বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অস্তিত্বের সঙ্কটে অটবি

চেক ডিজঅনার মামলায় চেয়ারম্যান এমডিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৯ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

একসময় দেশের ফার্নিচার শিল্পে একক আধিপত্য ছিল বরেণ্য ভাস্কর নিতুন কুণ্ডের হাতে গড়া অটবি’র। ৩০ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে দেশের বাইরেও অটবিকে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশি ব্র্যান্ড হিসেবে চিনিয়েছেন তিনি। তবে ২০০৬ সালের নিতুন কুণ্ডর মৃত্যুর পরই খেই হারিয়ে ফেলে দেশের ফার্নিচার শিল্পের সেরা এ প্রতিষ্ঠানটি। মূল ব্যবসায় মনোযোগের পরিবর্তে অতিলোভে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগসহ অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্তে অটবিকে করেছে মৃত প্রায় কোম্পানি। এক ডজন ব্যাংকে ঋণের ভারে জর্জরিত। প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ হাজার কোটি টাকার বেশি। যার বেশিরভাগই খেলাপি। চার কারখানার দুটিতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রতিযোগিতার বাজারে পণ্য বৈচিত্র আনতে না পারায় গত ১০ বছরে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক শো-রুম। কারখানা ও শো-রুম নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। প্রধান কার্যালয় ও কারখানার জমি ইতিমধ্যে নিলামে তুলেছে ইসলামী ব্যাংক ও এবি ব্যাংক। দেনার দায়ে এখন বন্ধ হওয়ার পথে কোম্পানিটি। এই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও কোম্পানির সচিব মোহাম্মদ শামীম মিয়া’র প্রতারণা, চেক জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় অটবি লিমিটেডের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। টাঙ্গাইলের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বাসাইল আমলি আদালতের বিচারক মুছা. রুমা খাতুন সম্প্রতি এ পরোয়ানা জারি করেন। আসামিরা হলেন- অটবির চেয়ারম্যান ফাল্গুনী কুন্ডু, তার ছেলে ও প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিমেষ কুন্ডু, মেয়ে ও পরিচালক অমিতি কুন্ডু, প্রধান হিসাব কর্মকর্তা শেখ আসাফুজ্জামান, প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা শাহেদ আলম ও ডেপুটি ম্যানেজার আবুল বাশার। মামলার বাদী মোহাম্মদ শামীম মিয়া টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কাশিল দক্ষিণপাড়া এলাকার বাসিন্দা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন থেকেই রয়েছে গ্রাহকের সঙ্গে ছাড়ের নামে প্রতারণার অভিযোগ। ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিমেষ কুন্ডু’র বিরুদ্ধে রয়েছে একক স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ। কোনো অভিযোগকেই কখনও পাত্তা দিচ্ছের না অটবি ফার্নিচারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, অটবি লিমিটেডের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও কোম্পানির সচিব মোহাম্মদ শামীম মিয়াকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটি তার বেতন-ভাতাদি, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্টফান্ডসহ বিভিন্ন পাওনা পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানটির কাছে তিনি ৯৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকা পাবেন। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে কয়েকটি চেক দেয়া হয়। তবে অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় তাকে দেয়া চেকগুলো ডিজঅনার হয়। এতে ওই ভুক্তভোগী পাওনা টাকা চাইতে গেলে তাকে উল্টো হুমকি দেয়া হয়।

এ ঘটনায় গুলশান থানায় তিনটি সাধারণ ডায়েরি করেন শামীম মিয়া। এরপর চলতি বছরের ৫ মে টাঙ্গাইল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতিষ্ঠানটির মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। গত ১৪ মে তাদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ থাকলেও তারা হাজির হয়নি। এ জন্য গত মঙ্গলবার তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন টাঙ্গাইলের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বাসাইল আমলি আদালতের বিচারক।

মামলার বাদী শামীম মিয়া দাবি করেন, প্রতিষ্ঠানটি বেতন-ভাতাসহ পাওনা পরিশোধ না করেই আমাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়। বিভিন্ন সময় পাওনা ৯৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকা চাইতে গেলে হুমকি দেয়। একপর্যায়ে পাঁচটি চেক দেয়া হয়। সেখান থেকে একটি চেকের টাকা উত্তোলন করতে পারলেও বাকি চারটি চেক ডিজঅনার হয়। পরে অটবির মালিক, এমডি, পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করলে আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়েছেন। গ্রেফতারি পরোয়ানার খবর শুনে অটবির প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা শাহেদ আলম ফোনে মামলা তুলে নিতে বলেন। মামলা না তুললে প্রাণনাশের হুমকি দেন। হুমকির বিষয়েও ঢাকার বাড্ডা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি।

মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী আজহার জহুর খান বলেন, অটবির মালিকসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এর আগে আসামিদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন হয়। কিন্তু তারা ওই তারিখে আদালতে হাজির হননি। দ্বিতীয় তারিখেও তারা আদালতে হাজির না হওয়ার কারণে আদালতের বিচারক তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

অটবির প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা শাহেদ আলম দাবি করেন, সমন জারির বিষয়টি শামীম সাহেব (বাদী) গোপন রেখেছিলেন। সমনের বিষয়টি জানলে আদালতে উপস্থিত হতাম। মামলার বিষয়টিও জানা ছিল না। এখন শুনতেছি, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন, মোহাম্মদ শামীম মিয়া টাকা পাবেন কোম্পানির কাছে। তিনি নিজেও এমডির সঙ্গে একটা জালিয়াতি করে টাকা আদায় করে নিয়েছেন। তিনি টাকা পেলে কোম্পানির কাছে পাবেন। এখন তো আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কোম্পানি তাকে টাকা না দিলে আমি কী করবো। তিনি মোহাম্মদ শামীম মিয়াকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

এদিকে অটবি’র বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন থেকেই রয়েছে ভূয়া ছাড়ের নামে প্রতিমাসে ডিসকাউন্টের নামে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ। সূত্র মতে, অটবিতে সারা বছরই ভুয়া ছাড় থাকে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বছর জুড়েই অটবি বিভিন্ন নামে ডিসকাউন্ট দেয়। বৈশাখী ডিসকাউন্ট, শারদীয় অফার, আনন্দ অফার, ২১ শে অফার, স্বাধীনতা অফার, বিজয় অফার, বিগ অফার, ক্লিয়ারেন্স সেল নামসহ বিভিন্ন নামে থাকে অটবি ডিসকাউন্ট। প্রতিটিই ভুয়া অফার। জানা গেছে, পণ্যের উপর শুধু স্টিকার লাগিয়ে ডিসকাউন্ট লাগানো হয়। মূলত ডিসকাউন্ট দেয়া হয় না। দাম আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়। শুধু স্টিকারে দেখানো হয় ছাড় দেয়া হয়েছে।
অটবি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিমেষ কুন্ডুর সঙ্গে এ বিষয়ে জানতে মোবাইলে যোগাযোগ করলে প্রথমবার কল রিসিভ করে পরিচয় পাওয়ার পর কোন কথা না বলেই কেটে দেন। এরপর একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করলেও তিনি মোবাইল কল রিসিভ করেননি।

উল্লেখ্য, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫ সালে অটবি লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। দেশ বরেণ্য ভাস্কর নিতুন কুণ্ড তিল তিল দেশের শীর্ষ ফার্নিচার কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অটবিকে। তার মেধা ও শ্রমের কারণে সারাদেশেই বিস্তৃত হয় অটবির ফার্নিচারের শপ। ঢাকায় গড়ে তুলেন চারটি বৃহৎ কারখানা। কিন্তু ২০০৬ সালে নিতুন কুণ্ডর মৃত্যুর পরই আসবাবের জগতে অনন্য এ প্রতিষ্ঠানটি ক্রমেই জৌলুস হারাতে থাকে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
N H Shahan ১৯ জুন, ২০২২, ১০:০৯ এএম says : 0
সব কিছুরই বিনাশ আছে৷ কোন জোয়ারই দীর্ঘস্থায়ী নয়
Total Reply(0)
Rahena Akter ১৯ জুন, ২০২২, ১০:০৯ এএম says : 0
DaDa ra rag korbe kintu.
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন