শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রক্ত দেই, জীবন বাঁচাই

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০২২, ১২:০৩ এএম

যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ১৪ জুন পালিত হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত‘’- এই থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। মানুষের জীবনে সৃষ্ট অভূতপূর্ব সংকটের সময়ে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে সু-সংগঠিত, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ স্বেচ্ছাসেবী, নিরপেক্ষ রক্তদাতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা হয় এই দিবসে। এবছর দিবসটির সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যগুলি হলো: বিশ্বের রক্তদাতাদের ধন্যবাদ জানানো, নিয়মিত, অবৈতনিক রক্তদানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা, জনগণের সংহতি ও সামাজিক সম্প্রীতি বাড়াতে রক্ত দানের সম্প্রদায়গত মূল্যবোধ প্রচার করা, যুবকদের রক্তদানের জন্য মানবিক আহ্বানকে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা এবং অন্যকেও এটি করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং স্বাস্থ্যের প্রচারে অংশীদার হিসাবে যুবকদের সম্ভাবনা তুলে ধরা।

প্রতিবছর ৮ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান হয়, অথচ এর মাত্র ৩৮ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে, যেখানে বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ মানুষ। এছাড়া এখনো বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের রক্তের চাহিদা হলে নির্ভর করতে হয় নিজের পরিবারের সদস্য বা নিজের বন্ধুদের রক্তদানের ওপর, আবার অনেক দেশে পেশাদার রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে রক্ত দান করে আসছে রোগীদের। অথচ, বিশ্বের নানা দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জানা যায়, নিরাপদ রক্ত সরবরাহের মূল ভিত্তি হলো স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে দান করা রক্ত। কারণ, তাদের রক্ত তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এবং এসব রক্তের মধ্য দিয়ে গ্রহীতার মধ্যে জীবনসংশয়ী সংক্রমণ, যেমন এইচআইভি ও হেপাটাইটিস সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম।

স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদানকারী আড়ালে থাকা সেসব মানুষের উদ্দেশ্যে, এসব অজানা বীরের উদ্দেশ্যে, উৎসর্গীকৃত ১৪ জুনের বিশ্ব রক্তদান দিবস। ১৪ জুন দিবসটি পালনের আরও একটি তাৎপর্য রয়েছে। এদিন জন্ম হয়েছিল বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টিনারের। এই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন চার ধরনের রক্তের গ্রুপ ‘এ, বি, ও, এবি’। রক্তদান হলো কোন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের স্বেচ্ছায় রক্ত দেবার প্রক্রিয়া। এই দান করা রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয় অথবা অংশীকরণের মাধ্যমে ঔষধে পরিণত করা হয়।

উন্নত দেশে বেশিরভাগ রক্তদাতাই হলেন স্বেচ্ছায় রক্তদাতা, যারা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রক্তদান করেন। দরিদ্র দেশগুলোতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা বেশ কম, বেশিরভাগ রক্তদাতাই কেবল তাদের পরিচিতজনদের প্রয়োজনে রক্তদান করে থাকেন। বেশির ভাগ রক্তদাতাই সমাজসেবামূলক কাজ হিসেবে রক্তদান করেন, তবে কিছু মানুষ পেশাদার রক্তদাতা, অর্থাৎ তারা অর্থ বা কোনো ভাতার বিনিময়ে রক্তদান করে থাকেন।
সম্ভাব্য রক্তদাতার রক্ত ব্যবহার যেসব কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে তার সবকিছুই পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষাগুলোর মধ্যে রক্তের মাধ্যমে ছড়ায় এমন রোগ যেমন: এইচআইভি ও ভাইরাল হেপাটাইটিস এর পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত। রক্তদাতাকে তার চিকিৎসার ইতিহাস জিজ্ঞাসা করা হয় এবং তার একটি সংক্ষিপ্ত শারীরিক পরীক্ষা করা হয় তা নিশ্চিত করার জন্যে যে, রক্তদান তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর হবে না। একজন রক্তদাতা কতদিন পরপর রক্তদান করতে পারবেন তা নির্ভর করে তিনি কী দান করছেন তার ওপর এবং যে দেশে রক্তদান সম্পন্ন হচ্ছে সে দেশের আইনের উপর। তবে প্রতি চারমাস অন্তর অর্থাৎ ১২০ দিন পর পর মানবদেহে নতুন রক্ত তৈরি হয়। গৃহীত রক্তের পরিমাণ ও পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে, তবে সাধারণত ৫০০ মিলিলিটার রক্ত নেওয়া হয়। পরিসঞ্চালনে ব্যবহৃত বেশির ভাগ রক্ত উপাদানই অল্প আয়ু বিশিষ্ট এবং এ কারণে অপরিবর্তিত সরবরাহ নিশ্চিত করা একটি সমস্যা।

রক্তদানের পূর্বে রক্তদাতার কয়েকটি বিষয়ে লক্ষ রাখা অবশ্য জরুরি। বয়স পুরুষদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৭ বছর, এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর থেকে ৫৭ বছরের মধ্যে হতে হবে, শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে, শারীরিক ওজন মেয়েদের ক্ষেত্রে ৪৭ কেজি এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ৫০ কেজি বা এর বেশি হতে হবে। তবে, উচ্চতা অনুযায়ী ওজন ঠিক আছে কিনা দেখে নিতে হবে, প্লাটিল্যাট দিতে হলে ওজন কমপক্ষে ৫৫ কেজি হতে হবে, রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ, ব্লাড প্রেসার এবং শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকতে হবে, উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে যদি প্রেসার নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং এর জন্য কোনো প্রকার ঔষধ সেবন না করলে রক্তদান করা যাবে, ডায়বেটিকস রোগীরা রক্তদান না করাই উত্তম। তবে কোনো প্রকার ঔষধ গ্রহণ না করা অবস্থায় যদি ডায়বেটিকস নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং অন্য কোনো রক্তদাতা খুঁজে না পেলে তখন রক্ত দেয়া যাবে।

শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ অ্যাজমা, হাঁপানি যাদের আছে যাদের এবং নিয়মিত ঔষধ ও ইনহেলার গ্রহণ করলে রক্ত দিতে পারবে না। মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪ মাস অন্তর-অন্তর এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ৩ মাস অন্তর-অন্তর রক্ত-দান করা যাবে। খুব বেশি জরুরি না হলে পুরুষরা ৪ মাস অন্তর-অন্তর রক্তদান করা উত্তম। হার্ট এবং কিডনিজনিত কোনো সমস্যা থাকলে রক্তদান করতে পারবে না। শরীরে আয়রনের ঘাটতি থাকলে রক্তদান করা যাবে না। মাদকাসক্ত হলে রক্ত দিতে পারবে না। রক্তবাহিত জটিল রোগ যেমন-ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, গনোরিয়া, হেপাটাইটিস, এইডস, চর্মরোগ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিকস, টাইফয়েড এবং বাতজ্বর থাকলে রক্তদান করা যাবে না। মায়েদের ক্ষেত্রে শিশু বুকের দুধ গ্রহণ করা অবস্থায় রক্তদান করা যাবে না। শিশু জন্মের ১৫ মাস পর রক্তদান করতে পারবে, যদি বুকের দুধ না খায়। কোন কারণে গর্ভপাত হলে কমপক্ষে ৬ মাস রক্তদান করা যাবে না।

কোনো বিশেষ ধরনের ঔষধ খাওয়ার ৭ থেকে ৩০ দিন পর রক্তদান করা যাবে। নরমাল এন্টিবায়োটিক ঔষধ সেবনের ৭ দিন পর রক্তদান করা যায়। তবে বিভিন্ন ধরনের এন্টিবায়োটিক রয়েছে যেগুলো সেবন করলে কমপক্ষে ৩০ দিন পর রক্তদান করতে হয়। কোনো প্রকার টিকা বা ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে কমপক্ষে ২৮ দিন পর রক্তদান করা যাবে। তবে কিছু টিকা রয়েছে, যেগুলো গ্রহণ করলে কমপক্ষে ৩ মাস পর রক্তদান করা যাবে। এজন্য ডাক্তারের সাথে আলাপ করে রক্তদান করা উচিত। জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হলে কমপক্ষে ১ বছর পর রক্তদান করা যাবে। হেপাটাইটিস বি, সি আক্রান্ত হলে কখনো রক্তদান করতে পারবে না। যক্ষ্মা হলে পূর্ণমাত্রার ওষুধ সেবনের ২ বছর পর রক্ত-দান করা যাবে। যে গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন হয়, সেই গ্রুপধারী ব্যক্তি থেকেই ঐ রক্ত নিতে হবে।

রক্তদানের প্রথম এবং প্রধান কারণ, একজনের দানকৃত রক্ত আরেকজন মানুষের জীবন বাঁচায়। তাছাড়া, রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। রক্তদান করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোনম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয় এবং রক্তদানের ২ সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকার জন্ম হয়ে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। বছরে ৩ বার রক্তদান শরীরে লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে তোলার সাথে সাথে নতুন কণিকা তৈরির হার বাড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য, রক্তদান করার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়। নিয়মিত রক্তদান করলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।

আরেক গবেষণায় দেখা যায়, যারা বছরে অন্তত দুই বার রক্ত দেয়, অন্যদের তুলনায় তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। বিশেষ করে, ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্ষেত্রে অনেক কম পরিলক্ষিত হয়েছে। চার বছর ধরে ১২০০ লোকের ওপর এ গবেষণা চালানো হয়েছিলো। নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে নিজের শরীরে বড় কোনো রোগ আছে কিনা তা বিনা খরচে জানা যায়। যেমন: হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, এইচআইভি (এইডস) ইত্যাদি। প্রতি পাইন্ট যা এক গ্যালনের আট ভাগের এক ভাগ রক্ত দিলে ৬৫০ ক্যালরি করে শক্তি খরচ হয়। অর্থাৎ ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রক্তদান ধর্মীয় দিক থেকে অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সমগ্র মানব জাতির জীবন বাঁচানোর মতো মহান কাজ।

লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন