পূর্বে প্রকাশিতের পর : সেখানে কুরআন মাথায় নিয়ে বুকে লাগিয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতাম’। তার এই দোয়া কবুল হয়েছিল। ১৯২০ সালের দিকে ভারতবর্ষে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি কলকাতা থেকে দরবারে থানবী রহ. উপস্থিত হন। এখানে একটি দুই মাসের অধিককাল অবস্থা করে আধ্যাত্মিকতার তালিম গ্রহণ করেন। অতপর নিজের শায়েখ ও মুর্শিদ থানবী রহ. এর পরামর্শে মাজাহিরুল উলুমে ভর্তি হয়ে যান। গভীর মনোযোগের সাথে চার বছর লেখাপড়া করেন। অতপর দেওবন্দে চলে যান। দেওবন্দেও চার বছর পড়ালেখা করেন। তিনি হাদিস ফিকাহ তাফসির মানতেক নাহু সরফসহ সব বিষয়ে বূৎপত্তি অর্জন করেন।
আধ্যাত্মিকতার তলব: সাহারানপুর ও দেওবন্দ অধ্যয়নকালে তিনি আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য প্রতি বৃহস্পতিবার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে থানাভবনে গমন করতেন। সেখানে জাহেরী ইলমের সাথে সাথে বাতেনী ইলমও শিক্ষা লাভ করতে থাকেন। অবশেষে উভয় জ্ঞানে পরিপূর্ণ কামেল মানুষ হয়ে ১৯২৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। মুফতি আমিনি রহ. বলেন- ফরিদপুরী রহ. উভয় লাইনে শতাব্দির শ্রেষ্ট মানুষ ছিলেন। ইলম ও জ্ঞান বিজ্ঞান আধুনিক শিক্ষায় তিনি ছিলেন যুগের গাযালি ও রাযির ন্যায়, আর আধ্যাত্মিকতা ও তাসাউফের লাইনে তিনি যুগের জুনায়েদ বাগদাদী ও শিবলীর ন্যায়।
কর্মক্ষেত্র ও মাদরাসার তৈরির বিপ্লবী ধারা: ফরিদপুরী রহ. ১৯২৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। উস্তাদদের পরামর্শে তিনি প্রথমে বিবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়ায় ‘ছদরুল মুদাররিসিন’ পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফরিদপুরী রহ. স্বপ্ন দেখতেন প্রতিটি গ্রামে একটি করে কুরআনি মকতব আর জেলা শহর ও মফস্বল শহরে একটি করে দাওরা হাদিস মাদরাসা প্রতিষ্ঠার। সেই স্বপ্ন তাকে ইউনুসিয়ায় বেশি দিত থাকতে দেয়নি। তিনি প্রথমে বাগেরহাট জেলার গজালিয়ায় একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। অতপর ১৯৩৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন হুসাইনিয়া আশরাফুল উলুম বড়কাটারা। প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন হাফেজ হুসাইন আহমদ। এই সময় ফরিদপুরী রহ. সারাদেশে ব্যাপক ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত হয়ে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার একটি বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করেন। সারাদেশের শহরে বন্দরে গ্রামেগঞ্জে আনাচেকানাচে তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। নরসিংদীর বালুয়াকন্দি ও রাধাগঞ্জ বাজার মাদরাসা তারই তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৩৭ সালে নিজ গ্রাম গহরডাঙ্গায় প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম মাদরাসা। ১৯৫০ সালে যফর আহমদ উসমানির দোয়া নিয়ে হাফেজ্জি হুজুর ও মুফতি দীন মুহাম্মাদ রহ.কে সাথে নিয়ে লালবাগ শাহী মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেন ‘জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া’ মাদরাসা। এছাড়াও ফরিদাবাদ মাদরাসা ও ফরিদপুরের খাবাশপুরের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই মাদরাসা প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী ধারা চলতে থাকে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লালবাগ জামিয়ার মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস ছিলেন।
নিয়মের কাঁটায় জীবনের গতিবিধি: ফরিদপুরী রহ. এর পূর্ণ জীবনটা এখনো কাঁটা কাঁটায় হিসেব করা যাবে। কারণ নিয়মের ডোরে তিনি তার জীবনকে বেধে রেখেছিলেন। হাজারো ব্যস্ততায় তার নিয়ম পরিবর্তন হতো না। যেখানেই থাকুক না কেন কুরআন তেলাওয়াত তাহাজ্জুদ মিছ হতো না। প্রতিদিনের বিধিবদ্ধ আমল ছিল শেষরাতের তাহাজ্জুদ। তাহাজ্জুদের পর নিন্মস্বরে নিজ কামরায় কুরআন তেলাওয়াত, কুরআন নিয়ে দোয়া ও রোনাজারি করা। ফজরের পর রুমের সামনের বারান্দায় বসে লেখালিখি করতেন সকাল আট্টা পর্যন্ত। আটটার পর নাস্তা সেরে মাদরাসার দফতরে গিয়ে মাদরাসার যাবতীয় কাজ সারতেন। এসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত লোকদের সাথে কথা বলতেন। এগাটার দিকে গোসল সেরে আরাম করতেন। যোহর আর দুপুরের খানার পর আবার দফতরে যেতেন। মাদরাসার কাজকর্ম যা আছে তা সারতেন। আছরের পর খাছ মুরিদ ও বিশেষ ছাত্রদের তালিম দিতেন। বাদ মাগরিব দরস করাতেন। এশার নামাযের পর দ্রুত খেয়ে শুয়ে পড়তেন। শেষ রাতে উঠেযেতে। রমযানের প্রথম ১৫ দিন লালবাগ দ্বিতীয় ১৫ গহরডাঙ্গায় কাটাতেন। এই রুটিনটা ছিল জীবনের শেষ দিকের। তখন হুজুর দাওরার ঘণ্টা ব্যতীত আর কোন ক্লাস করান না। তবে অন্যান্য ছাত্রদেরকে মাঝে মধ্যে আকায়েদ মানতেক ফালসাফা কিমিয়ায়ে সাদাত ও তাসাউফের উঁচুস্তরের কিতাবগুলো পড়াতেন।
জীবন ও রাজনীতি: রাজনীতি ইসলামের একটি অবিচ্ছদ্য অংশ। মুজাহিদে আযম শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. প্রাজ্ঞ আলেম আধ্যাত্মিক রাহবার ও সমাজ সংস্কারক হওয়ার পাশাপাশি একজন সচেতন বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। ১৯২০ সালে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন শরীক হন। খৃস্টান মিশনারীদের অপতৎরতা বন্ধে তিনি আপোষহীন বীরের ভূমিকা পালন করেন। খৃস্টান মিশনারীরা ‘আঞ্জুমানে তাবলীগুল কুরআন’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে। এর প্রতিবাদে তিনিই রাস্তায় নামেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রকরণে তার অবদান উজ্জ্বল ইতিহাস হয়ে থাকবে তার জীবনীতে। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারী বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে সমর্থন জানান। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক ইসলাম বিরোধী সকল তৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি কড়া হুশিয়ারী প্রদান করেন। ১৯৬৩ সালে মুসলিম পরিবার আইন’ নামে ইসলাম বিরোধী আইন জারি করতে চাইলে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে উভয় পাকিস্তানে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেন ছদর সাব রহ.। যার কারণে আইয়ুব খানের গাদী নড়বড়ে হয়ে উঠে, ফলশ্রুতিতে দ্রুত এই আইন স্থগিতাদেশ হয়। (চলবে)
লেখক : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন