শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শিশু-কিশোরদের সুরক্ষার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০২২, ১২:০৪ এএম

সমাজে এখন চরম অস্থিরতা বিরাজমান। অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি কিশোর গ্যাং প্রকট আকার ধারণ করেছে। শিশু-কিশোররাই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পদ। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রে শিশুরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত। ব্রিটেনে শিশুদের বলা হয় ছঁববহং ঈযরষফৎবহ। কারণ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধার এবং সুশিক্ষিত হিসেবে গড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের পক্ষেই একটি সৃজনশীল সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনা করা সম্ভব।

বখাটে বা Deliquent কিশোররা শুধু সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয় বরং পরিবারের জন্যও আতঙ্ক এবং একটি বোঝা। তারা ভাড়াটে খুনি হিসেবে ব্যবহার হওয়া ছাড়াও নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে পিতা, মাতা ও আত্মীয়স্বজনদের খুন করছে। সমাজ সংস্কারকগণ যুগে যুগে শিশু-কিশোরদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাগিদ ও পরামর্শ প্রদান করেছেন। কবি গোলাম মোস্তফা অনেক আবেগ নিয়ে লিখেছেন ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ কবিতার এ দুটি লাইন স্মরণ করিয়ে দেয় যে, রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য শিশুর গুরুত্ব কতটুকু। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ বখাটে হয়ে যাওয়া শিশু-কিশোরদের সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য কতটুকু দায়িত্ব পালন করছে সেটাই এখানে পর্যালোচনার বিষয়।

বিশ্ব পরিস্থিতি শিশুদের জন্য প্রতিকূল, শিশু-কিশোররাই সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীন। সম্প্রতি আমেরিকার একটি স্কুলে বুলেটের আঘাতে খুন হওয়া ২১ জনের মধ্যে ১৯ জনই শিশু। পৃথিবীব্যাপী এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। তাদের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে তাদের পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা বৃত্তিতে নিয়োজিত করা হচ্ছে। মেয়ে শিশুরা বয়স বৃদ্ধির আগেই পতিতাবৃত্তিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। শিশুদের ওপর নানাবিধ হয়রানি বন্ধ করার জন্য জাতিসঙ্ঘ ১৯২৪ সালে ‘The Declaration of the Right of the Child’ প্রণয়ন করে, যা ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘের পঞ্চম অধিবেশনে ‘শিশু অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘ পুনরায় এ সনদটিকে শিশুদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ এই সনদের ২১ এবং ১৪(১) ধারা ব্যতীত সব শর্ত মেনে চলার অঙ্গীকারে সনদের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করে।

এই সনদ মোতাবেক শিক্ষা, সুষম খাদ্য (Balance diet), স্বাস্থ্য, পুষ্টি (Nutrition), অংশীদারিত্ব, নির্মল বিনোদন, বিশুদ্ধ পানীয়, স্বাস্থ্যসম্মত মল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞানসম্মত পরিবেশ প্রভৃতি প্রতিটি শিশু-কিশোরের অধিকার। কিন্তু শারীরিক সীমাবদ্ধতা, দরিদ্রতা, সামাজিক সচেতনতার অভাব ও বৈষম্যের কারণে তারা সুষম খাদ্য, আশ্রয়, পর্যাপ্ত শিক্ষা, নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত। শিশু অধিকার সম্পর্কে ‘প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়’ একটি গবেষণা করেছে। গবেষক অধ্যাপক হারাধন কুমার মহাজন উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানের কারণে তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করে। গবেষকের মতে, তাদের মধ্যে থেকে মাত্র ৩৬ শতাংশ শিশু প্রাথমিক এবং ১০ শতাংশ শিশু মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করে। তার মতে দারিদ্র্যের কশাঘাতের জন্য মোটা দাগে শিশু-কিশোররা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অভাবগ্রস্ত পরিবারকে এটাও বিবেচনায় নিতে হয় যে, শিক্ষিত করার পরও চাকরি না হওয়ার কারণে সন্তানের বেকারত্বের অভিশাপে গোটা পরিবারকে ভুগতে হবে।

১৯২৪ সালে জাতিসংঘে প্রণীত শিশু অধিকার সনদে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও আইনগতভাবে বাংলাদেশে শিশুশ্রমের বৈধতা দেয়া হয়েছে। যেমন The Employment of Children Act’ ১৯৩৮ আইনে শিশুর বয়স ১২ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। The Factories Act’ ১৯৬৫ মোতাবেক শিশুর বয়স ১৪ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ জাতিসংঘ সনদ, শিশু আইন ২০১৩ এবং বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুর বয়স ১৮ বছর নির্ধারিত আছে। একই রাষ্ট্রে বয়সের এ বৈষম্য দূরীভূত হয়ে সমতল হওয়া বাঞ্ছনীয়। জনগণের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্র সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ :

‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়।

(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;

(খ) কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার;

(গ) যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং

(ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতা-পিতাহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।’

অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংবিধান রাষ্ট্রকে নির্দেশনা প্রদান করেছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৭তে বলা হয়েছে:

‘(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য;

(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যখাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য;

(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার প্রশ্নে সংবিধানের ১৮ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের প্রতি যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে তা নিম্নরূপ :

‘(১) জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষত আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা করিবেন।

(২) গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ১৯২৪ এবং আমাদের সংবিধানের উল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলোর মর্মার্থ যদি আমরা পর্যালোচনা করি তবে সহজেই উপলব্ধি করা যাবে যে, ভবিষ্যৎ নাগরিকদের যত্নসহকারে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্র কতটুকু দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে? সংবিধান হলো রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যে একটি চুক্তিনামা, যে চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে রাষ্ট্র বাধ্য। শিশু-কিশোররা দেশব্যাপী গ্যাং তৈরি করছে, খুন খারাবি, রাহাজানি, ছিনতাই, ধর্ষণ প্রভৃতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এ ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও সংবিধানের প্রদত্ত নির্দেশনার খুব কমই পালন করতে রাষ্ট্র সফল হয়েছে।


লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন