৪৬ বছর আগে আজকের এই দিনে ভারতের পানি আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলন সারা বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত মজলুম মানুষের সংগ্রামী নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ফারাক্কা বাঁধ চালুর সময় এর কি ভয়াবহ বিরুপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা ছেচল্লিশ বছর আগে অনুধাবন করেছিলেন এ দূরদর্শী মজলুম জননেতা। রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দানে লাখো কন্ঠের গগনবিদারী মুর্হু মুর্হু শ্লোগানের মধ্যদিয়ে বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন মরণবাঁধ ফারাক্কা ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও। গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দাও বলে শ্লোগান নিয়ে লংমার্চের মাধ্যমে যে আওয়াজ তুলেছিলেন তা আজও আন্দোলিত করে আকাশ বাতাসে। পদ্মার নিঃস্প্রাণ তরঙ্গে তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। বিরুপ আবহাওয়ায় পুড়ছে মানুষ পুড়ছে প্রকৃতি। তীব্র তাপাদহ আর লু হাওয়ায় অতিষ্ঠ মানুষ। নদী খাল বিল সব মরে গেছে। ভূগর্ভস্ত পানির স্তর নেমে গেছে বহু নীচে। চলছে পানির সংকট। চারিদিকে মরুময়তা ধেয়ে আসছে।
১৯৭৬ সালের মে মাসের লংমার্চের পটভুমি ছিল বাংলাদেশের পরিবেশ প্রকৃতি জীব বৈচিত্র কৃষি মৎস্য নৌ যোগাযোগ তথা সার্বিক জীবন জীবিকার উপর সর্বনাশা ফারাক্কা ব্যারেজের বিরুপ প্রভাব। আসন্ন বিপর্যয়ের বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরে আর্ন্তজাতিক নদী পদ্মার পানির নায্য হিস্যার দাবিতে গর্জে ওঠেন মওলানা ভাসানী। ডাক দেন ফারাক্কা লংমার্চের। তার ডাকে সাড়া দিয়ে আওয়াজ ওঠে চলো চলো ফারাক্কা চল। মরণ বাঁধ ফারাক্কা ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও। লংমার্চে যোগ দেবার জন্য সারা দেশ থেকে বিভিন্ন পথে সে সময় লাখো মানুষ জমায়েত হয়েছিল রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে। সেখানে তিল ধারনের জায়গা ছিলনা। মানুষ অবস্থান নিয়েছিল মাদ্রাসা ময়দানের আশেপাশে এলাকাজুড়ে। চারিদিক ছিল মানুষ আর মানুষ। মুর্হু মুর্হু শ্লোগান ছিল চলো চলো ফারাক্কা চলো। পদ্মার তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দানে বিখ্যাত তালের টুপি সফেদ লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরিহিত মওলানা ভাসানী লংমার্চ নিয়ে চাপাইনবাবগঞ্জ যাবার আগে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দশ মিনিটের এক জ্বালাময়ী ভাষন দেন যা ছিল দিক নির্দেশক ও উদ্দীপক। এরপর লাখো মানুষকে সাথে নিয়ে চাপাইনবাবগঞ্জের উদ্যেশ্যে লংমার্চ নিয়ে রওনা করেন। রাজশাহী শহর পার হতে না হতে লংমার্চ পড়ে বিরুপ আবহাওয়ার মুখে। ঝড় বৃষ্টি আর খরতাপ মাথায় নিয়ে এগিয়ে চলে কাফেলা। কোন কিছুই কাফেলার যাত্রা রোধ করতে পারেনি। রাতে লংমার্চের মানুষের বহর থামে চাপাইনবাবগঞ্জে। রাতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর ফের সকালে যাত্রা। পথের যাত্রা বিরতির সময় খাবার ছিল সামান্য ডাল চালের খিচুড়ি আর শুকনো চিড়া। রাজশাহী চাপাইনবাবগঞ্জের মানুষের আতিথেয়তা ছিল আনন্দের ব্যাপার। অনেক রোডমার্চ, লংমার্চ হয়েছে। সব শ্রেণীর মানুষের এমন অংশগ্রহণ আর কখনো হয়নি। মাইলের পর মাইল আম বাগান পেরিয়ে ভারত সীমান্তের কাছাকাছি কানসাটে গিয়ে থামে কাফেলা। এখানে পনের মিনিটের ভাষনে লংমার্চের নেতৃত্বদানকারী মজলুম জনতার কন্ঠস্বর মওলানা ভাসানী বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তোলেন গঙ্গার পানি আমার জন্মগত অধিকার। এ অধিকার আমরা আদায় করে ছাড়ব। ভারত সরকারের জানা উচিত বাংলাদেশের মানুষ আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করেনা। আমরা আমাদের অধিকারের আদায়ের লংমার্চ করতে এসেছি। কারো সাথে যুদ্ধ করতে নয়।
উল্লেখ্য, লংমার্চ যদি সীমান্ত অতিক্রম করে ফারাক্কা ব্যারেজ চলে আসে এমন শংকায় ভারত সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন করেছিল। ফারাক্কা লংমার্চে লাখো মানুষের এমন স্বত:স্ফুত অংশগ্রহণ আর লক্ষকন্ঠের গগন বিদারী শ্লোগান ভারতের শাসক গোষ্টির কপালে দু:চিন্তার ভাজ ফেলেছিল। সারা বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে আরেকবার দেখেছিল সদ্য স্বাধীন হওয়া একটা দেশের মানুষ তাদের নায্য হিস্যা আদায়ের জন্য কেমন ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে পারে। ফারাক্কা লংমার্চের রেশ ধরে ফারাক্কা ইস্যুটি জাতিসংঘ পর্যন্ত গিয়েছিল। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪৮তম অধিবেশনে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ত্রিশ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি হয়। কিন্তু বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত তার পানির নায্য হিস্যাটুকু পায়নি। বরং পানি চুক্তিতে গ্যারান্টিক্লজ ও সালিশী ব্যবস্থার কথা কৌশলে এড়িয়ে যাবার কারণে পানির নায্য হিস্যা না পেলেও বিশ্ব দরবারে (জাতিসংঘ) নালিশ জানানোর পথটি বন্ধ হয়ে যায়। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারতের পানি জল্লাদরা তাদের পানি শোষন নীতিকে আরো আটোসাটো করে ভাটির দেশ বাংলাদেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। শুধু ফারাক্কা নয় অভিন্ন ৫৪টি নদীর সবকটি স্বাভাবিক প্রবাহে বাধাগ্রস্ত করছে। ১৯৭৬ সালে দূরদর্শী নেতা মওলানা ভাসানী যে আওয়াজ তুলেছিলেন তা এখন বাংলাদেশ, ভারত নেপাল সিকিম সর্বত্র অনুরিত হচ্ছে। নেপাল থেকে এসেছিলেন নদীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ওয়াটার কমন্স ফোরাম নামে একটি সংগঠনের প্রতিনিধি দল। তারা নেপালের গন্ডাক নদী এরপর ভারতের গঙ্গা পাড়ের বিভিন্নস্থানে সমাবেশ করে। ফারাক্কা হয়ে তারা বাংলাদেশের রাজশাহীর গোদাগাড়ি ও আলুপট্টি এলাকায় পদ্মা তীরে সমাবেশ করে গঙ্গার ওপর ব্যারেজ নির্মাণের ফলে কি ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা তুলে ধরেন। ইতোমধ্যে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ফারাক্কার কারনে কি ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে তা তুলে ধরে বলেন ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে কোন উপকার নেই বরং ক্ষতি হচ্ছে। এ কারনে ফারাক্কা ব্যারেজ ভেঙ্গে দেবার দাবি জানান। এর আগে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষজ্ঞরা ব্যারেজের বিরুপ প্রতিক্রিয়া সর্ম্পকে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। উল্লেখ্য ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের সমীক্ষার সময় (১৮৪১-১৯৪৬) নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলা হয়েছিল। ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি করার সময় পশ্চিমবঙ্গের প্রধান প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য এর বিরোধীতা করে বিরুপ সমালোচনার শিকার হন। ভারত সব শংকাকে উপেক্ষা করে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ করে। তারপরও গঙ্গাকে ঘিরে বাস্তবায়ন করে নানা প্রকল্প। পানির অভাবে ভাটির দেশ শুকিয়ে মরলেও তা আমলে নিতে নারাজ ভারতের পানি শোষনকারী নীতিনির্ধারকরা। আবার তিস্তার উপর গজলডোবা দিয়ে আরেক গজব চাপিয়ে দেয়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। পানি নিয়ে ভারতের দাদাগীরিতে বাংলাদেশের কৃষি তথা পরিবেশের উপর ভয়ংকর বিরুপ প্রভাবের আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের শংকা এমন অবস্থা চলতে থাকলে পানি ও নদী একেবারে হারিয়ে যাবে। যা ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি করবে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রান আঞ্চলিক ও আর্ন্তজাতিক পর্য্যায়ে সোচ্চার হতে হবে। জাতির এই সংকটকালে আজ বড্ড প্রয়োজন অনুভুত হচ্ছে মওলানা ভাসানীর মত একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতার। যার এক আওয়াজে গোটাজাতি ফারাক্কা লংমার্চের মত ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ভুমিকা রাখবে।
ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস পালন করবে লংমার্চ উদযাপন কমিটি
লংমার্চের ৪৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ রাজশাহীর পদ্মার তীরে লালনশাহ মুক্তমঞ্চে গণজমায়েতের আয়োজন করেছে ফারাক্কা লংমার্চ উদযাপন কমিটি। গতকাল দুপুরে নগরীর একটি রেস্তরাঁয় সংবাদ সম্মেলনে আয়োজকরা জানান, অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন ফারাক্কা লংমার্চ উদযাপন কমিটির আহবায়ক বিশিষ্ট গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী। গণজমায়েতে উপস্থিত থাকবেন ভাসানী অনুসারী পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মোস্তফা জামাল হায়দার চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি, প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক সাবেক মহাপরিচালক পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা, অ্যাড. আবুল কাশেম সভাপতি রাজশাহী জেলা আইনজীবী সমিতি, যোনায়েদ সাকী প্রধান সমন্বয়কারী গণসংহতি আন্দোলন,এ্যাড. হাসনাত কাইয়ুম প্রধান সম্বনয়কারী রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও সমন্বয়ক জাতিসংঘ পানি প্রবাহ করভেনশন বাস্তবায়ন আন্দোলন, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, মহাসচিব ভাসানী অনুসারী পরিষদ, শেখ রোকন মহাসচিব রিভারাইন পিপল, সাইফুল খান ভাসানী সেক্রেটারী বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টি, আজাদ খান ভাসানী, অ্যাড. এনামুল হক সভাপতি নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন