বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে শিক্ষকদের মর্যাদা

ড. মো. কামরুজ্জামান | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০২২, ১২:০৩ এএম

একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা দেন এই কথা বলে যে, ‘সদা সত্য কথা বলিবে, কখনও মিথ্যা বলিবে না’। বর্তমান সময়ে শিক্ষকের এ উপদেশ একবারেই মূল্যহীন। কারণ দেশে সত্য কথার কোনো দাম নেই। অনুরূপভাবে একজন শিক্ষক ক্লাসে পাঠ দান করেন এই বলে যে, ‘চুরি করিবে না, চুরি করা বড়ো দোষ। চুরি করিলে সকলেই তাকে চোর বলিয়া ঘৃণা করে’। আমাদের সমাজে এই নীতি কথাটিরও কোনো মূল্য নাই। কারণ দেশের বাস্তব চিত্রটি এর সম্পূর্ণ উল্টো। দেশে এখন চলছে চুরি করার মহোৎসব। রিলিফ চুরি, বালিশ চুরি, পর্দা চুরি, রাষ্ট্রের টাকা চুরি, ব্যাংকের টাকা চুরি ইত্যাদি এখন দেশের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। চুরি করা ছাড়া বড়ো লোক হওয়া যায় না। চুরিতেই সকল সুখ নিহিত। সমাজে যে যতো বড়ো চোর সে ততো বড়ো ক্ষমতাশালী। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠ দেন এই কথা বলে যে, ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ, তাই দেশকে ভালবাসিবে’। দেশে এ কথাটিরও কোনো মূল্য নেই বলে দিবালোকের মত স্পষ্ট। কারণ স্বাধীনতার ৫০ বছর ধরেই দেশের পরিচালক ছিলেন দেশপ্রেমিক রাজনীতিকগণ। তারা দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতে বিভোর থাকেন সারাক্ষণ। কিন্তু তাদেরই ছত্রছায়ায় এ দেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান হয়েছে একাধারে ৫ বার। ২০২২ সালেও এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। এছাড়া তাদেরই শাসনামলে প্রতি বছর দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে ৭৮ হাজার কোটি টাকা। ১ মে ২০২২ সময় টেলিভিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ সালে বাংলা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল সময়ে অর্থাৎ এ ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে, ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ তালিকায় সর্বশেষ যোগ হয়েছে পিকে হালদারের পাচারকৃত কয়েক হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, শাসকদের দেশপ্রেমের অভাবেই দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হওয়া সম্ভব হয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, রাষ্ট্র পরিচালকদের কেউ না কেউ এ পাচারের সাথে জড়িত আছে। আর অর্থনীতি সমিতির মতে, দেশে গত ৫০ বছরে কালো টাকার পরিমাণ ৮৮ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এ সব ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রে শিক্ষকের গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। রাষ্ট্রের কাছে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের দেয়া পাঠদানের মূলত কোনো মূল্যই নাই। অপরাধী ব্যক্তিরাই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড়ো পদে সমাসীন। এ অসৎ লোকটাই সমাজের সবচেয়ে বড় প্রতাপশালী ও ক্ষমতাবান। রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা তাদের হাতেই ন্যস্ত। তাছাড়া হাতের ইশারাতেই চলে থানা, পুলিশ, কোর্টকাছারি ও আইন আদালত। তাদের হাতে যেমন রাষ্ট্র নিরাপদ না, ঠিক তেমনি নিরাপদ নয় শিক্ষকের মর্যাদা। তাদের ক্ষমতার কাছে নতজানু হয়ে একজন শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করতে হয়। অনৈতিক ক্ষমতাশালী রাজনীতিক ও কর্মচারীরা একজন শিক্ষককে দিয়ে পা ধরাতেও দ্বিধা করেন না। আইন প্রণেতারা তাদের কান ধরে উঠবস করাতে পারেন। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের চেয়ে অসহায় জীব দ্বিতীয়টি আর নেই।

বাংলাদেশের এসব চিত্র এটাই জানান দেয় যে, শিক্ষকদের মত অপ্রয়োজনীয় আর গোষ্ঠি নেই। যাদের হাতে লাঠি আছে, ডান্ডা আছে দেশের মানুষ তাদেরকেই তোয়াজ করে চলে। তাদের চামচামি ও তেলবাজিতে সুবিধাভোগিরা ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ। দূর অতীতে বাংলাদেশে শিক্ষক সমাজ ছিলেন সমাজের দর্পণ। সব সময় সকল শ্রেণির মানুষের কাছে শিক্ষকরা ছিলেন সম্মানিত। নিকট অতীতেও তারা সম্মান পেয়ে আসছিলেন। প্রাচীন বাংলায় মক্তব, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকরা শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সম্মানের বিষয়টি ছিল সবার উপরে। বাড়ির গৃহ শিক্ষকের সম্মানটাও ছিল যে কোনো পেশাজীবের চেয়ে অনেক বেশি। সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে শিক্ষকরা ছিলেন অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। তারা তাদেরকে এভাবে মূল্যায়ন করতেন যে, শিক্ষকরা শ্রেষ্ঠ বলেই তারা শিক্ষা দিতে পারছেন এবং দিচ্ছেন। কিন্তু অতি সাম্প্রতিককালে সমাজে এ অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাছে শিক্ষকসমাজ নানাভাবে অবহেলিত। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্যতানে হেনস্তার শিকার এদশের সম্মানি অগনিত শিক্ষক। যদিও এসব শিক্ষকের কাছে তাদের সন্তানরা পাঠ গ্রহণের জন্য গমন করে থাকে। এমনকি এসব নাজেহালকারী কর্মচারীরাও এক সময় এসব সম্মানিত শিক্ষকেরই ছাত্র ছিলেন । কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তারা শিক্ষকদের ন্যূনতম সম্মানটুকু দিতেও কৃপণতা করেন।

বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। এখনকার যুগকে বলা হয় ডিজিটাল যুগ। ডিজিটাল যুগের মানুষও বড্ড ডিজিটাল হয়ে গেছে। শর্টকাট পন্থায় মানুষ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। দুই দশক আগে থেকে মানুষের মাঝে এক অদ্ভুত আচরণ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ অকারনে অস্থির এবং জাগতিক হয়ে পড়েছে। আর এটা শুরু হয়েছে ইন্টারনেটের ঊষালগ্ন থেকে। ইন্টারনেটের এ প্রভাব মানুষের মনোজগতে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। ফলে মানুষের চিন্তাধারায়ও দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এ সময় থেকে বাংলাদেশের সকল ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে মারাত্মক নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাব। রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে রাজনীতি হয়ে গেছে মূল্যায়নের মাপকাঠি। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে অনৈতিক তেলবাজি, দলবাজি ও ঘুষের লেনদেন। অর্থ আর ক্ষমতা হয়ে পড়েছে মর্যাদার মাপকাঠি। প্রাচীন বাংলায় ঘুষ, দুর্নীতি এবং অবৈধ আয়কে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। এখন ঘুষ এবং অবৈধ আয়কে আর ঘৃণার চোখে দেখা হয় না। অবৈধভাবে ধনী হওয়া ব্যক্তিকেই সমাজের মানুষ এখন নেতা বানায়।

সামাজিক বঞ্চনার সাথে সাথে শিক্ষকদের জীবনে এখন যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় লাঞ্চনা। সুতরাং বর্তমানে একজন শিক্ষকের অবস্থা কী হতে পারে তা শুধুমাত্র একজন ভুক্তভোগী শিক্ষকই বোঝেন। আর কোনো দেশে যখন দুর্নীতি হয়ে পড়ে স্বাভাবিক বিষয় তখন সে দেশে ‘জ্ঞানই শক্তি’ কথাটি অর্থহীন হয়ে পড়ে। সে দেশে তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে ‘মানি ইজ পাওয়ার’, ‘মানি ইজ এভরিথিং’, ‘মানি ইজ গড’ ইত্যাদি। এমতাবস্থায় দেশের মানুষ তখন টাকার পিছনে দৌড়ায়, টাকার নেশায় ঘোরে ও টাকার ধান্ধায় ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আমাদের দেশের ছোট শিশুরাও আজ লেখাপড়া শিখছে ভবিষ্যতের টাকাওয়ালা বড়লোক হওয়ার জন্য। শিশুটি এখন আর ভালো মানুষ হওয়ার জন্য লেখাপড়া করে না। দেশের সেবার জন্য কিছু শেখে না। ছোটো বেলা থেকেই শিশুটি বড়ো হচ্ছে টাকা অর্জনকারী ধান্ধাবাজ হিসেবে। বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ তাই এখন ব্যস্ত টাকা ধরতে। তবে এ প্রতিযোগিতায় পিছনের সারিতে রয়েছেন শিক্ষকরা। বাংলাদেশে ক্ষমতাশালীদের তালিকায় একজন শিক্ষকেরও নাম খুজে পাওয়া যাবে না।

সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি শিক্ষকতা মানে বিলিয়ে দেয়া। শিক্ষকতা মানে নিজ জ্ঞানের সর্বস্ব শিশুদের মাঝে অকৃত্রিমভাবে বিতরণ করা। শিক্ষকতা শুধুমাত্র পেশা ছিল না, ছিল ব্রত। আমার বাবাকে দেখেছি অজপাড়া গাঁয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে শুধু তিনি জ্ঞান বিতরণ করতেন। সকলেই তাকে মাস্টার হিসেবে ডাকতো। বিনিময়ে তিনি এক-দুই টাকা মাইনে পেতেন। আর ব্যক্তি বিশেষের কাছ থেকে সর্বোচ্চ মাইনে পেতেন ১০ টাকা। অনেকে বাবার কাছে ফ্রি বিদ্যা গ্রহণ করতো। বিনিময় বলতে বাবাকে শুধু আত্মতৃপ্তি পেতে দেখেছি। এসময় একজন শিক্ষক প্রতিদিন জ্ঞানের মশাল ছড়িয়ে বেড়াতেন। অকাতরে তিনি জ্ঞানের আলো বিতরণ করতেন। শিক্ষকগণ পরম মমতায় ছাত্রদেরকে বড়ো করে তুলতেন। তারা তাদেরকে আদর করতেন, সোহাগ করতেন, করতেন শাসন। ফলে তারা গড়ে উঠতো ভালো মানুষ হিসেবে।

আর যে সমস্ত শিক্ষক সরকারি স্কুলে চাকরি করতেন তারা নামমাত্র মাইনে পেতেন। এ সামান্য বেতন দিয়ে তিনি অর্ধাহারে, অনাহারে দিনাতিপাত করতেন। তথাপিও সমাজে তাদের সম্মান ছিল আকাশচুম্বি। কারণ তখন অর্থের বিবেচনায় সম্মান নির্ধারণ হতো না। বলা হয়ে থাকে, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। সুতরাং শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড তাহলে শিক্ষক হবেন ঐ মেরুদন্ড গড়ার কারিগর। সেই কারিগরদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার একটি চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো:

দেশের শিক্ষা কারিকুলামের মৌলিক ও প্রথম কারিগর হলেন প্রাথমিকের শিক্ষকগণ। প্রাথমিকের সম্মানিত শিক্ষকগণ শিশুদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখান। আজকের শিশুই আগামী দিনের রাষ্ট্রপরিচালক। কিন্তু সেই প্রাথমিকের শিক্ষকের মর্যাদা দেশে সবচেয়ে তলানিতে। বাংলাদেশে সরকারি অফিসের একজন পিওনেরও নিচে অবস্থান করছে তাদের মর্যাদা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করে একজন শিক্ষার্থী চাকরি করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি জয়েন করেন ১৪ নম্বর গ্রেডের বেতনে। বেতন পান সর্বসাকুল্যে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। ১২ বছর চাকরি করার পরে সর্বসাকুল্যে তার বেতন হয় ২৪ হাজার টাকা। জাতীয় গ্রেডে মর্যাদার বিচারে তিনি তৃতীয় শ্রেণির।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পিয়ন ও টাইপিস্টদের নিয়োগযোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাস। মর্যাদার ক্ষেত্রে তারাও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। অথচ তাদেরকে বেতন দেয়া হচ্ছে ১২তম গ্রেডে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটরের নিয়োগযোগ্যতা এসএসসি অথবা এইচএসসি পাস। কিন্তু তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে দশম গ্রেডে! অথচ প্রাইমারিতে নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষক গ্রাজুয়েশন পাস। তারা বেতন পান পিওন এবং টাইপিস্টদের নিম্নের স্কেলে!

অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতনের পার্থক্য রয়েছে ব্যাপক। এ বৈষম্য বিগত ৫০ বছর ধরে চললেও এটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। এ বৈষম্য দূর করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগও নাই। দিনে দিনে এ বৈষম্য তীব্র থেকে তীব্র আকার ধারণ করছে। একজন সরকারি প্রাইমারি স্কুলের অষ্টম শ্রেণি পাস পিয়নের বেতন যেখানে ১৫৭১২ টাকা। সেখানে বেসরকারি স্কুলের এমপিওভুক্ত একজন গ্র্যাজুয়েট শিক্ষকের বেতন সর্বসাকুল্যে ১৪ হাজার টাকা! প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক শুরুতে সর্বসাকুল্যে বেতন পান ১৬ হাজার টাকা। অন্যদিকে একজন বেসরকারি কলেজের শিক্ষক বেতন পান ২২ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া পান এক হাজার টাকা। চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। একই পদে সরকারি কলেজের একজন প্রভাষক মূল বেতন পান ২৩ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া পান মূল বেতনের ৪০ শতাংশ। মানে ৯ হাজার ২০০ টাকা। চিকিৎসা ভাতা পান ১৫০০ টাকা। সর্বসাকুল্যে তিনি বেতন পান ৩৩ হাজার ৭০০ টাকা। সরকারি কলেজে একজন সহকারী অধ্যাপক পাঁচ বছর চাকরি করলে সর্বসাকুল্যে তিনি বেতন পান ৭০ হাজার টাকা। পর্যায়ক্রমে তিনি সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। কিন্তু বেসরকারি কলেজে সহকারী অধ্যাপকের পরে আর কোনো পদোন্নতি নাই! বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উৎসব ভাতা দেয়া হয় ২৫ শতাংশ। বিপরীতে কর্মচারীদের উৎসব ভাতা দেয়া হয় ৫০ শতাংশ। হাই স্কুলে বর্তমানে বিএড কোর্স ধারীদের বেতন শুরু ১৬ হাজার টাকা দিয়ে। দশ বছর পর তাদের বেতন হয় ২২ হাজার টাকা। আর ১৬ বছর পর তাদের বেতন বৃদ্ধি হয়ে নির্ধারিত হয় মাত্র ২৩ হাজার টাকা। অথচ বর্তমানে দেশে এমপিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৯ হাজার। আর দেশে সরকারি হাই স্কুলের সংখ্যা ৫৫৬টি। আর সরকারি কলেজ সংখ্যা ৫৯৮টি। এ তথ্য এটাই প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের শিক্ষাখাত পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারিভাবে। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন উচ্চ শিক্ষিত অনেক যোগ্য ব্যক্তি, যাদের অনেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোষ্ট গ্রাজুয়েশন প্রাপ্ত। এ সমস্ত যোগ্য ব্যক্তিরা বৈষম্যমূলক শিক্ষার কারণে বঞ্চিত। সরকারের অবহেলা উদাসীনতা আর নানা বৈষম্যের কারণে তারা আজ হতাশাগ্রস্ত। অথচ তারাই না আমাদের সন্তানদেরকে আদর করে মানুষ করছেন! তারাই না আমাদের সন্তানদের দেশের কারিগর হিসেবে গড়ে তুলছেন! ছোটবেলা অনেক শিক্ষককে গল্প করতে শুনতাম, তাদের তিন মাসের বেতন বাকি। তাদের ঘরে চাল নেই, চুলা নেই। তাদের অনেককে তাই টিউশনি করতে হয়, করতে হয় হাল চাষ। এমতাবস্থায় তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। স্কুল এবং মাদ্রাসায় আসার আগে যেখানে একজন শিক্ষকের প্রয়োজন হয় পাঠপ্্রস্তুতির, প্রয়োজন যেখানে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া, ঠিক তখন তিনি চলে যান ধান ক্ষেতে অথবা সবজির মাঠে। মাঠ থেকে ফিরে শিক্ষক তাড়াহুড়া করে ক্লাসে আসেন। এমতাবস্থায় ঐ শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে কী শেখাবেন? তিনি শিক্ষার্থীদেরকে কী পাঠ দান করবেন? আর দক্ষ কারিগরই বা কীভাবে গড়ে তুলবেন?

বেসরকারি স্কুলের এমপিও ভুক্ত একজন শিক্ষকের বেতন সাড়ে ১২ হাজার টাকা। আর এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজের শিক্ষকের বেতন ২২ হাজার টাকা। মাসে তিনি চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা এবং বাড়ি ভাড়া পান এক হাজার টাকা। সংসার যদি ছোট হয় তাহলে টেনে টুনে চলা যায়। আর পরিবার বড় হলে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। চাকরিটি গ্রামে হলে আলু ভর্তা খেয়ে দিন কাটানো গেলেও শহরে থাকলে বড়ই বিপদ। শহরে যদি বাড়ি ভাড়া দিতে হয় তাহলে তার এ বেতনে দশদিন চলা দায়! এমতাবস্থায় একজন শিক্ষককে বাকি দিন চালাতে করতে হয় টিউশনি। জড়িয়ে পড়তে হয় তাকে কোচিং বাণিজ্যে! চাকরি জীবনে তাদের প্রমোশন নাই; নাই মোটিভেশন। সুতরাং তাদের একাডেমিক ক্যারিয়ার উজ্জ্বল হবে কী করে? দেশে শিক্ষার্থীদের উন্নতি হলেও শিক্ষকরা থেকে যাচ্ছেন বঞ্চিত ও অবহেলিত।

দেশে জ্ঞান-গবেষণার সর্বেচ্চ কারিগর হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। দেশে তাদের মর্যাদার অবস্থান আরো শোচনীয় পর্যায়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে অষ্টম পে স্কেলটি ছিল সরকার ঘোষিত সবচেয়ে সম্মানজনক স্কেল। সপ্তম পে স্কেলে একজন প্রফেসরের মর্যাদা ছিল সচিবের সমতুল্য। কিন্তু ঘোষিত অষ্টম পে স্কেলে এ পদটিকে পাঁচ ধাপ অবনমন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদাকে ভুলুন্ঠিত করা হয়েছিল। হারানো এ মর্যাদা ফিরে পেতে শিক্ষকসমাজকে শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে রাজপথে আন্দোলন করা লাগছিল! নানা মিটিং, সিটিং-এর মাধ্যমে হারানো পদটি ফিরে পাওয়া গেলেও আমলাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল আরো দুটি পদ। বাংলাদেশে এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী ই বা হতে পারে! প্রথম থেকে তৃতীয় ধাপের সরকারি কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা পান। গাড়ি কেনার জন্য সুদমুক্ত ২৫ লক্ষ টাকা ঋণ পান। এ গাড়ি সংরক্ষণের ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৪৫ হাজার টাকা পারিতোষিক পান। ভৃত্য ভাতা পান মাসে ৩ হাজার টাকা। এছাড়া আছে আপ্যায়ন ভাতা, টেলিফোন ভাতা ইত্যাদি যার কোনো কিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পান না।

বাংলাদেশে শিক্ষকদের অবস্থা যখন তলানীতে ঠিক তখন বিশ্বের কয়েকটি দেশের শিক্ষদের মর্যাদার চিত্র নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

দক্ষিণ কোরিয়ায় একজন সরকারি কর্মকর্তার কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। যিনি আমাদের দেশের বিসিএস ক্যাডারভুক্ত নবম গ্রেডের একজন অফিসার। তিনি চাকরি শুরু করেন বাংলাদেশী টাকার ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা বেতন দিয়ে। আর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার চাকরি শুরু করেন ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা দিয়ে। উক্ত সরকারি কর্মকর্তা চাকরি জীবনের শেষ দিকে বেতন পান চার লাখ পাঁচ হাজার টাকা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উক্ত লেকচারার চাকরি জীবনের শেষ দিকে বেতন পান ৫ লাখ ৬ হাজার টাকা। উক্ত সরকারি কর্মকর্তা সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন কাজ করেন এবং উক্ত চাকরির বাইরে অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ পান না। ফলে আয়ের ও কোনো সুযোগ তিনি পান না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন অফিস করেন। বাকি দিনগুলোতে তারা প্রজেক্ট বা অন্য কোনো গবেষণায় সময় ব্যয় করেন। যা থেকে তিনি আয় করেন বেতনের চেয়েও বেশি। দেশের বিখ্যাত কোম্পানিগুলোর বড়ো বড়ো কর্মকর্তাদের ট্রেনিং দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ। তারা এ ট্রেনিং-এ সময় দেন তিন থেকে চার ঘন্টা। আর এ সময়ে আয় করেন ৮০ হাজার থেকে এক লাখ দশ হাজার টাকা। কোরিয়াতে যারা মাস্টার্সধারী কিংবা পিএইচডিধারী তাদেরকে কোরিয়ার মানুষেরা গড বলে ডাকে। এ সমস্ত গড যা করতে চান কোরিয় সরকার সেটা দিতে সদা প্রস্তুত থাকেন।
বেতন তুলনা ও ক্যারিয়ার সংস্থানবিষয়ক ওয়েবসাইট স্যালারি এক্সপ্লোরার›এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারের বেতন ২২ হাজার টাকা। ভারতে এই পদটি নাই। সেখানে চাকরী শুরু হয় সহকারি অধ্যাপক পদ দিয়ে। আর তাদের মূল বেতন ধার্য শুরু হয় ৫৯,৬০৩ টাকা। আর বাংলাদেশে একজন সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন ৩৫,৫০০ টাকা। বাংলাদেশে একজন সহযোগী অধ্যাপকের মূল বেতন ৫০ হাজার টাকা। আর ভারতের একজন সহযোগী অধ্যাপকের মূল বেতন ২ লাখ ১৫ হাজার ১৪২ টাকা। বাংলাদেশে একজন অধ্যাপকের মূল বেতন ৬৪ হাজার ৬০০। আর ভারতের একজন অধ্যাপকের মূল বেতন ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৪৮ টাকা। বাংলাদেশের প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত। এ সমস্ত শিক্ষকগণ বাংলাদেশের ১৩তম গ্রেডে যোগদান করে মূল বেতন পান ১১ হাজার টাকা। ঠিক একই পদে যোগদান করে ভারতের একজন শিক্ষক পান ৩০ হাজার টাকা। বাংলাদেশ এমপিও ভুক্ত হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষকগণ ১২৫০০ টাকার মূল বেতন নিয়ে চাকরিতে যোগদান করেন। দেশের প্রায় সাত হাজার নন এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা আশি হাজার। তারা সরকারি কোনো বেতন ভাতা পান না। অনার্স এবং মাস্টার্স কলেজের প্রায় ৫৫০০ শিক্ষক সরকারি বেতন ভাতা থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে স্বতন্ত্র মাদ্রাসার ২০ হাজার শিক্ষক তারাও সরকারি বেতন ভাতা থেকে বঞ্চিত।

ঠিক এই মুহূর্তে আমেরিকার সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়া প্রফেসরের নাম ডেভিড সিলভারস। যিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তার সর্বসাকুল্যে বার্ষিক বেতনের পরিমাণ ৪.৩৩ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ হিসেবে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭ কোটি। এর অর্থ তার মাসিক আয় দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৮ কোটি টাকা। আমেরিকার মানসম্পন্ন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের বার্ষিক গড় বেতন দুই কোটি টাকার বেশি। একজন সহযোগী অধ্যাপকের বার্ষিক গড় বেতন এক কোটি ৫০ লাখ। আর একজন সহকারি অধ্যাপকের বার্ষিক গড় বেতন ১ কোটি টাকার উপরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রারম্ভিক পদ হলো সহকারী অধ্যাপক। সেখানে লেকচারার নামে কোনো পদ নাই। (সূত্র: ংঃন.পড়স.নফ, ১৮ ঘড়াবসনবৎ, ২০২০)
পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্রারম্ভিক পদ সহকারী অধ্যাপক দিয়ে। সে দেশে একজন সহকারী অধ্যাপক বেতন পান ১ লাখ ৩১ হাজার ৪০ টাকা থেকে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৯০ টাকা। একজন সহযোগী অধ্যাপক বেতন পান ১ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬০ টাকা থেকে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৫৫০ টাকা। আর একজন অধ্যাপক বেতন পান ২ লাখ ৯৪ হাজার ৮৪০ টাকা থেকে ৫ লাখ ১১ হাজার ৫৬ টাকা।
দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে সার্কভ’ক্ত আটটি দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় শিক্ষকদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি ভালো। কারণ সেখানে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে স্কেল রয়েছে। শ্রীলংকার একজন সিনিয়র অধ্যাপক বেতন পান ১ লাখ ৪ হাজার ২৯৬ টাকা। আর এ বেতনের ৯০ ভাগ তথা ৯৩ হাজার ৮৬৬ টাকা ভাতা পেয়ে থাকেন অধ্যাপকগন। পাশাপাশি সেদশের অধ্যাপকগন শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার সুযোগ পেয়ে থাকেন। প্রতি পাঁচ বছর পর পর তারা গাড়ি কেনার এ সুযোগ পেয়ে থাকেন। শ্রীলঙ্কাতে একজন সহযোগী অধ্যাপক বেতন পান ৮০ হাজার ১২৯ টাকা। পাশাপাশি মূল বেতন থেকে ৯০ ভাগ তথা ৭২ হাজার ১১৬ টাকা ভাতা পেয়ে থাকেন। একজন সিনিয়র লেকচারার শ্রীলঙ্কাতে বেতন পেয়ে থাকেন ৬৬ হাজার ৬৪৭ টাকা। এসব সিনিয়র লেকচারারগন মূল বেতনের ৮৫% তথা ৫৬ হাজার ৬৫০ টাকা ভাতা পেয়ে থাকেন। আর লেকচারারগন বেতন পান ৪৯ হাজার ৯৫ টাকা। তারা মূল বেতনের ৮০ শতাংশ তথা ৩৯ হাজার ২৭৬ টাকা ভাতা পেয়ে থাকেন। (jugantor.com, 23 may 2022)
পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষকের মর্যাদা কথাটা বাংলাদেশের অভিজাত শ্রেণির কাছে একটি তামাশার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাদের কাছে শিক্ষকের পদমর্যাদা একটি মিথ্যা ফানুস ছাড়া আর কিছুই নয়। শিক্ষকের মর্যাদা অনেকটা গরিবদের ইজ্জতের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সমাজে গরীবদের কোনো ইজ্জত থাকতে নেই! সম্মান থাকতে নেই! আর বাস্তবেই সেটা বাংলাদেশে নেই।

লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
dr.knzaman@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Monirul Islam ২৯ মে, ২০২২, ৫:৪৬ এএম says : 0
অসম্ভব তথ্য ভিত্তিক লেখা পড়ে অজানা অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ স্যারকে। মন থেকে স্যারেরজন্য দোয়া রইলো
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন