শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

হিজাব : মহান আল্লাহর নির্দেশ এবং নারীর মর্যাদার প্রতীক

সাবরিনা ওবায়েদ আনিকা | প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০২২, ১২:৩৫ এএম

ইসলাম বিশ্বজনীন চিরন্তন এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামে রয়েছে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও সকল অধিকারের স্বীকৃতি, রয়েছে তাদের সতীত্ব সুরক্ষা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক কর্মসূচী। তাদের সম্মান, মর্যাদা ও সতীত্ব অক্ষুন্ন রাখতেই ইসলাম তাদের উপর আরোপ করেছে হিজাব বা পর্দা পালনের বিধান। ‘পর্দা’ শব্দটি মূলত ফার্সী। যার আরবী প্রতিশব্দ ‘হিজাব’। পর্দা বা হিজাবের বাংলা অর্থ- আবৃত করা, ঢেকে রাখা, আবরণ, আড়াল, অন্তরায়, আচ্ছাদান, বস্ত্রাদি দ্বারা সৌন্দর্য ঢেকে নেয়া, আবৃত করা বা গোপন করা ইত্যাদি। পর্দা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান; এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। নারীকে হাদীস শরীফে ‘আওরত’ বলা হয়েছে। আওরত শব্দের অর্থ গুপ্ত, আবরণ, আচ্ছাদন বা আবৃত। সুতরাং নারীর নামেই বুঝা যায় নারীর জন্য পর্দা কতটা আবশ্যকীয়। পারিপার্শ্বিকতার বিবেচনায় বিবেকের দাবীও তাই। আর এ কারণে শরীয়তেও নারীর জন্য পর্দাকে ফরজ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ‘হিজাব বা পর্দা’ নারীর সৌন্দর্য ও মর্যাদার প্রতীক। নারীর সতীত্ব ও ইজ্জত-আবরুর রক্ষাকবচ। নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার অতি সহজ ও কার্যকর উপায়। এ বিধান অনুসরণের মাধ্যমে হৃদয়-মনের পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।’ (সূরা আহযাব: ৫৩)

ইসলামী শরীয়তে নারীর প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ শরীয়ত নারীর ইজ্জত-আবরু হেফাযতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বকে সমুন্নত ও সুউচ্চ করেছে। নারীর পোষাক এবং সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে যে সমস্ত শর্তারোপ করা হয়েছে তা শুধু তাকে সংরক্ষণ করার জন্যই, সৌন্দর্যের প্রকাশের মাধ্যমে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে তার সকল পথ বন্ধ করার জন্য। এটা নারীর স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করা নয়; বরং তাকে লোলুপ দৃষ্টির ছোবল থেকে রক্ষা করা এবং তার পবিত্রতা ও সৌন্দর্যের মানকে সংরক্ষিত করা।
হিজাব আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর আনুগত্য: পর্দা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর আনুগত্য। কেননা তাঁদের আনুগত্য প্রতিটি নর-নারীর উপর ফরয করা হয়েছে। আল্লাহ্ বলেন, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল কোন আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করার কোন অধিকার নেই। যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করবে, সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে। (সূরা আহযাব- ৩৬)
আল্লাহ্ তাআলা নারীদেরকে পর্দার নির্দেশ দিয়ে এরশাদ করেন: ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন সাধারণত: প্রকাশমান স্থান ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। (সূরা নূর- ৩১)। তিনি আরো বলেন : তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে- মূর্খতা যুগের অনুরূপ (বেপর্দা হয়ে) নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। (সূরা আহযাব- ৩৩)। আল্লাহ্ আরো বলেন, হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। (সূরা আহযাব- ৫৯)। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: নারী গোপন বস্তু। (তিরমিযী) অর্থাৎ তাকে ঢেকে রাখতে হবে।
হিজাব নারীর পবিত্রতা : আল্লাহ্ তাআলা বলেন, হে নবী, আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। (সূরা আহযাব- ৫৯) নারী নিজেকে ঢেকে রাখবে। এতে সে পূত-পবিত্রা সংরক্ষিতা থাকবে, আর তবেই তাকে কষ্ট দেয়া হবে না, ফাসেক বা খারাপ লোকেরা তাকে উত্যক্ত করতে সুযোগ পাবে না। এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নারীর সৌন্দর্য অপরের কাছে প্রকাশ হলেই তাকে কষ্ট, ফিৎনা ও অকল্যাণের সম্মুখিন হতে হয়।
হিজাব নির্মলতা : আল্লাহ্ বলেন, তোমরা তাঁর পত্নীগণের নিকট থেকে কোন কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের জন্য এবং তাঁদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ। (সূরা আহযাব- ৫৩)। এ আয়াতে পর্দাকে মুমিন নারী-পুরুষের হৃদয়ের পবিত্রতার কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা চক্ষু যখন অবলকণ করে; হৃদয় তখন কামনা করে। আর এজন্যই দৃষ্টিপাত না করাটা হৃদয়ের পরিশুদ্ধতার কারণ এবং ফিৎনা থেকে বেঁচে থাকার সুস্পষ্ট মাধ্যম। কেননা পর্দার মাধ্যমে দুর্বল অন্তরের মানুষদের কুপ্রবৃত্তিকে বিনষ্ট করে দেয়া হয়। আর নারী যেন পরপুরুষের সাথে নম্র ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা না বলে। এতে দুবর্ল হৃদয়ের লোকদের অন্তরে লালচ (কুবাসনা) সৃষ্টি হবে। (সূরা আহযাব- ৩২)।
হিজাব নারীর আবরণ : রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : নিশ্চয় আল্লাহ্ লজ্জাশীল গোপনকারী। তিনি লজ্জা ও গোপনীয়তা পসন্দ করেন। তিনি আরো বলেন: যে নারীই নিজ গৃহ ব্যতীত অন্যের গৃহে গিয়ে স্বীয় পোষক খুলবে; আল্লাহ্ তার থেকে পর্দা ছিঁড়ে ফেলবেন।
পর্দা হল ঈমান : আল্লাহ্ তাআলা ঈমানদার নারী ব্যতীত কাউকে পর্দার নির্দেশ দেন নি। এজন্যই তিনি বলেছেন: আপনি মুমিন নারীদেরকে বলুন!...। একদা বনী তামীম গোত্রের কতিপয় নারী উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (রা:) এর নিকট আগমণ করে, তাদের পরিধানে ছিল পাতলা পোষাক। তিনি বললেন, তোমরা যদি মুমেনা হয়ে থাক, তবে এটা ঈমানদার নারীর পোষাক নয়। আর যদি ঈমানদার না হয়ে থাক, তবে এপোষক দ্বারা উপকৃত হতে পারবে।
পর্দা আত্মসম্ভ্রম : আত্মসম্ভ্রমবোধ সম্পন্ন পুরুষের জন্যও পর্দা মানানসই, যে পুরুষ নিজ স্ত্রী ও কন্যাদের প্রতি পরদৃষ্টির লোলুপতায় মর্যাদাবোধে আঘাত প্রাপ্ত হয়। জাহেলী যুগে এবং ইসলামের মধ্যেও অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে নারীর মর্যাদা ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য। হযরত আলী (রা:) বলেন, আমি শুনলাম তোমাদের নারীরা অনারব কাফের পুরুষদের সাথে বাজারে গিয়ে ভিড় জমায়? তোমাদের মধ্যে আত্মসম্ভ্রম বোধ নেই? যার মধ্যে আত্মসম্ভ্রম বোধ নেই, তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই।
পর্দাহীনতার বিপদ : ১) পর্দাহীনতা আল্লাহ্-রাসূলের নাফারমানী; যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করবে সে তো নিজেরই ক্ষতি করবে। আল্লাহ্র কোনই ক্ষতি হবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেন: আমার উম্মতের সবাই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তবে সে লোক নয় যে (জান্নাতে যেতে) অস্বীকার করে। তাঁরা প্রশ্ন করলেন, কে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যে আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; আর যে আমার নাফারমানী করবে সেই জান্নাতে যেতে অস্বীকার করে। (বুখারী)।
২) পর্দাহীনতা অভিশাপ; রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, শেষ যুগে অচিরেই আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু নারী হবে, যারা কাপড় পরেও উলঙ্গ থাকবে। তাদের মাথা হবে উটের চূঁড়ার ন্যায়। তোমরা তাদেরকে অভিশাপ কর। কেননা তারা অভিশপ্ত। ৩) বেপর্দা হওয়া জাহান্নামীদের কাজ; রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জাহান্নামবাসী দুটি দল রয়েছে। যাদেরকে আমি এখনও দেখিনি। একদল এমন লোক যাদের হাতে গরুর লেজের মত লাঠি থাকবে যা দিয়ে তারা লোকদেরকে প্রহার করবে। আর অন্য দল এমন নারী যারা পোষাক পরেও উলঙ্গ থাকে। (মুসলিম)।
৪) বেপর্দা ইবলীসের সুন্নাত; আদমের সাথে ইবলীসের ঘটনাই আমাদের সামনে ইবলিসের ষড়যন্ত্র উম্মোচন করে দেয়; সে কিরূপ আগ্রহী ছিল লজ্জাসস্থান প্রকাশ হওয়া ও পর্দা উম্মোচন করার জন্য। বেপর্দা হচ্ছে শয়তানের মূল লক্ষ্য। আল্লাহ্ বলেন, হে আদম সন্তান! শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে না পারে; যেমন সে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে এমতাবসস্থায় যে তাদের থেকে তাদের পোষাক খুলিয়ে দিয়েছে। যাতে করে তাদের লজ্জাসস্থান প্রকাশ হয়ে পড়ে। (সূরা আরাফ- ২৭)। সুতরাং ইবলিসই হল, বেপর্দা ও লজ্জাহীনতার আহ্বানকারী। আর সেই হল আধুনিক নারী মুক্তি নামে আন্দোলনের সবচেয়ে বড় নেতা।
৫) বেপর্দা ইহুদী নীতি; মুসলিম জাতির নৈতিকতা ধ্বংসের ব্যাপারে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র কারো কাছে গোপন নয়। বিশেষ করে নারীর ফিৎনার মাধ্যমে। কেননা নারীর সাথে পুরুষের অবাধ মেলামেশা জাতির নৈতিকতা ধ্বংসের প্রধান অস্ত্র। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেন, তোমরা দুনিয়া এবং নারী থেকে বেঁচে থাক। কেননা বণী ইসরাঈলের মধ্যে সর্বপ্রথম ফিৎনা ঘটেছিল নারী দ্বারা। (মুসলিম)। বেপর্দা ঘৃণিত জাহেলী রীতি: আল্লাহ্ বলেন, তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবসস্থান করবে- মূর্খতা যুগের অনুরূপ (বেপর্দা হয়ে) নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। (সূরা আহযাব- ৩৩)। এ আয়াতে বেপর্দাকে অন্ধকার যুগের বর্বরদের রীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামজাহেলী যুগের সবধরণের রীতি-নীতিকে পদদলিত করেছেন। তিনি বলেন: মূর্খ যুগের সব বিষয় আমার দুপায়ের নীচে। (বুখারী)।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন