রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইতোমধ্যেই মারা গেছে কয়েক হাজার মানুষ এবং প্রতিনিয়তই মারা যাচ্ছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেন পাশাপাশি অবস্থিত দু’টি দেশ। দেশ দু’টি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা অর্জন করে। দেশ দু’টির মাঝে রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত। দু’টি দেশই আকারে-আয়তনে অনেক বড়। ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই ররাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের মতবিরোধ চলছিল। এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটেই রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করে এবং সেই থেকেই দেশ দু’টির মাঝে যুদ্ধ চলছে। ইতোমধ্যে ইউক্রেনের কয়েকটি শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইউক্রেনের প্রায় দশ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে গেছে এবং তারা এখন শরনার্থীর জীবন যাপন করছে। ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণে রাশিয়ারও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করছে। বরাবরের মতই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব আবারো দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। রাশিয়ার পক্ষের রাষ্ট্রগুলো এই যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষের রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। অপরদিকে রাশিয়ার পক্ষের রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এসব অবরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক বিভক্তির পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবেও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের পণ্য সামগ্রীর দাম বেড়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। বিশ্বে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক অস্থিরতা। জাতিসংঘ বরাবরের মতই এই যুদ্ধ বন্ধে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আমরা অবিলম্বে এই যুদ্ধের অবসান চাই।
একটি যুদ্ধ শেষ না হতেই আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পৃথিবীতে কোনো না কোনো সময় কোনো না কোনো দেশের মাঝে যুদ্ধ লেগেছে এবং এসব যুদ্ধ দীর্ঘদিন অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুদ্ধ চলছে লিবিয়ায়, যুদ্ধ চলছে সিরিয়ায় এবং যুদ্ধ চলছে ইয়েমেনে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এ তিনটি দেশে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে যুদ্ধে এসব দেশ আজ ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ, এক সময় অনেক উন্নত এবং শান্ত ছিল। এসব দেশ আজ বহু ভাগে বিভক্ত এবং এক এক এলাকায় চলছে এক এক গোত্রের শাসন। এসব দেশে একক সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে তাদের সার্বভৌমত্ব দুর্বল হয়ে পড়েছে। এসব দেশের সাধারণ জনগণের জীবনে আজ কষ্টের শেষ নেই। যুদ্ধ বন্ধের পরিবর্তে বৃহৎ শক্তিসমূহ এসব যুদ্ধে বিবদমান পক্ষগুলোর পক্ষ অবলম্বন করেছে এবং তাদের সহযোগিতা করে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করেছে। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলেছে ইরাকে এবং আফগানিস্তানে। ইরাকে প্রায় এক দশক এবং আফগানিস্তানে প্রায় চার দশক ধরে যুদ্ধ চলেছে। এ দু’টি দেশে কয়েক লক্ষ মানুষ মারা গেছে। আফগানিস্তানের প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। বর্তমানে এ দুটি দেশে যুদ্ধ বন্ধ হলেও পুরোপুরিভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা যুদ্ধে এসব দেশ কেবল ধ্বংস হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে মানুষের বাড়িঘর, ধ্বংস হয়েছে অফিস আদালতসহ বিভিন্ন অবকাঠামো এবং ধ্বংস হয়েছে সব কিছু। নিহত এবং পঙ্গুত্ব বরণ করেছে কয়েক লক্ষ মানুষ। যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচার তাগিদে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে ভিন দেশে উদ্বাস্তুর জীবন যাপন করছে অগনিত মানুষ। যুদ্ধ থেকে প্রাণ বাঁচাতে মানুষ সবকিছু ছেড়ে ভিন দেশে পাড়ি জমায় নিঃস্ব অবস্থায়। যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় শিশু, মহিলা এবং বয়স্ক মানুষ। যুদ্ধের কারণে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যায়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে উদ্বাস্তুর সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি এবং এদের পরিচয় এখন শরনার্থী। এসবই হচ্ছে যুদ্ধের উপহার এবং অর্জন! মূলতপক্ষে যুদ্ধে ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই অর্জন হয় না। যুদ্ধের ফলে কোনো একটি স্থাপনা যখন ধ্বংস হয়, তখন তার পুরোটাই ক্ষতি। আবার এই স্থাপনা ধ্বংসে যে অস্ত্র ব্যবহৃত হয় তাও ধ্বংস হয়ে যায়। এটাও ক্ষতি। এসব যুদ্ধে যেসব অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে তার মূল্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। অথচ, এই অর্থ অস্ত্র এবং যুদ্ধের পিছনে ব্যয় না করে যদি মানবতার কল্যাণে ব্যবহৃত হতো তাহলে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং অশিক্ষা বহু আগেই দূর হয়ে যেত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ এবং জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যত বিশ্বকে যুদ্ধমুক্ত করার প্রত্যয়ে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠাই ছিল জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৭৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। প্রতি বছর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে জাতিসংঘে সম্মেলন হয় এবং এতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা তাদের প্রদত্ত বক্তৃতায় বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। কিন্তু বাস্তবে যুদ্ধ বন্ধ হয় না এবং শান্তিও প্রতিষ্ঠা হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশের মাঝে বিদ্যমান যুদ্ধ বন্ধে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধ জাতিসংঘ বন্ধ করতে পারেনি। কয়েক দশক ধরে চলে আসা ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধেও জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিনের হাজারো মানুষ বছরের পর বছর ধরে উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাস করছে। এদের অনেকেই উদ্বাস্তু শিবিরেই জন্মগ্রহণ করেছে, উদ্বাস্তু শিবিরেই বড় হয়েছে এবং উদ্বাস্তু শিবিরেই মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসনেও জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে। এসব রোহিঙ্গা আজ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিরাট এক সমস্যা সৃষ্টি করেছে, যার আশু সমাধান খুবই জরুরি। বিভিন্ন যুদ্ধ যেমন বন্ধ করতে পারেনি, তেমনি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানও জাতিসংঘ করতে পারেনি। কারণ, বৃহৎ শক্তিবর্গ কখনোই নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেনি এবং জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, বৃটেন এবং ফ্রান্স হচ্ছে জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচটি দেশ। এসব দেশ তাদের ইচ্ছা বিরোধী সকল প্রস্তাবকে ভেটো ক্ষমতার মাধ্যমে বরাবরই নাকচ করে দিয়েছে। দেখা গেছে, কোনো এলাকায় যুদ্ধ শুরু হলে তা বন্ধের জন্য জাতিসংঘ কখনোই সর্বসম্মতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি। এ বাস্তবতা অত্যন্ত দুঃখজনক। যুদ্ধের ক্ষত ও ক্ষতি কবে পূরণ হবে সেটাই প্রশ্ন। বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যুদ্ধ চায় না। তাঁরা চায় শান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তা।
লেখক: প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক
omar_ctg123@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন