নানা পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার করে মাদক পরিবহন ও বিক্রি করা হচ্ছে। ছদ্ম পরিচয় ব্যবহারকারী অনেককেই গ্রেফতার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। আবার কখনও কখনও মূল পেশার আড়ালে অনেকেই জড়িয়ে পড়েন মাদক করাবারে। পুলিশ, ডিবি পুলিশ, সাংবাদিকসহ নানা পরিচয়ে মরণ নেশার বাণিজ্য করছে তারা। এছাড়াও ছাত্র, শিক্ষক অনেককেই মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। কোরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে, অনলাইন শপের পণ্য ডেলিভারির নামে বাসায় বাসায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে মাদক। তবে অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে মাদক কারবারিরা। তবে মাদক কারবারে যারাই জড়িত থাকুক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার।
তিনি বলেন, সীমান্ত দিয়ে মাদক দেশে প্রবেশ করছে। মাদক নির্মূলে সবাইকে কঠোরভাবে কাজ করতে হবে। মাদকের সঙ্গে কিশোর গ্যাং সদস্যরাও জড়িয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের অধিকতর সচেতন হতে হবে। গাড়িচালক ও সহযোগীরা মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন পরিচয়ে, বিভিন্ন কৌশলে মাদক আসছে। আমরা এ বিষয়ে সক্রিয় রয়েছি। মাদক কারবারে যারাই জড়িত থাকুক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, গত ২৯ মে গ্রেফতার করা হয় রাজধানীর দক্ষিণখান মিয়া পাড়ার জুবায়ের হোসেন, উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের অনুভব খান রিবু ও উত্তরার সি ব্লকের দুই নম্বরে রোডের বাসিন্দা নাফিজা নাজাকে। বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ুয়া এই তিন জন গাঁজার নির্যাস দিয়ে তৈরি কেক, চকলেট, মিল্কশেক বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করতেন। বিশেষ এই ডেজার্ট বিক্রি করতে তৈরি করেন অনলাইন নেটওয়ার্ক। সেখানে অর্ডার দিলেই ক্রেতার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হতো এসব দ্রব্য। ইনস্টাগ্রামে অর্ডার নিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এসব মাদক ডেলিভারি দিতেন তারা। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নাফিস মোহাম্মদ আলম ও তার সহযোগী রাত্রি খানকে বিপুল পরিমাণ মাদক ও ভুয়া পুলিশ সরঞ্জামসহ আটক করেছে র্যাব-১। নিজেকে পুলিশ অফিসার পরিচয় দিয়ে মাদক বাণিজ্য করতেন। ব্যবহৃত গাড়িতেও ব্যবহার করতেন ‘পুলিশ’ লেখা স্টিকার।
কখনো সরকারি কর্মকর্তা, কখনো সরকারি দলের নেতা, কখনো সাংবাদিক। এমন নানা পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার করেন তিনি। ব্যবহৃত গাড়ির সামনে লাগানো থাকে সাংবাদিক বা আইনজীবী লেখা স্টিকার। এসব পরিচয় ব্যবহার করে মাদক পরিবহন করেন তিনি। টেকনাফ থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে তা পৌঁছে দেন ঢাকা, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ছদ্মবেশী এই মাদক কারবারির নাম আবুল কাশেম ওরফে কালু ওরফে রোহিঙ্গা কাশেম।
মাদকসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিকবার গ্রেফতার হলেও জামিনে বের হয়ে ফের মাদক কারবারে যুক্ত হন কাশেম। নানা পরিচয়ে নির্বিঘ্নে মাদক বাণিজ্য করে যাচ্ছেন তিনি। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার ও টেকনাফে একটি মাদক সিন্ডিকেটের হোতা হচ্ছে এই কাশেম। তারা মিয়ানমার থেকে অবৈধপথে ইয়াবা আমদানি করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেয়। এই সিন্ডিকেটের অন্তত প্রায় ১০-১২ জন সম্পর্কে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। এই চক্রের হয়ে কাজ করে কয়েক রোহিঙ্গা নারী। তারা পণ্যবাহী গাড়ি ছাড়াও বিভিন্ন স্টিকার ব্যবহৃত গাড়িতে করে মাদক পরিবহন করে। ২০১৫ সালের ২০ মে কক্সবাজারে বিপুল ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয় আবুল কাশেমকে। গোয়েন্দারা জানান, তার আচরণ বেশ রহস্যময়। একজন প্রভাবশালী নারীর সঙ্গে সখ্যতা থাকায় তার পরিচয় ব্যবহার করে অবৈধ নানা অবৈধ কার্যকলাপ করে বেড়াচ্ছেন আবুল কাশেম। গড়ে তোলেছে একটি চক্র।
২০২১ সালের ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় টেকনাফের হোয়াইক্যং চেকপোস্টে সিলভার কালারের প্রিমো প্রাইভেটকারকে সিগন্যাল দেন বিজিবি সদস্যরা। কিন্তু গাড়িতে থাকা ব্যক্তি পালাতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তাকে আটক করলে একেক সময় নিজের একেক পরিচয় দেয়। পরবর্তীতে তাকে টেকনাফ থানায় সপোর্দ করা হয়। মাদক ছাড়াও অতীতে ধর্ষণের অভিযোগে দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছেন। ২০২১ সালের ২০ জুন গাজীপুরের জয়দেবপুর থানায় এবং ২০১৫ সালের ২০ মে কক্সবাজারের রামু থানায় নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ মামলা হয় তার বিরুদ্ধে।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা কাশেম হিসেবে পরিচিত আবুল কাশেম। তিনি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের ঝিমংখালী গ্রামের আবু শামার পুত্র। কক্সবাজারে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। গ্রেফতার এড়াতে কয়েক বছর আগে গাজীপুর সদরের হোতাপাড়ায় আশ্রয় নেয় এই মাদক কারবারি। সেখানে গোপনে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। একপর্যায়ে প্রেম করে বিয়ে করেন গাজীপুরে। তার আগে কক্সবাজারে তিনি দুটি বিয়ে করেন। আগের সংসারে তার সন্তানও রয়েছে। একপর্যায়ে গাজীপুরেও তিনি বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে গাজীপুরে গ্রেফতার হয়ে জেলও খাটেন। পরবর্তীতে অপরাধ জগত থেকে নিজেকে আড়াল করতে নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন আবুল কাশেম। জানা গেছে, কক্সবাজার থানা, গাজীপুরের জয়দেব থানাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার বিরুদ্ধে মাদক, নারী নির্যাতন, প্রতারণার অভিযোগে অনেক মামলা রয়েছে।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সাভারের ভার্কুতা ইউনিয়ন থেকে মনির (৩৫) নামে ভুয়া এক ডিবি পুলিশকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-২। ডিবি পরিচয়ে মাদক ব্যবসা করতো সে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ পুলিশের ডিবির পোশাক ব্যবহার করে ভুয়া ডিবি সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে এলাকায় প্রতারণা ও চাঁদা আদায়ে পাশাপাশি মাদক ব্যবসা পরিচালনা করাই ছিল তার মূল কাজ। ইতোপূর্বে তার বিরুদ্ধে মাদকসহ দুটি মামলা হয়েছে।
মাছ ধরার আড়ালে মিয়ানমার থেকে আইস ও ইয়াবা আমদানি করছে এক শ্রেণির জেলেরা। মূলত জেলে ছদ্মাবেশী মাদক কারবারি তারা। গত ৩ মার্চ এরকম পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে গভীর সমুদ্রে জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার আড়ালে ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ও ইয়াবা সংগ্রহ করে বিভিন্ন কৌশলে রাজধানী ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে সরবরাহ করছিল তারা। এই চক্রের মূলহোতা জসিম উদ্দিন ওরফে জসিম। জসিমের অন্যতম সহযোগী মকসুদ মিয়া, রিয়াজ উদ্দিন, শাহিন আলম ও সামছুল আলম। তাদের সবার বাড়ি কক্সবাজারের সোনাদিয়ায়। তাদের কাছ থেকে ১২ কেজি আইস (যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার বেশি), এক লাখ পিস ইয়াবা, ৪ হাজার ৬০০ পিস চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন, দুটি বিদেশি পিস্তল, নয় রাউন্ড গুলি, দুটি টর্চলাইট, মিয়ানমারের সিমকার্ড, এক লাখ ৬৪ হাজার বাংলাদেশি টাকা ও এক লাখ মায়ানমারের মুদ্রা ও পাঁচটি মোবাইল ফোন জব্দ করে র্যাব। জেলে ছদ্মবেশে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করতো তারা। মাদক গ্রহণের পর সুবিধাজনক সময়ে তারা সোনাদিয়া দ্বীপে আসতো। পরে সেগুলো সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়। এরপর সুবিধাজনক সময়ে চক্রটি সোনাদিয়া থেকে দুটি বোটের মাধ্যমে নোয়াখালীর হাতিয়া নিয়ে যেতো। হাতিয়ায় থাকা চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে মাদকের চালান সংরক্ষণ করা হয়। এরপর ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে মেঘনা নদী হয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতো এই ভয়ঙ্কর মাদক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন