শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় তামাক কর বৃদ্ধি করার সময় এখনই

অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল আজিজ | প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০২২, ১২:০৩ এএম

তামাক পণ্যের সহজলভ্যতারোধে অন্যতম একটি পদক্ষেপ হলো তামাক পণ্যের কর বৃদ্ধি করা। এতে তামাক পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং উঠতি বয়সের শিশু-কিশোর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাবে।
সরকারের তামাকবিরোধী নানাবিধ কার্যক্রমের ফলে তামাক ব্যবহার ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে ১৮.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। স্বল্প সময়ে তামাকের এই ব্যবহার হ্রাস সরকারের সাফল্যের স্বাক্ষর বহন করলেও বাংলাদেশে এখনও প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক (ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন) ব্যবহার করেন ও ধূমপান না করেও প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিভিন্ন পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন (গ্যাটস্ ২০১৭)। তামাক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে (ট্যোবাকো অ্যাটলাস, ২০২০)। এছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটসহ সকল তামাকপণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির জন্য এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্ক-নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য দ্রæতই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সাম্প্রতিককালে তামাকের ভয়াবহতা অনুধাবন করে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠিই সুনির্দিষ্ট করের মাধ্যমে তামাক পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি চায়। প্রাসঙ্গিকতা সাপেক্ষে তামাক কর বৃদ্ধি প্রসঙ্গে কিছু তথ্য এখানে দেয়া হলো।

১. তামাকপণ্যে কার্যকর করারোপের মাধ্যমে প্রায় ৯ লাখ তরুণকে তামাক ব্যবহার থেকে বিরত করা যাবে এবং প্রায় সাড়ে ৪ লাখ তরুণ অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে এটি খুবই সহায়ক হবে।

২. তামাকপণ্যে কার্যকর করারোপের মাধ্যমে বাড়তি ৯,২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা যাবে। এসডিজির টার্গেট ৩.৪ অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগে মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার জন্য এই বাড়তি রাজস্ব ব্যয় করা যায়।

৩. নি¤œস্তরের সিগারেটের মূল্য বেশি বাড়ালে নি¤œ আয়ের সিগারেট ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা করা যাবে। তাদের আয়ের ২১% বা এক-পঞ্চমাংশের বেশি ব্যয় হয় তামাকপণ্যের পেছনে। এই অর্থ তামাকপণ্যের পরিবর্তে শিক্ষায় ব্যয় করলে তাদের সন্তানদের পড়ালেখার মোট ব্যয় ১১% বাড়ানো সম্ভব।

এছাড়া আগামী বাজেটে তামাক কর বৃদ্ধির জন্য নি¤েœাক্ত তিনটি প্রস্তাবনা বিবেচনা করা যেতে পারে-
১। সকল সিগারেট ব্রান্ডে অভিন্ন করভারসহ (সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬৫%) মূল্যস্তরভিত্তিক সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ (সম্পূরক) শুল্ক প্রচলন করা অর্থাৎ, (ক) নিম্ন স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৩২.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ। (খ) মধ্যম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৭৫ টাকা নির্ধারণ করে ৪৮.৭৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ। (গ) উচ্চ স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১২০ টাকা নির্ধারণ করে ৭৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং (ঘ) প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৯৭.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।

২। ফিল্টারযুক্ত ও ফিল্টারবিহীন বিড়িতে অভিন্ন করভারসহ (সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৪৫%) সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ (সম্পূরক) শুল্ক প্রচলন করা অর্থাৎ, (ক) ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১.২৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং (খ) ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।

৩। জর্দা এবং গুলের কর ও দাম বৃদ্ধিসহ সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ শুল্ক (সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬০%) প্রচলন করা অর্থাৎ, (ক) প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক (৬০%) আরোপ এবং (খ) প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক (৬০%) আরোপ করা।

এর পাশাপাশি সিগারেটের চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল থাকবে।

আমি মনে করি, নির্দিষ্টভাবে প্রতি বছর তামাক কর বৃদ্ধি করলে তামাকগ্রহণকারীর সংখ্যা হ্রাস পাবে। উপরন্তু প্রস্তাবিত তামাক কর সংস্কারের ফলে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে, যা দিয়ে সরকার দেশের স্বাস্থ্যখাত ও উন্নয়ন অগ্রাধিকারসমূহে অর্থায়ন করতে পারবে। এটি সরকার এবং জনগণ উভয়ের জন্যই লাভজনক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে করে আগামী প্রজন্মকে একটি তামাকমুক্ত দেশ উপহার দেবার জন্য তামাকজাত পণ্যের কর বৃদ্ধি করে মূল্য বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

লেখক: সংসদ সদস্য এবং সদস্য, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ২৭ মে, ২০২২, ৩:৩২ পিএম says : 0
পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বড় মাদকের মা হচ্ছে তামাক জাতীয় পদার্থ যেমন জর্দা গুল বিড়ি-সিগারেট আমাদের দেশ যদি আল্লাহর আইন দিয়ে চলত তাহলে এইসব নেশা জাতীয় পদার্থ কখনোই আমাদের দেশে থাকত না
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন