দেশে খাদ্য নিরাপত্তা, সুষম পুষ্টি, বেকার সমস্যা সমাধান ও আত্মকর্মসংস্থান,বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে প্রাণিসম্পদ খাতকে চিহ্নিত করেছে সরকার। এ খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি’তে প্রাণিসম্পদের অবদান ছিল ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। কৃষিজ জিডিপি’তে প্রাণিসম্পদ খাতে অবদান প্রায় ১৩ দশমিক ১০ ভাগ। ডেইরি উন্নয়ন খাতে প্রতিবছর জিডিপি বেড়েই চলেছে। কিন্তু ডেইরি অবকাঠামো উন্নয়ন খাত এখনো পিছিয়ে আছে।
এদিকে প্রাণিসম্পদ খাত উন্নয়নে ৫০ কোটি ডলার বা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে একটি ঋণচুক্তি সই হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ২০২৩ সালে শেষ হবে। কিন্তু ডেইরি খাতের অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে কিছু হচ্ছে না। আগামী ৫ বছরে দেশে দুধ ও গোশতের উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রাণিসম্পদের মধ্যে গরু, মহিষ, ছাগল এবং ভেড়া উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি প্রদর্শনীতে খামারীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টিতে নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে বাস্তবায়নাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পটি অধিদফতর এবং মন্ত্রণালয়ের একটি ফ্লাগশিপ প্রকল্প যেখানে মোট বিনিয়োগ ৪২৮০ কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংক থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা নিয়েছে। যা দেশের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়নে সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চীফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী ইনকিলাবকে বলেন, আগে ভারত থেকে গরু না আসলে আমাদের কোরবানীর ঈদে সমস্যা দেখা দিতো। কিন্তু এখন আর সে সমস্যা নেই। আমাদের দেশের জনগণ নিজেরাই বাড়িতে গরুর ফার্ম দিয়ে গরুর উৎপাদন বৃদ্ধি করছে। সে কারণে আমরা ডেইরিতে এগিয়ে আছি। আগামীতে আরো এগিয়ে যবো। তিনি বলেন, আমরা অবকাঠামো উন্নয়নে পিছিয়ে আছি। কারণ এগুলো করতে সব সময় বিদ্যুৎ থাকার প্রয়োজন। সে কারণে পিছিয়ে। তিনি বলেন, আমরা এক সময় বিদ্যুৎ পেতাম না, এখন আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি হতো। আগামীতে ডেইরি অবকাঠামো উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আওতায় ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি-উন্নয়ন’ (দ্য লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট-এলডিডিপি) শীর্ষক এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ এরই মধ্যে শুরু করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ৪ হাজার ২৮০ কোটি ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকার এ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে। এ অর্থের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকার বেশি। বাকি টাকা দিচ্ছে সরকার। পার্বত্য ৩টি জেলা ছাড়া দেশের ৮ বিভাগের ৬১টি জেলার সব উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পটির মূল কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রাণিসম্পদ খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং উদ্ভাবন, উৎপাদক গ্রুপ প্রতিষ্ঠা, জলবায়ুর স্মার্ট-উৎপাদন কৌশলের উন্নয়ন এবং মার্কেট-লিঞ্চকজ এবং ভ্যালুচেইনের উন্নয়নে বিনিয়োগ। প্রান্তিক খামারির মধ্য থেকে গর্ভবতী অবস্থায় ৪ হাজার গরুকে ১০০ দিনের খাবার (ক্যাটল ফিড) বিনামূল্যে দেয়ার জন্য বরাদ্দ ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রতিটি গরুর পেছনে খাবারের বরাদ্দ ২৪ হাজার টাকা। মাঠকর্মীরা সাইকেলে বহন করতে পারবেন এমন কিটবক্স কেনার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। প্রতিটি কিটবক্সের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার টাকা। দেশের ১ হাজার ৮৬০টি স্থানে গরু-ছাগলের প্রদর্শনী করা হবে। এতে ব্যয় হবে ৪৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা। প্রতিটি প্রদর্শনীর পেছনে ব্যয় হবে ২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। দেশের ২ হাজার স্কুলে দুগ্ধজাত পণ্যের প্রদর্শনীতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। প্রতিটি প্রদর্শনীর জন্য ব্যয় হবে ১০ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। কোনো পশু বা মানুষের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে যা একটি ঘূর্ণায়মাণ যন্ত্রের মধ্যে রাখা হয় যেটি সেন্টার ফিউজ নামে পরিচিত। একটি সেন্টার ফিউজের দাম ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ২৮০ টাকা। এ ধরনের ১৯টি সেন্টার ফিউজ কেনা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এদিকে তরলের অম্লতা পরিমাপের যন্ত্র পিএইচ মিটার, অটোক্লেভ মেশিন, ডিজিটাল মাইক্রোসকপির (অণুবীক্ষণ যন্ত্র) দিয়ে কাজ চলছে। উপজেলা শহরে যেসব গোশত বিক্রির অবকাঠামো রয়েছে, তা সংস্কারে ব্যয় করা হবে ৪১১ কোটি টাকা। ১৯২টি উপজেলা শহরের গোশতের দোকান সংস্কারে এ ব্যয় করা হবে। প্রতিটির পেছনে ব্যয় হবে ২ কোটি ১৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা। অথচ এ অর্থ দিয়ে নতুন করেই এমন অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। এ বিষয়টি রাখা হয়নি।
প্রাণিজাত পণ্যেরে উৎপাদন বৃদ্ধি, নিরাপদ প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদন এবং বেসরকারী উদ্যোক্তাগণের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নির্ধারিত এলাকায় প্রাণিসম্পদ খাতে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন। উন্নত খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ, প্রাণিস্বাস্থ্য এবং কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করণের মাধ্যমে খামারী পর্যায়ে বিদ্যমান প্রতিটি গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা ২০% বৃদ্ধি করা। ৫৫০০০ প্রাণিজাত পণ্য উৎপাদনকারী সমিতি (প্রডিউসার অর্গানাইজেশন) গঠন এবং পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের সহিত সমন্বিতভাবে চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
প্রয়োজনীয় সরবরাহের মাধ্যমে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন, দক্ষতা অর্জন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, নিরাপদ প্রাণি ও প্রাণিজাত পণ্য উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন