শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

আড়ালেই থাকে ছোট অপরাধ

ভুক্তভোগীরা পুলিশ পর্যন্ত যান না চুরি-ছিনতাইয়ের মামলার চেয়ে প্রকৃত ঘটনা অনেক বেশি

সাখাওয়াত হোসেন : | প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০২২, ১২:০৬ এএম

ব্যবসায়ী জামিল হাসান। ছোট ব্যবসা করেই চলে তার সংসার। প্রতিদিনের মতো গত ২৬ এপ্রিল ভোরে ভুলতা-গাউছিয়া মার্কেটে যাওয়ার জন্য ভাটারা বিশ্বরোড এলাকার একটি বাস কাউন্টারে অপেক্ষায় করছিলেন। ওই সময় একটি সিএনজি গাউছিয়া যাবার কথা বললে তিনি সেটাতে ওঠেন। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর পিংক সিটি আবাসিক এলাকায় হঠাৎ দুইজন তার হাত-মুখ চেপে ধরে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে তার সাথে টাকা নিয়ে ব্যবসায়ী জামিল হাসানকে রাস্তায় ফেলে দেয়।

শুধু জামিল হাসান নয়। এরকমভাবে রাজধানীতে প্রতিদিনই ঘটছে চুরি-ছিনতাইসহ নানা ছোট অপরাধ। সড়কে বা রিকশায়, বাসে কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িতে, সকাল-দুপুর জনাকীর্ণ এমনকি ফাঁকা রাস্তায়ও মানুষ ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছে। পিছিয়ে নেই অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, চোর-ডাকাতরাও। এ কারণে নগরবাসীর মনেও দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-আতঙ্ক। দিন থেকে রাত, আবার রাত থেকে ভোর পর্যন্ত নগরীতে বেপরোয়া ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে এসব অপরাধী। কিন্তু এসব অপরাধের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচার তো দূরের কথা তদন্ত পর্যন্ত হয় না।
গত বুধবার ১৮ মে দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছেন তরিকুল ইসলাম (৩৬) নামে এক ব্যবসায়ী। এসময় চক্রটি তার সঙ্গে থাকা এক লাখ টাকা নিয়ে গেছে। পরে তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়।
ওই ব্যবসায়ীর কর্মচারী আশিক ইনকিলাবকে বলেন, তিনি সকালে মাল কেনার জন্য বিহঙ্গ বাসে করে মিরপুর থেকে সদরঘাট যাচ্ছিলেন। বাসে অজ্ঞান পার্টি তার সঙ্গে থাকা মাল কেনার ১ লাখ টাকা নিয়ে গেছে। পরে বাসের এক যাত্রী তার মোবাইল থেকে ফোন দিলে আমরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই। পুলিশ এঘটনায় কাউকে গ্রেফতার বা টাকা উদ্ধার করতে পারেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে কয়েকভাবে ছিনতাই হয়। তবে এর মধ্যে যারা একেবারে নিয়মিত ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার পরিচয় দিয়ে অপরাধ করে। এর আগে থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে একজনের পেছনে কাজ করতে থাকে, পরে সুবিধাজনক স্থানে পেলে সর্বস্ব লুটে নেয়। এরা বিভিন্ন সময় মতিঝিল ব্যাংক পাড়া, উত্তরা এয়ারপোর্ট, কুড়িল-বিশ্বরোড, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, শংকর, ৩০০ ফুট, কারওয়ানবাজার, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও অভিজাত এলাকাসহ রাজধানীর প্রবেশ মুখে সক্রিয় থাকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এক সময় ঢাকার একেকটি এলাকায় একেকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের আধিপত্য দেখা যেত। সুব্রত বাইন, ডাকাত শহীদ, শাহাদত, কিলার আব্বাস, জিসান, শাহিন শিকদার- প্রত্যেকেই হয়ে উঠেছিল নিজ নিজ এলাকার ত্রাস। এরপর তাদের গ্রেফতারে শুরু হয় অভিযান। এ রকম অভিযানে ডাকাত শহীদসহ দু’জন মারা গেছেন। ১৩ জন ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পলাতক। অন্যরা কারাগারে বন্দি। এক কথায়, এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের রমরমা দাপটের দৃশ্য বদল হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ তথ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক অশান্তি, চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের পেছনের কারণ মাদক। কারণ মাদকের অর্থ জোগাতে মাদকসেবীরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় এসব ছোট অপরাধের পেছনে বড় কারণ মাদক। একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১৪ সালে রাজধানীতে মাদকদ্রব্য উদ্ধারজনিত মামলা হয়েছেÑ ৭ হাজার ৬৩টি। ২০২১ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ২১২টিতে। ৭ বছরের ব্যবধানে মাদক মামলার সংখ্যা বেড়েছে ১২৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এ সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার।
তাদের মতে, ছোট ধরনের অপরাধের ঘটনায় শিকার ভুক্তভোগীদের অনেকে পুলিশ পর্যন্ত যান না। খাতা-কলমে চুরি-ছিনতাইয়ের মামলার চেয়ে প্রকৃত ঘটনা অনেক বেশি। কারণ অনেক সময় থানার রেকর্ডে এই ধরনের ঘটনায় ‘হারানোর’ সাধারণ ডায়েরি করে এলাকার চিত্র স্বাভাবিক বলে দেখানো হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকায় ছিনতাই ও চুরিসহ ছোট অপরাধ হচ্ছে, কিন্তু বেড়েছে বলা যাবে না। ঢাকায় এখন জনসমাগম বেড়েছে। অপরাধীরা গ্রেফতারের পর কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আবার একই ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। সব ধরনের অপরাধীদের গ্রেফতার এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় ডিএমপির সকল পুলিশ সদস্য সক্রিয় রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী জানান, দেশে আইন থাকলেও তার বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। ওই কারণে অপরাধের ঘটনা কমছে না। যারা এসব অপরাধ করে তারা প্রভাবশালী অথবা প্রভাবশালীর আশীর্বাদপুষ্ট। তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি বিচারপ্রত্যাশী ভুক্তভোগীর আইনি সুরক্ষার বিষয়েও আরো যত্নশীল হওয়া জরুরি। তা না হলে ভুক্তভোগীরা বিচার চাইতে আগ্রহী হবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন