রাজধানীর যানজট নিরসনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উত্তরা এলাকায় দেড় বছর আগে দু’টি ইউটার্ন নির্মান করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তাতে খরচ হয়েছিল প্রায় সাত কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতেই ভেঙে ফেলতে হয়েছে দু’টি ইউটার্নই। ওই সড়কের বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সরকারের বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি কাজ চলছে।
এছাড়া যানজট কমাতে ইউটার্ন দুটি কাজে লাগছিল না। এ দুটি ইউটার্ন ছাড়াও তেজগাঁও থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত বনানী, মহাখালী ও তেজগাঁও এলাকায় নির্মাণ করা বাকি আটটি ইউটার্নও তেমন কোনো কাজে আসছে না। উল্টো ইউটানের কারণে রাস্তায় যানজট আরও বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে ইউটার্ন প্রকল্পই নিয়েই এখন প্রশ্ন। রাজধানী ঢাকার বাস্তবতায় ইউটার্ন প্রকল্পই এখন ইউটার্ন নিয়েছে। এমন প্রকল্পের কারণে সরকারের গচ্চা যাচ্ছে প্রায় ৩১ কোটি টাকা।
ভেঙে ফেলা ২টি ইউটার্নসহ মোট ১০টি ইউটার্ন নির্মাণে ঢাকা উত্তর সিটি ব্যয় করেছে ৩০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। পুরো টাকাই গচ্চা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাজধানীর বাস্তবতায় ইউটার্ন কোনো সমাধান নয়। না জেনে সড়কে অকার্যকর ‘দাওয়াই’ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনও এতে বিব্রত। এ নিয়ে তারা চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন।
ইউটার্নের কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও তুলছেন নানা প্রশ্ন। তারা বলছেন, ইউটার্নের সুফল পেতে হলে অন্তত রাস্তার প্রশস্ততা ২০০ ফুট হতে হয়। রাজধানীর রাস্তাগুলো ততটা প্রশস্ত নয়। আর ইউটার্ন তৈরিতেও রয়েছে ত্রুটি। কার্যকরী পরিকল্পনার অভাবেই ভেস্তে যাচ্ছে এ উদ্যোগ। এ অবস্থায় ইউটার্ন নির্মাণ খরচের পুরো টাকাই পানিতে ভেসে যাওয়ার দশা।
জানা যায়, এক দশকেরও বেশি সময় আগে ইউটার্নের তত্ত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম। তিনি বলেছিলেন, ক্রসিংগুলো বন্ধ করে সুবিধাজনক স্থানে ইউটার্ন তৈরি করলে রাজপথে থাকবে না যানজট। গাড়িগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে পারবে। এর পরই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক ইউটার্ন নির্মাণের ব্যাপারে নড়েচড়ে বসেন। তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে আব্দুল্লাহপুর সড়কে ১০টি ইউটার্ন তৈরির পরিকল্পনা নেয় ডিএনসিসি। তবে মেয়র আনিস তার জীবদ্দশায় ইউটার্ন তৈরি করে যেতে পারেননি। বছর তিনেক আগে ধাপে ধাপে ১০টি ইউটার্ন নির্মাণ করে ডিএনসিসি। এর মধ্যে দুটি ইউটার্ন যানজট নিরসনে কিছুটা ভূমিকা রাখলেও বাকিগুলো তেমন সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
এ ব্যাপারে প্রকৌশলী কামরুল হাসান জানান, ইউটার্ন নয়; তিনি তৈরি করেছেন টার্নিং ইয়ার্ড। তার পরামর্শমতো যে টার্নিং ইয়ার্ড তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো যানজট নিরসনে কাজে দিয়েছে। কিছু টার্নিং ইয়ার্ড তার পরামর্শমতো তৈরি করেনি ডিএনসিসি। এ কারণে সেগুলোতে ফল আসছে না। এটা তার থিওরির দুর্বলতা নয়, বরং যারা তৈরি করেছেন তাদের ব্যর্থতা।
জানা যায়, যানজট নিরসনে প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উত্তরা এলাকায় দেড় বছর আগে দুটি ইউটার্ন নির্মাণ করেছিল ডিএনসিসি। গত জানুয়ারিতে দুটি ইউটার্নই ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভাঙার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ওই সড়কের বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সরকারের বাস র্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্পের আওতায় এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। দ্বিতীয়ত, যানজট কমাতে ইউটার্ন দুটি কাজে লাগছিল না।
এ ছাড়া ওই সড়কের বনানী, মহাখালী, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণ করা বাকি আটটি ইউটার্নও তেমন কোনো কাজে আসছে না।
সব মিলিয়ে ১০টি ইউটার্ন তৈরি করতে ডিএনসিসি খরচ করেছে ৩০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ২০২০ সালের এপ্রিলে এসব ইউটার্ন চালু করা হয়েছিল। চালুর পর বিজয় সরণির ক্রসিং, বনানী ১১ নম্বর রোড, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ ক্রসিংগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন মহাখালী থেকে কোনো গাড়ি বনানীর কাকলী হয়ে ডানে (গুলশান-২ নম্বরের দিকে) মোড় নিতে পারত না।
একইভাবে মহাখালীর আমতলী মোড় হয়ে গুলশান-১ নম্বরের দিকে যেতে পারত না কোনো গাড়ি। এখন দুটি পথই খুলে দেওয়া হয়েছে। এতদিন মহাখালী থেকে গুলশান-২ নম্বরে যেতে হলে বনানীর আর্মি স্টেডিয়াম পেরিয়ে ইউটার্ন ব্যবহার করে ডানে মোড় নিতে হতো। একইভাবে মহাখালী থেকে গুলশান-১ নম্বরের দিকে যেতে হলে বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ী ইউটার্ন ব্যবহার করতে হতো। একইভাবে বিজয় সরণির ওভারপাস থেকে নামা গাড়িগুলো নাবিস্কোর ইউটার্ন ঘুরে তেজগাঁও সাতরাস্তার দিকে যেতে হতো।
এতে সুফল না পাওয়ায় কিছুদিন পর এসব ক্রসিং আবার খুলে দেওয়া হয়। ইউটার্নগুলো তৈরি করা হয়েছিল উত্তরার রাজলক্ষ্মীর সামনে, উত্তরা র্যাব-১ অফিসের সামনে, ফ্লাইং ক্লাব কাওলা, বনানী ওভারপাস, বনানী আর্মি স্টেডিয়ামের সামনে, বনানী চেয়ারম্যানবাড়ী, মহাখালী আমতলী, মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে, তেজগাঁও নাবিস্কো মোড় এবং তেজগাঁও সাতরাস্তার বিজি প্রেস এলাকায়।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়েছে-এটা বলা যাবে না। কোথায় কোথায় ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে, তা দেখার জন্য প্রকৌশলীদের বলা হয়েছে।
ইউটার্ন প্রকল্পের পরিচালক ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুব আলম বলেন, ইউটার্ন থেকে যানজটের সুফল পেতে হলে সেখানে রাস্তার প্রশস্ততা থাকতে হবে অন্তত ২০০ ফুট। যেসব স্থানে রাস্তা প্রশস্ত, সেখানকার ইউটার্নগুলো যানজট নিরসনে সুফল এনেছে। যেখানে প্রশস্ততা কম, সেখানে সমস্যা হচ্ছে।
জবাবদিহি না থাকার কারণেই অকার্যকর এমন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সামছুল হক। তিনি বলেন, উন্নত দেশে সড়কের চেয়ে ফুটপাত চওড়া। অথচ ফুটপাত সংকুচিত করে ইউটার্ন তৈরি করা হয়েছে। ভুল পরিকল্পনায় তৈরির কারণে জনগণের টাকার অপচয় হয়েছে। এসব ইউটার্ন দিয়ে আসলে রাজধানীর যানজটের সমাধান হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন