বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যায় হাহাকার

ত্রাণে মিঠছে না ক্ষুধার জ¦ালা : ময়লা-আবর্জনা মিলেমিশে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ : ত্রাণ পাচ্ছে না বিপর্যস্ত মানুষ : মাঠে নেই রাজনীতিবিদ উচ্চাবিলাশী শিল্পপতির : সুনামগঞ্জে সাড়ে তিন কোটি টাকা

ফয়সাল আমীন, সিলেট/মো. হাসান চৌধুরী, সুনামগঞ্জ থেকে | প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০২২, ১২:০১ এএম

নতুন করে সিলেটের ৬ উপজেলায় পানি ঢুকছে সিলেটে। কুশিয়ারা নদীর বন্যার নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়ছেন লাখ লাখ মানুষ। থমকে যাচ্ছে সিলেটের জনজীবন। এদিকে, নগরে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে। বন্যার পানি আর ময়লা-আবর্জনা মিলেমিশে পচে গিয়ে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ; সিলেট নগরীতে বন্যা কবলিত এলাকাগুলোর জন্য যা হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন দুর্ভোগ। পানিবন্দি মানুষের মধ্যে বিশেষ করে খাবার পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। অনাহারে, অর্ধাহারে রয়েছে বানভাসি মানুষ। কারন ত্রাণ পাচ্ছে না বিপর্যস্ত মানুষ। পাশে নেই কথিত দানবীরদের দান, মাঠে নেই রাজনীতিকর উচ্চাবিলাশী শিল্পপতিরা। পথ দেখাচ্ছে না রাজনীতিকরা। জনপ্রতিনিধিরা সরকারী বরাদ্দ সামলাতে ব্যস্ত। তাদের নিজস্ব শক্ত সামর্থ্য যেন থমকে গেছে সরকারী বরাদ্দের বৃত্তে। এর বাইরের তাদের কোন উদ্যোগ নেই। যদিও সিলেট-১ আসনের এমপি পররাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল আহবান জানিয়েছেন, দুর্গত মানুষের কল্যাণে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসার। গতকাল রোববার দুপুরে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে নগর ভবনের সম্মেলন কক্ষে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জুমের মাধ্যমে এক বৈঠকে এ আহবান জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন এমপি।

অপরদিকে, বেশিরভাগ বন্যা দুর্গত এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পানি বিতরণে এগিয়ে এলেও তা চাহিদার তুলনায় কম। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় পানিবন্দি মানুষের মধ্যে খাবার সংকটে হাহাকার চলছে। সরকারী বেসরকারী ত্রাণ পর্যাপ্ত না হওয়ায় বাড়ছে ক্ষুধার জ¦ালা। সরকারি ত্রাণ বিতরণেও অনিয়নের অভিযোগ আছে।

গত শনিবার কোম্পানীগঞ্জে ত্রাণের জন্য পুলিশের সাথে ঘটেছে হাতাহাতির ঘটনা। চলতি মাসে ১১ মে থেকে পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে সিলেট নগরীসহ জেলা প্রায় ৯০টি ইউনিয়নে বন্যার দখলে চলে যায়। এ অবস্থায় ত্রাণের জন্য এ অঞ্চলে জেলা প্রশাসনের পক্ষে ১১টি উপজেলায় প্রায় সাড়ে মেট্রিক টন চাল, ২৫ লাখ টাকা, চার হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। সিলেটে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আনোয়ার সাদাত বলেছেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। ত্রাণ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি আমরা। কোথাও ত্রাণের সংকট দেখা দিলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডে তথ্য মতে, সিলেটে নতুন করে কুশিয়ারা নদীতে পানি বেড়েছে। কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকায় পানি ইতিমধ্যে ডেঞ্জার জোন অতিক্রম করেছে।

এছাড়া কানাইঘাটে সুরমা, জকিগঞ্জে অমলসীদ, বিয়ানীবাজারে শ্যাওলা ও সিলেটের সুরমার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে যারা আছেন তাদের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। তিনি জানান, বন্যায় যাতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি না হয় সেজন্য পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে খাবার স্যালাইন বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে জরুরি ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানান। বন্যার কারণে সিলেট নগরীর ৬ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৭৪টিতে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, সরকারি নির্দেশনা না থাকলেও পানি উঠে যাওয়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে। পানি সরে গেলে ফের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হবে।

সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি গত কয়েক দিনের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। গতকাল বিকেলে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরু ইসলাম একথা জানান। এদিকে নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও এখনো পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ। তারা ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। চারদিকে পানি আর পানি। চরম দুর্ভোগ ও খবারের জন্য হাহাকারে পড়েছেন বানবাসীরা।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার ১২০০ পুকুর ডুবে গেছে। এতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। দোয়ারা বাজার ও ছাতক উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
জেলা মৎস্য অধিদফতর জানায়, গত ১৫ দিনের ভারি বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধি পেয়ে এসব পুকুর তলিয়ে যায়। মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত জেলার ১২০০ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এসব পুকুরে বিভিন্ন জাতের বড় মাছ ও পোনা ছিল। টাকার অংকে ক্ষতির পরিমাণ তিন কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এসব পুকুরে ১৫০ মেট্রিক টন মাছ। এর মধ্যে ৫০ লাখ পোনা ভেসে গেছে।

মাছচাষী রফিক মিয়া জানান, ‘বন্যায় মাছের খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঋণ করে খামারটি করেছিলাম। মাছ ভেসে যাওয়ায় এখন ঋণ পরিশোধ করবো কীভাবে, সংসারই বা চলবে কীভাবে?’ স্থানীয় আরেক মৎস্য ব্যবসায়ী জানান, ‘অনেক কষ্ট করে ঋণ নিয়ে পুকুরে মাছ চাষ করেছিলাম। কিন্তু সব মাছ বানের পানিতে ভেসে গেছে। এখন আমি পথে বসে গেছি।’সুনামগঞ্জে বন্যায় ১২০০ পুকুর প্লাবিত, ক্ষতি ৩ কোটি টাকা।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সীমা রানী জানান, বন্যায় জেলার ১২০০ পুকুর ডুবে ১১০০ মাছচাষির ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তিন কোটি ৩৭ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে জানা গেছে।

জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন ইনকিলাবকে জানান, নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে মানুষের ঘরবাড়ি থেকে পানি নামতে আরও দু-একদিন সময় লাগবে। বালাগঞ্জ (সিলেট) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, সিলেটের সদর উপজেলার মোগলগাঁও ইউনিয়নের ৪৩ টি গ্রাম বন্যায় কবলিত। ১১ হাজার পরিবারের লোকজন পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অধিকাংশ মানুষ নিম্ন আয়ের ও দিন মজুর। এবারের বন্যায় তাদের পরিবার নিয়ে সীমাহীন কষ্টের মধ্যে আছেন। জানা যায়, ভারত থেকে আসা বানের পানিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন সিলেটের সদর উপজেলার ৯৫ বর্গ কি.মি এলাকার মোগলগাঁও ইউনিয়নের ৪৩ টি গ্রাম। শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে তীব্রভাবে। বেসরকারি বা সরকারি কোন ত্রাণ এখনো তাদের কাছে পৌঁছেনি। মোগলগাঁও ইউপি সদস্য হিরন মিয়া জানান, আমার ইউনিয়নের ১১ হাজার পরিবার বন্যায় আক্রান্ত। সরকারিভাবে ৪ টন চাল এসেছে। আরো ২ টন আসার পথে। কিন্তু যা এসেছে তা নিতান্তই কম। কাকে বাদ দিয়ে কাকে দিব কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র। এর মধ্যে বন্যায় সব নিয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাবন করছেন স্থানীয় বানবাসী । তাদের অবস্থা দেখতে আমি গিয়েছিলাম। করুন অবস্থা দেখে আমি বাকরুদ্ধ। আমি সরকারের কাছে দ্রুত ত্রাণ দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন