শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বৈদ্যুতিক সামগ্রী যেন মৃত্যুফাঁদ

নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২১ জুন, ২০২২, ১২:০০ এএম

রাজধানীসহ সারাদেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। এতে জানমালের বিপুল ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমানও কম হচ্ছে না। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশটির এমন কোন প্রান্ত পাওয়া যাবে না যেখানে সবশেষ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনের উত্তাপ স্পর্শ করেনি। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডে ৮৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৩০১ জন। আর্থিক ক্ষতির হিসেব করলে তা ছাড়িয়ে যাবে হাজার কোটি টাকার ঘর। প্রতিনিয়ত মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি একের পর এসব ভয়াবহ আগুন লাগার পেছনে কারণ হিসেবে উঠে আসছে নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার, ক্যাবল, প্লাগ, সুইচ, সকেটসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। আর এসব নকল বৈদ্যুতিক পণ্যে বাড়ছে অগ্নিদুর্ঘটনার শঙ্কা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি।
বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরির বৈদ্যুতিক তার-ক্যাবলস, অভারহেড কন্টাক্টর, ট্রান্সমিটার এবং অন্যান্য সরঞ্জাম প্রয়োজন পড়ে। আর এসবের প্রায় শতভাগ উৎপাদন ও যোগান দিয়ে থাকে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ক্যাবলস পণ্যের সঠিক মান যাচাই, বাছাই, পর্যালোচনা কোনোটাই হচ্ছে না। অন্যদিকে কাঁচামালের পরিমাণ, আমদানি শুল্ক এবং দরদাম পর্যবেক্ষণ না করার কারণে ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি নিরূপণের বিষয়টিতে বিরাট ঘাপলা রয়ে যাচ্ছে। শুধু নিম্নমানের কাঁচামাল দিয়ে তৈরি বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারে দেশে প্রতি বছর জ্বলেপুড়ে বিকল, বিদ্যুতের সিস্টেম লস, শর্টসার্কিট হয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। শুধু সঠিক পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে এই শিল্পখাতে অসম প্রতিযোগীতা ও একচ্ছত্র অধিপত্যবাদী গ্রুপের সৃষ্টি হতে চলেছে। বিশাল অঙ্কের ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা যেভাবে ইচ্ছা যা ইচ্ছা বানাচ্ছে।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ক্যাবল, আটটি প্রতিষ্ঠানের সুইচ-সকেট ও ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের ফ্যান তৈরির লাইসেন্স আছে। এছাড়া, অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির লাইসেন্স আছে মাত্র ২২টি প্রতিষ্ঠানের। তবে সরেজমিনে দেখা যায়, খোদ রাজধানীতেই রয়েছে এমন শতাধিক প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর বংশাল, নবাবপুর, সিদ্দিকবাজার, জিনজিরা, যাত্রাবাড়ী, ডেমরাসহ অনেক এলাকায় গড়ে উঠেছে নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি তৈরির কারখানা। নতুন মোড়কে দামি ব্র্যান্ডের লোগো হুবহু ব্যবহার করে বাজারজাত হচ্ছে এসব নকল পণ্য। দেশের বাইরে থেকেও আসছে নিম্নমানের পণ্যের একটা বড় অংশ। দেশি-বিদেশি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক পণ্য নকল করা হচ্ছে। বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেয়ার শর্ত থাকলেও সেখানে এর কোন বালাই নেই। অনেকক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিষয় চেপে যাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ধরন ও তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ফায়ার সার্ভিস বলছে, বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণই বৈদ্যুতিক গোলযোগ। অর্থাৎ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে সহজেই শর্টসার্কিট হয়ে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। আবাসিক ভবন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও এখন আগুন লাগার প্রধান কারণ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার। এছাড়া আগুন লাগার আরেকটি বড় কারণ বিড়ি-সিগারেট ও রান্নার চুলা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০২২ সালের প্রথম পাঁচ মাসেই (জানুয়ারি-মে) দেশে অগ্নিকাণ্ডে ৮৮৮ জনের মৃত্যু এবং আহত হন ৭ হাজার ৩০১ জন। এর মধ্যে শুধু মে মাসেই মারা গেছেন ২৩৫ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ৩০১ জন। এছাড়া ২০২১ সালে মারা গেছেন ২১৯ জন এবং আহত হন ৫৭০ জন, ২০২০ সালে মৃত্যু ১৫৪ এবং আহত হন ৩৮৬ জন, ২০১৯ সালে মৃত্যু ১৮৫ এবং আহত হন ৫৮৬ জন, ২০১৮ সালে মৃত্যু ১৩০, আহত ৬৭৭ জন এবং ২০১৭ সালে ৪৫ জনের মৃত্যু ও আহত হন ২৮৪ জন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকল বৈদ্যুতিক তার কিনে গ্রাহক শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছেন না, এটার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে মৃত্যুর ফাঁদ। ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে সাম্প্রতিক আগুনের ঘটনাগুলোর ৭৫ থেকে ৮০ ভাগের পেছনে দায়ী মানহীন বৈদ্যুতিক তার ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর নবাবপুরের কাপ্তান বাজার দেশের সবচেয়ে বড় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বেচাকেনার এই এলাকার প্রতিটি দোকানেই পাওয়া যায় স্বনামধন্য কেবল কোম্পানির নকল বৈদ্যুতিক তার-ক্যাবলসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। এমনকী কোনো কোনো দোকানে কোম্পানির স্টিকার দেওয়া থাকলেও সে স্টিকারও নকল করে সাঁটানো হয় তারের কয়েলে।
এসব নকল পণ্যের ভোক্তা কারা এমন প্রশ্নে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিক্রেতারা জানান, যেসব কোম্পানি ভবন নির্মাণের দায়িত্বে থাকেন, তারাই অতি লাভের আশায় মানের সঙ্গে সমঝোতা করেন। অন্যদিকে নিখুঁতভাবে নকল হওয়ায় মূল ভোক্তাও বুঝতে পারেন না আসল নকলের পার্থক্য। বেশিরভাগ ক্রেতাই কমদামি তার খোঁজেন। তাদের যা প্রয়োজন আমরা তা সরবরাহ করি, তবে এটা ঠিক-এসব নকল তারে শর্ট সার্কিটের ঝুঁকি বেশি। তবে অনেকে সরকারি প্রকল্পেও এমন মানহীন বৈদ্যুতিক সামগ্রী কেনা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমান আদালতে অনুমোদনহীন ও নকল বৈদ্যুতিক তার উৎপাদন, মজুদ ও বিক্রির অভিযোগে জরিমানা করা হয়। তবে এতেই থেমে থাকেনা এসব অবৈধ ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড। নতুন করে আবারও পুরোনো ব্যবসা শুরু করে দেন তারা। অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসনকে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে রেখেও চলে এই রমরমা গ্রাহক ঠকানোর মহোৎসব। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএসটিআইয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হাসিব সরকার বলেন, আমাদের অভিযান সারাবছরই চলমান থাকে। বিভিন্ন সময়ে আমরা বিভিন্ন প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করে থাকি। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নিয়েও দ্রুতই অভিযান পরিচালিত হবে।
জানা গেছে, বৈদ্যুতিক ক্যাবলস বিভিন্ন সাইজের এবং বিভিন্ন গ্রেডের হয়ে থাকে। এটি তৈরির জন্য কাঁচামাল হলো তামা, এ্যালুমনিয়াম এবং প্লাষ্টিক। তামা এবং এ্যালুমনিয়ামের তারের উপর প্লাষ্টিক ইন্সুলেশন করে তৈরি করা হয় ক্যাবলস। তামার ক্যাবলস মান এবং দামের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি উপযোগী। কাঁচামালের দাম কম হবার কারণে এ্যালুমনিয়াম ক্যাবলসের দাম যথেষ্ঠ কম।
তবে বিদ্যুৎ খাতের বিশেষ কিছু পর্বে এ্যালুমনিয়াম ক্যাবলস প্লাষ্টিক ইন্সুলেশন সহ এবং ইন্সুলেশন ছাড়া উভয়ভাবেই ব্যবহার হয়ে থাকে। কপারের স্থায়িত্ব এবং প্লাস্টিকের স্থায়িত্ব সমান করতে হলে ক্যাবলসের জন্য বিশেষ মানের প্লাষ্টিক কাঁচামাল ব্যবহার করতে হয়। নাহলে আগেই ইন্সুলেশন নষ্ট হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু বেশি লাভ, দাম কম করতে উভয় কাঁচামালই ভাঙ্গাড়ি থেকে তৈরি করে থাকে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এসবের নিয়ন্ত্রণ না হলে এই শিল্পে বিপর্যয় আসবে বলে মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।
বাজারে বিক্রি হওয়া বৈদ্যুতিক এসব সামগ্রীকে মানহীন উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স বিভাগের প্রফেসর ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী জানান, বাজারের অধিকাংশ পণ্য অত্যন্ত নিম্নমানের এবং এতে প্রথমত ভোক্তা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। কারণ, সেটা যদি ইলেকট্রিক তার বা অন্যকিছু হয় তবে বেশি বিদ্যুৎ খরচ করে। আবার, কিছুদিন ব্যবহারে কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে গিয়ে নানা দুর্ঘটনা ঘটার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন