অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত হলেও তা এখন যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। যানবাহনের অত্যধিক চাপ বেড়ে যাওয়ায় যানজটে পড়ে মাহসড়কটিতে প্রায়ই অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। মাইলের পর মাইল যানজট লেগে ঘন্টার পর ঘন্টা মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সময়মতো মালামাল ঢাকা ও চট্টগ্রামে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ দেশের প্রধান দুই মহানগরী এবং অর্থনীতির শতকরা ৫০ ভাগ পরিচালনাকারী ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থা মসৃণ ও দ্রুত করার জন্যই মহাসড়কটি চারলেনে উন্নীত করা হয়। এই চারলেনে উন্নীত করার সময় এর নকশায় ত্রুটি ও দূরদর্শী চিন্তার অভাব ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। সড়ক ও জনপথের নির্দেশিকায় মহাসড়কে যানবাহন চলাচল (ট্রাফিক গ্রোথ) অন্তত ১০ শতাংশ ধরার নির্দেশনা থাকলেও মহাসড়কটি চারলেনে উন্নীত করার সময় ডিজাইন ম্যানুয়েলে ট্রাফিক গ্রোথ ধরা হয়েছিল ৮ শতাংশ। এটি চালু করার সঙ্গে সঙ্গেই এই গ্রোথ ১০ শতাংশেরও বেশি হয়ে যায়। সড়ক ও জনপথের কর্মকর্তারা অনেকটা অজুহাতের সুরে বলেছেন, দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যখন চারলেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা হয়, তখন সেই সময়ের উপযোগী করে তৈরি করা হয়। এখানেই তাদের দূরদর্শী চিন্তার অভাব ফুটে উঠেছে। দ্রুত উন্নয়ন ঘটছে। দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়বে। এ চিন্তা তাদের মাথায় না থাকা দুর্ভাগ্যজনক।
মহাসড়কটি যখন চারলেনে উন্নীত করে সচল করা হয়, তখন থেকেই এর ত্রুটিপূর্ণ নকশা ও নিম্নমান নিয়ে প্রশ্ন উঠে। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করার ফলে কিছুদিনের মধ্যেই মহাসড়কের অনেক জায়গায় বিটুমিন উঠে যায় এবং পিচ ঢেউয়ের আকার ধারণ করে। গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে কেন? সাধারণত যেকোনো সড়ক-মহাসড়ক এমনভাবে নির্মাণ করা হয়, যা পাঁচ বছরের মধ্যে সংস্কারের প্রয়োজন হবে না। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি এক বছরের মধ্যেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই মহাসড়কটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তৈরির সময় ভবিষ্যতে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল তাও সঠিক ছিল না। ফলে সক্ষমতার চেয়ে বেশি যানবাহন চলাচলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার ওপর চারলেনের মহাসড়কে দুই লেনের সেতু নির্মাণ করায় যানজটের কারণে গতিও কমে গেছে। সেতু এলাকায় মহাসড়ক ‘চিকেন নেকে’ পরিণত হয়েছে। বিশ্বের কোনো মহাসড়কে এমন অসামঞ্জস্য দেখা যায় না। যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার মহাসড়কটিকে এক্সপ্রেস ওয়েতে পরিণত করার পরিকল্পনা করলেও তা আপাতত স্থগিত করেছে। এক্সপ্রেস হয়ে গেলে চারলেন আর সম্প্রসারণের প্রয়োজন হতো না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দূরদর্শী চিন্তার অভাব রয়েছে। চারলেনে উন্নীত করার সাথে সাথে এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির সুযোগ ছিল। এখন এ কাজ করা হলে বাড়তি অর্থ খরচের পাশাপাশি যথাযথ মানে তা সম্প্রসারণও কঠিন হয়ে যাবে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মহাসড়কটি চারলেনে উন্নীত করার সময় যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তাতে গলদ ছিল। মহাসড়কের এ ধরনের ত্রুটির পাশাপাশি একে কেন্দ্র করে অন্যান্য সমস্যাও বিদ্যমান। বিশ্বে মহাসড়কের ধারণা হচ্ছে, এটি হবে দ্রুত ও মসৃণ। এতে অননুমোদিত অন্যকোনো যানবাহন চলতে পারবে না। এর সঙ্গে অন্যকোনো লিংকরোডও যুক্ত হবে না। আমাদের দেশে মহাসড়কে অবাধে ধীরগতির থ্রি হুইলার চলাচল, অবৈধ দখল, বাজার বসা থেকে শুরু করে যানবাহন স্ট্যান্ডও গড়ে তোলা হয়। মহাসড়কের বৈশিষ্ট্য বলে কিছু থাকে না। এর ফলে যানবাহনের গতি কমে যাওয়া ও যানজটের যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনি চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে ভয়াবহ দুর্ঘটনাও ঘটে। মহাসড়কে কিভাবে এবং কোন গতিতে গাড়ি চালাতে হয়, এ ব্যাপারে অনেক চালকেরই সঠিক জ্ঞান এবং সেই মানসিকতাও নেই। মহাসড়কে অচলাবস্থা সৃষ্টির এটিও অন্যতম কারণ। মহাসড়ক এমন হওয়া উচিৎ, যাতে কেউ এক শহর থেকে আরেক শহরে দিনে গিয়ে দিনে ফিরতে পারে। ধারণা করা হয়েছিল, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত হলে মানুষ দিনে গিয়ে দিনে নিজ গন্তব্যে ফিরতে পারবে। এ অবস্থা সৃষ্টি না হয়ে উল্টো অতিরিক্ত সময় লেগে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম কিংবা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ফিরতে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে দুই দিন লেগে যাচ্ছে। এতে বোঝা যায়, মহাসড়ক মানুষের সময় বাঁচাতে পারছে না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, একটি মহাসড়ক বর্তমান ও ভবিষ্যতে কতটা যানবাহন ধারণ করতে সক্ষম হবে, এ বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হচ্ছে। মহাসড়ক অচলাবস্থা সৃষ্টির আরেকটি কারণ হচ্ছে, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া। বন্দর থেকে শুরু করে সড়ক ব্যবহারের সুবিধা দেয়ায় ভারতীয় অসংখ্য যানবাহন মহাসড়ক ব্যবহার করছে এবং মহাসড়কের সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার আগে বারবার আমাদের সড়ক-মহাসড়কের সক্ষমতার বিষয়টি সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সক্ষমতা না বাড়িয়ে ট্রানজিট দেয়া উচিৎ হবে না বলে সতর্ক করেছেন। সরকার বিষয়টি আমলে নেয়নি। এখন দেশের যানবাহনের পাশাপাশি ভারতীয় যানবাহন চলাচলের কারণে মহাসড়কে অচলাবস্থা এবং ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি সচল করতে হলে যানবাহনের লেন নির্ধারণ করে দেয়া উচিৎ। পণ্যবাহী, যাত্রীবাহী, হালকা ও অন্যান্য যানবাহন চলাচলের লেন নির্দিষ্ট করে দিলে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। প্রত্যেক মহাসড়কে টোল আদায় বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে। এতে সরকারের এখাতে রাজস্ব যেমন বৃদ্ধি পাবে, মহাসড়কে চাপ কমবে, তেমনি অপ্রয়োজনে কেউ যখন তখন গাড়ি নিয়ে বের হবে না। সড়ক-মহাসড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকলে অপর্যাপ্ত সড়কেও যানবাহন সুশৃঙ্খলভাবে চলতে পারে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে সচল ও মসৃণ করতে এখন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সুশৃঙ্খল করা ছাড়া বিকল্প নেই। মহাসড়ককে নির্বিঘ্ন রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সচেতন হতে হবে। যেসব জেলা ও এলাকা দিয়ে মহাসড়ক গিয়েছে, সেসব জেলা ও এলাকার কর্তৃপক্ষকে মহাসড়ক নির্বিঘ্ন করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন