটিতে কপাল স্থাপন করে সিজদাহ আদায় করা হয়। আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ। রুকু কর এবং সিজদাহ কর এবং স্বীয় প্রতিপালকের ইবাদত কর এবং নেক আমল কর, হয়তো তোমরা সফলকাম হবে।” (সূরা হজ্জ : রুকু-১০) আর বান্দাহ রুকু এবং সেজদায় আল্লাহপাকের তাসবিহ ও তাহমিদ পাঠ কর। ইরশাদ হচ্ছে, “সুতরাং তোমরা সর্ব মহান ¯্রষ্টার নামে তাসবিহ পাঠ কর।” (সূরা : ওয়াকিয়া)। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, “স্বীয় সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপালকের তাসবিহ পাঠ কর।” (সূরা আ’লা) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ঐশী তালীম মোতাবেক প্রথম হুকুম রুকতে এবং দ্বিতীয় হুকুম সেজদাতে আদায় করা হয়। (ইবনু মাজাহ : কিতাবুস সালাত)
কিয়াম, রুকু ও সেজদার এই তরতীব সূরা হজ্জ (৪-ইবরাহীম (আ.) প্রসঙ্গ) এবং আলে ইমরান (৫-মারইয়াম প্রসঙ্গ)-এ বিধৃত আছে এবং সিজদাহর মাধ্যমে এক রাকাত পূর্ণ হয়ে যায়। সূরা নিসা : (১৫-ভয়ের নামাজ প্রসঙ্গ)। মোটকথা আরকানে সালাতের এই তরতীব সম্পূর্ণরূপে ঐশী বিধান কর্তৃক নির্ধারিত এবং প্রজ্ঞাভিত্তিক। প্রথমে দাঁড়ানো, তারপর রুকু করা, তারপর সিজদাহ করা, এর মাঝে সহজাত তরতীব সংযুক্ত রয়েছে। সম্মান প্রদর্শনের অধিক অনুষ্ঠিত সুরত এই যে, মানুষ প্রথমে দাঁড়িয়ে যায়, তারপর যখন অবস্থা ও অনুপ্রেরণার মাঝে গভীরভাবে এসে যায়, তখন সে ঝুঁকে যায় এবং যখন আমিত্ববোধ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন স্বীয় দেহের সম্মানিত স্থানকে (কপাল) দয়ালু ও অনুগ্রহকারীর পায়ের ওপর ন্যস্ত করে। এ কারণেই সিজদাহ হচ্ছে নামাজের চূড়ান্ত পর্যায়। আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “তোমরা সিজদাহ কর এবং নৈকট্য অর্জন কর।” (সূরা আলাক) সুতরাং আল্লাহর নৈকট্যের চূড়ান্ত পর্যায় হচ্ছে সিজদাহ। এ কারণেই প্রত্যেক রাকাতে বার বার সিজদাহ করা হয়ে থাকে।
শারীরিক এবাদতের সমষ্টি হচ্ছে নামাজ :
কোরআনুল কারিমের বিভিন্ন আয়াতে আমাদেরকে বিভিন্ন প্রকার শারীরিক, রসনাভিত্তিক এবং আন্তরিক এবাদতের হুকুম দেয়া হয়েছে। আমাদেরকে আদবের সাথে দাঁড় করানো, তারপর ঝুঁকানো এবং মস্তক অবনত করার হুকুম দেয়া হয়েছে। একই সাথে বিভিন্ন দোয়া পাঠেরও হুকুম করা হয়েছে। আল্লাহর তাসবিহ ও তাহলীলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দোয়া এস্তেগফারের হুকুম করা হয়েছে। অন্তরের নিবিষ্টতার ও একাগ্রতার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর দরূদ পাঠ করার হুকুম করা হয়েছে। এ জন্য নামাজের আঙ্গিক কাঠামোকে এভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যে, একই এবাদতের মাঝে কোরআনুল কারিমে বর্ণিত সকল শারীরিক, ভাষাভিত্তিক এবং আত্মিক ইবাদতের আহকাম সন্নিবেশিত হয়েছে। তাই দেখা যায়, দৈহিক, আত্মিক ও ভাষাভিত্তিক যাবতীয় এবাদতের নির্দেশাবলী আল-কোরআনে বিধৃত রয়েছে, তার সমষ্টি হচ্ছে নামাজ। অন্য কথায় বলা যায় যে, কোরআনুল কারিমে মুসলমানদের কিয়াম, রুকু, সিজদাহ, তাহলিল, তাসবিহ, তাকবির, কেরাত, জিকরে ইলাহী এবং দরূদ পাঠ করার যে হুকুম দেয়া হয়েছে, এগুলোর সমষ্টিগত প্রতিপালনের নামই হচ্ছে নামাজ। যার মাঝে যাবতীয় হুকুম-আহকাম সামগ্রিকভাবে আঞ্জাম দেয়া হয়। অপরদিকে এ সকল আহকাম আদায় করার তরতীবও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু যদি এমনটি না হতো, এ সকল আহকামকে মানুষের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার ওপর ছেড়ে দেয়া হতো, যে চায় রুকু করত এবং যে চায় সিজদাহ করত, যে চায় দাঁড়িয়ে থাকত, যে চায় কোরআন পাঠ করত, কিংবা কেউ নিশ্চুপ পাঠ করত, কেউ সশব্দে পাঠ করত, তাহলে ফারায়েজে ইলাহির তরতীব পালিত হতো না এবং পর্যায়ক্রমও প্রতিষ্ঠিত হতো না। এতে করে বহু লোকের ফরজ তরক হয়ে যেত কিংবা কোনো ফরজ আদায় করার সুযোগ মিলত না। তাছাড়া কাহারো অসাবধানতার দরুন কিংবা দুর্বলতার দরুন সম্পূর্ণ আহকাম আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা দিত। মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে, এতে করে সকল মুসলমানের এবাদতই একই বিন্যস্তরূপ পরিগ্রহ লাভ করত না। না জামায়াত কায়েম হতো, না নামাজকে একই মাযহাবের এবাদত বলা যেত। এমন কি একই পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যভিত্তিক নমুনা মুসলমানদের মাঝে প্রতিভাত হতো না এবং তারা একই দলভুক্ত বলেও বিবেচিত হতো না।আল্লাহপাক ফেরেশতার মাধ্যমে স্বীয় প্রেরিত পুরুষকে এই এবাদতের ব্যবহারিক কার্যক্রম শিক্ষা দিয়েছেন। (মোয়াত্তা ইমাম মালেক ও সহিহ বুখারি কিতাবুস সালাত) এবং রাসূল (সা.) এই পদ্ধতি উম্মতদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং উম্মতগণ বংশপরম্পরায় একে অন্যকে শিক্ষা দিয়েছেন। এ কারণে সম্পূর্ণ অবিচ্ছিন্নভাবে এই নামাজ আদায়ের পদ্ধতি অবিকৃত ও সন্দেহাতীতভাবে উম্মতের মাঝে আজো প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, ভব্যিষ্যতেও থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন