শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

আগুন নিয়ন্ত্রণে ধ্বংসের চিহ্ন

৩ ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ এখনো নিখোঁজ অনেকে : ৩ দিনেও মামলা হয়নি আরো ২ জনের লাশ উদ্ধার আহত ৬৩ জনের চোখে আঘাত তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আইনি কার্যক্রম : আইজিপি

শফিউল আলম/রফিকুল ইসলাম সেলিম/শেখ সালাউদ্দিন | প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীতে বেসরকারি মালিকানাধীন বিএম কন্টেইনার ডিপোর আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও এখনো পুরোপুরি নেভানো যায়নি। ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ৬১ ঘণ্টা পর গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার কথা জানান ঘটনান্থলে দায়িত্বরত সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আরিফুর ইসলাম হিমেল। আগুনের তীব্রতা কমে আসার সাথে সাথে ডিপোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আগুন ও একের পর এক বিস্ফোরণে ২৬ একর জমিতে গড়ে উঠা ওই ডিপো রীতিমত ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে। ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে আরো দুই জনের লাশের অংশবিশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। ডিপোতে মজুদ ১৩ শতাধিক কন্টেইনারে আমদানি-রফতানিমুখী হরেক পণ্যসহ হাজার কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। আশপাশের আড়াই কিলোমিটার এলাকায়ও ধ্বংসের চিহ্ন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্মার্ট গ্রুপের সহযোগী এবং আওয়ামী লীগ নেতা মুুজিবুর রহমানের মালিকানাধীন ডিপো কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা, গাফিলতি আর তথ্য গোপনের ফলে এমন বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আগুন লাগার সাথে সাথে ফায়ার সার্ভিসসহ উদ্ধার কর্মীরা ছুটে আসেন। তারা সাধারণ অগ্নিকাণ্ডের মতো পানি দিয়ে আগুন নেভানো শুরু করেন। আর তাতেই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। নয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ প্রাণ যায় অর্ধশতাধিক মানুষের। তখনও সেখানে সারি সারি কন্টেইনারে ভর্তি বিপজ্জনক রাসায়নিক হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকার তথ্য গোপন করা হয়। কেমিক্যাল মজুদের তথ্য দেয়া হলে এমন বিপর্যয় এবং ব্যাপক প্রাণহানী ঠেকানো যেত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

তাছাড়া হাইড্রোজেন পার অক্সাইডসহ অতি দাহ্য বিপদজনক রাসায়নিক মজুদ, হ্যান্ডলিং ও ব্যবস্থাপনার কোন সক্ষমতাই ছিল না ডিপোর। সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমোদন ছাড়াই সেখানে বিপুল রাসায়নিকের মজুদ গড়ে তোলা হয়। ডিপো কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলায় এমন ভয়াবহ বিপর্যয় হলেও ঘটনার তিনদিন পরও তাদের বিরুদ্ধে থানায় কোন মামলা হয়নি। কারো বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। তবে গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমদ বলেছেন, এই ঘটনায় সরকার তদন্ত কমিটি করেছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গতকাল দ্বিতীয় দিনের মত আগুন নেভানোর কাজ অব্যাহত থাকে। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিটের সাথে যোগ দেন ঢাকা থেকে আসা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্যরা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ডিপোর একপাশে ২৮টি কন্টেইনারে আগুন জ্বলছিল। ডিপোতে আরও কন্টেইনারে রাসায়নিক থাকতে পারে এমন আশঙ্কায় সতর্কতার সাথে অগ্ন্নি নির্বাপণের কাজ করছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে দুই শতাধিক এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় সোমবার রাতে তাদের ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে এখন ১৯ জনের চিকিৎসা চলছে। চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কমপক্ষে ৬৩ জনের চোখে আঘাত লেগেছে। তাদের মধ্যে ছয়জনকে ঢাকায় এবং একজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। আহত ৬৩ জনের প্রায় সবাই চোখে ঝাপসা দেখছেন। হাসপাতালে এখনো নিখোঁজদের স্বজনেরা ছবি হাতে ঘুরছেন। তাদের আহাজারিতে হাসপাতালের বাতাস ভারি। ফায়ার সার্ভিসের তিন কর্মীসহ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে : সেনাবাহিনী
বিএম ডিপোতে উদ্ধার কাজ ও পরিবেশ দূষণরোধে দায়িত্বরত সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আরিফুর ইসলাম হিমেল ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে লাগা আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। নতুন করে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আর কোনো আশঙ্কা নেই। শুধু ধোঁয়া বের হচ্ছে। কিছু কাপড়ের কন্টেইনার রয়েছে। সেগুলো থেকে মাঝেমধ্যে আগুন দেখা গেলেও ছড়িয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। ডিপো এলাকাটি প্রায় ২৬ একর জায়গা নিয়ে জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে প্রায় চার হাজারের মতো কন্টেইনার ছিল। এগুলো একটার ওপর একটা সারি করে রাখা ছিল। সেনাবাহিনীর সহায়তায় নিচেরটি বাদ দিয়ে ওপরের কন্টেইনারগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নিচে যে কন্টেইনার ছিল সেগুলোও একের পর সরানো হচ্ছে। সেনাবাহিনী এখন ফায়ার সার্ভিসকে নিয়ে ডাম্পিংয়ের কাজ শুরু করেছে। খুব সতকর্তার সঙ্গে এখানে কাজ করা হচ্ছে। যাতে নতুন করে কোনো বিস্ফোরণ না ঘটে।

কত কন্টেইনারে কেমিক্যাল জানে না কেউ
গতকালও ডিপোতে কত কন্টেইনার রাসায়নিক ছিল তা নিশ্চিত করেনি ডিপো কর্তৃপক্ষ। ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, কন্টেইনারের বিষয়ে এখনো ডিপোর মালিকপক্ষ নিশ্চিত করেনি। কখনো ২৮টি, কখনো ৩০টি বলছে। তাদের বলেছি রাসায়নিকের কন্টেইনারগুলো সরিয়ে নিতে। কিছু কন্টেইনার থেকে এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এখন না জেনে যদি ফায়ার ফাইটিং করতে যাই, তাহলে কন্টেইনারের ভিতরে দাহ্য বস্তু থাকলে আগুন বাড়তে পারে। রোববার ডিপোতে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট কাজ করলেও গতকাল দুটি ইউনিট কাজ করছে বলে জানিয়ে আনিসুর বলেন, আগুন এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে, সীমিত হয়ে এসেছে। আশপাশের প্রায় সব পুকুরের পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের পানির গাড়িতে করে দূর থেকে পানি এনে আগুন নেভানোর কাজ চলছে বলে জানান তিনি।

আরো দুইজনের লাশ
ডিপোর পোড়া ধ্বংসস্তুপ থেকে আরো দুটি ‘দেহাবশেষ’ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম বিভাগের উপ পরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, দুইজনের দেহাবশেষ আমরা পেয়েছি। তাদের চেনার উপায় নেই। তবে আলামত দেখে মনে হচ্ছে একজন ফায়ার সার্ভিস এবং অন্যজন তখন ডিউটিতে থাকা ডিপোর নিরাপত্তা বিভাগের কর্মী হতে পারেন। এ নিয়ে ভয়াবহ আগুন ও বিস্ফোরণে বেসরকারি হিসেবে ৫১ জন এবং সরকারি হিসেবে ৪৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। শুরুতে প্রশাসনের তরফে নিহতের সংখ্যা ৪৯ বলা হলেও পরে তা সংশোধন করা হয়।

৬৩ জনের চোখে আঘাত
ভয়াবহ বিস্ফোরণে আহত হাসপাতালে ভর্তি ১৮২ জনের মধ্যে ৬৩ জনের চোখে আঘাত রয়েছে। তাদের অনেকেই দৃষ্টি শক্তি হারাতে পারেন। তাদের মধ্যে ছয় জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিতে হবে। আর একজনকে নিতে হবে দেশের বাইরে। ন্যাশনাল আই কেয়ারের সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. দীন মোহাম্মদ নুরুল হক চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে একটি বিশেষজ্ঞ টিম নিয়ে এখানে এসেছি। এখানে কিছু রোগী রয়েছেন তাদের চোখে বেশি ক্ষতি হয়েছে। আবার কিছু রোগী শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে আঘাত পেয়েছেন তারাও কোনো না কোনোভাবে চোখে আঘাত পেয়েছেন। এসব রোগীর চিকিৎসায় উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মেডিক্যাল টিম গঠন করা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত এ চক্ষু চিকিৎসক বলেন, পরিবারের সদস্যদের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক রোগীকে আমরা ঢাকা নেবো। সব আল্লাহর হাতে এরপরেও মানসিক প্রশান্তির জন্য তাদের ঢাকায় নেওয়া উচিত বলে মনে করি। কেননা তাদের একজনের অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে দেশের বাইরেও নিয়ে যেতে হতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ৮ জুন, ২০২২, ১১:২৮ এএম says : 0
আমাদের দেশের সন্ত্রাসীরা যেমন গুমকারী , হত্যাকারী আমাদের কষ্টের অর্জিত ট্যাক্স এর লক্ষ্য কোটি হাজার টাকা পাচার কারি চাঁদাবাজ ধর্ষণকারী গুন্ডা মিথ্যাবাদী প্রতারক এদেরকে যদি আল্লাহ ঐ সীতাকুণ্ডের আগুনের মধ্যে ফেলত এবং ওদেরকে ধ্বংস করে ফেলত তাহলে আমরা একটু শান্তিতে বসবাস করতে পারতাম
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন