বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর পরাজয় থেকে শিক্ষা নিতে হবে

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধ আট ঘণ্টার মতো স্থায়ী ছিল এবং প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব কোম্পানির সৈন্যদের কাছে পরাজিত হন। এ যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬৫০ এর দশকের প্রথম থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় স্থায়ীভাবে ব্যবসা শুরু করে। বাংলার মুঘল শাসকগণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় বসবাসের অনুমতি দেন এবং বছরে মাত্র তিন হাজার টাকা প্রদানের বিনিময়ে তারা শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার অধিকার পায়। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে তাদের অনুপ্রবেশ বাংলার সুবাহদার শায়েস্তা খান ও ইংরেজদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শায়েস্তা খান পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা কলকাতায় বসবাস করার অধিকার পায় এবং কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানটি নামে তিনটি গ্রাম কিনে তারা প্রথম জমিদারি প্রতিষ্ঠিত করে। ইংরেজরা কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম নামে একটি দুর্গও নির্মাণ করে।

জমিদারি ক্রয় ও ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য খুবই সুবিধাজনক বলে প্রমাণিত হয়। ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক সুবিধার অপব্যবহারের দরুণ বাংলার নবাবদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। একই সঙ্গে কোম্পানির কর্মচারীগণ বাণিজ্যের ছাড়পত্র তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যবহার শুরু করে। কোম্পানি আরও অধিক সুযোগ-সুবিধা আদায়ের প্রচেষ্টায় মুগল সম্রাট ফররুখ সিয়ারের নিকট ধর্ণা দেয়। তিনি ১৭১৭ সালে এক ফরমান এর মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা প্রদান করেন।

এ সকল সুবিধার মধ্যে ছিল শুল্কমুক্ত বাণিজ্য, কলকাতায় টাকশাল স্থাপন এবং কিছু শর্ত সাপেক্ষে ৩৮টি গ্রাম ক্রয় করার অধিকার। যেহেতু অন্যান্য ব্যবসায়ীর নির্দিষ্ট হারে শুল্ক দিতে হতো, আর ইংরেজ ও তাদের সহযোগীরা শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করত, তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য থেকে উৎখাত হওয়ার ভয় দেখা দেয়। নবাব মুর্শিদকুলী খান ফরমানের বাস্তবায়নে বাধা দেন। তিনি অনুভব করেন যে, কোম্পানির এ বিশেষ সুবিধার ফলে সরকার তার আইনানুগ বাণিজ্য শুল্ক ও টাকশালের উপর প্রাপ্য কর থেকে বঞ্চিত হবে।

১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজউদ্দৌলাহর ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নবাব এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে বিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। নবীন নবাব প্রথম বারের মত বাংলায় কোম্পানির অবৈধ কার্যক্রমের তীব্র প্রতিবাদ জানান। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর তিনটি প্রধান অভিযোগ ছিল: অনুমতি ব্যতীত ফোর্ট উইলিয়ামে প্রাচীর নির্মাণ ও সংস্কার, ব্যক্তিগত অবৈধ ব্যবসা এবং নবাবের অবাধ্য প্রজাদের বেআইনিভাবে আশ্রয় প্রদান। উল্লিখিত অভিযোগসমূহের মীমাংসার জন্য পদক্ষেপ নিতে নবাব ব্রিটিশদের আহবান জানান এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিরসনের জন্য কলকাতায় অনেক প্রতিনিধিদল পাঠান।

নবাবের বিশেষ দূত চিঠি নিয়ে কলকাতায় গেলে ইংরেজরা তাকে অপমানিত করে। কলকাতার ইংরেজ গভর্নর রজার ড্রেক যে চরম অপমানজনকভাবে নবাবের প্রতিনিধি নারায়ণ সিংহকে বিতাড়িত করে তা সবিস্তার শুনে নবাব অত্যন্ত রাগান্বিত হন। তিনি তৎক্ষণাৎ কাসিমবাজার কুঠি অবরোধের আদেশ দেন। কুঠির প্রধান আত্মসমর্পণ করে কিন্তু কলকাতার ইংরেজ গভর্নর অবাধ্যতা ও একগুঁয়েমি প্রদর্শন করেন। ফলে নবাব কলকাতা অভিযান করেন তা দখল করে নেন। এ পরাজয়ের পর বাংলায় কোম্পানির পুনঃপ্রতিষ্ঠা দুই উপায়ে করা সম্ভবপর ছিল, হয় নবাবের নিকট আত্মসমর্পণ নচেৎ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বল প্রয়োগ।

বাংলায় যে সকল ব্রিটিশ ছিল তারা অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর জন্য মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জে জরুরি খবর পাঠায়। সেখান থেকে রবার্ট ক্লাইভ ও এডমিরাল ওয়াটসনের অধীনে একদল ব্রিটিশ সৈন্য বাংলায় পাঠানো হয়। তারা ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা পুনরুদ্ধার করে এবং নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তখন সিরাজউদ্দৌলাহ ইংরেজদের সঙ্গে আলীনগরের সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।

কিন্তু ইংরেজরা সন্ধির শর্তাদি অগ্রাহ্য করতে থাকায় যুদ্ধের চাপা উত্তেজনা চলতে থাকে। তারা নবাবের প্রতি বিরূপ পারিষদদের নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। মুর্শিদাবাদ দরবারে কিছু প্রভাবশালী নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। নবাবকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে। তবে ব্রিটিশগণ সক্রিয়ভাবে এ ষড়যন্ত্রে জড়িত না হলে আদৌ কোন পলাশী যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া হয়তো সম্ভব হতো না।

ক্লাইভও মাদ্রাজ থেকে যাত্রার পূর্বে লেখেন যে, নবাবের বেশিরভাগ পারিষদই তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন ছিলেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, নবাব দরবারের বিরূপ মনোভাবই ইংরেজদের গুরুত্বপূর্ণ কূটচালে লিপ্ত হতে উৎসাহিত করে এবং এতে করে পলাশীতে চরম আঘাত হানার ষড়যন্ত্র ত্বরান্বিত হয়। ক্লাইভ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দরবারি ঐতিহাসিক ওর্ম, যিনি ১৭৫০-এর দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বাংলায় অবস্থান করেন, উভয়ে কর্নেল স্কটের বাংলা দখল করার পরিকল্পনা বিষয়ে অভিহিত ছিলেন।

রবার্ট ওর্ম এর কাছ থেকে জানা যায়, নবাবের প্রতি মীরজাফরের অসন্তুষ্টির বিষয়ে জানতে পেরে ক্লাইভ ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেয়। ওয়াটস কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী উর্মিচাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং নবাব দরবারের প্রধান কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ওয়াটস কর্তৃক প্রেরিত প্রতিনিধি উর্মিচাঁদের নিকট ইয়ার লতিফের নবাব হওয়ার ইচ্ছা সংগোপনে প্রকাশ করেন এবং আরও জানান যে দিউয়ান রায় দুর্লভরাম ও প্রভাবশালী ব্যাংক মালিক জগৎ শেঠ তাকে সমর্থন করবেন। ওয়াটস সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনাটি লুফে নেয় এবং তা ক্লাইভকে জানান। এটি ক্লাইভের অনুমোদন লাভ করে। ৩০ মে পর্যন্ত মীরজাফর মুর্শিদাবাদে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু ওয়াটস তার সঙ্গে কোন প্রকার চুক্তি স্বাক্ষরে ব্যর্থ হন। অবশেষে ৫ জুন ওয়াটস লাল ও সাদা চুক্তিনামায় মীরজাফরের স্বাক্ষর আদায়ে সক্ষম হন, যা ছিল উর্মিচাঁদকে ধোকা দেওয়ার জন্য মিথ্যা চুক্তি। চুক্তি স্বাক্ষর সত্ত্বেও পরিকল্পিত বিপ্লব বাস্তবায়নের জন্য সিলেক্ট কমিটি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে। কেননা আরও বিলম্ব হলে নবাবের নিকট ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে যাবে এবং মীরজাফরকে সরিয়ে দেওয়া হবে, ফলে গোটা পরিকল্পনা ভন্ডুল হবে এবং ব্রিটিশরা একা সম্মিলিত দেশীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য মাঠে থাকবে। তদনুসারে ১৩ জুন ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। ১৯ জুন ক্লাইভ কাটোয়া পৌঁছেন। স্থানটি পূর্বদিন কর্নেল কুট দখল করে নেন। ২১ জুন ক্লাইভ সমর পরিষদের সভা ডাকেন এবং তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু ক্লাইভ পরে সিদ্ধান্ত পাল্টান এবং পরদিন অগ্রসর হওয়ার জন্য মনস্থ করেন। ২২ জুন সকালে ব্রিটিশ বাহিনী ক্লাইভের নেতৃত্বে পলাশীর পথে যাত্রা করে। অবশ্য ২২ তারিখ দুপুরের পর পরই ক্লাইভ মীরজাফরের কাছ থেকে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বার্তা পান এবং পলাশীর পথে তার যাত্রা অব্যাহত রেখে দুপুর রাতের পর সেখানে পৌঁছেন।
ইতোমধ্যে নওযাব মুর্শিদাবাদ থেকে রওনা দেন এবং শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য পলাশীতে শিবির স্থাপন করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল ৮টার দিকে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। মীর মদন, মোহন লাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নব সিং হাজারী প্রমুখের অধীন নবাব সেনা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালায়, অন্যদিকে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভরামের অধীন নবাবের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সেনা নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ও পরিস্থিতি অবলোকন করে। এমনকি বেশ কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পরও চূড়ান্ত কিছু ঘটেনি। ক্লাইভ এমন প্রতিরোধ পাবেন আশা করেননি এবং এই মর্মে জানা যায়, দিনে যথাসম্ভব তীব্র যুদ্ধ চালিয়ে ক্লাইভ রাতের অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে যাওযার চিন্তা করছিলেন। কিন্তু বেলা তিনটার দিকে কামানের গোলা মীর মদনকে আঘাত হানে এবং এতে তাঁর মৃত্যু হয়। মীর মদনের মৃত্যুতে হতভম্ব নবাব মীর জাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর জীবন ও সম্মান রক্ষার জন্য তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। মীরজাফর নবাবকে ঐ দিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং পরদিন সকালে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করার পরামর্শ দেয়, আর এ খবর শীঘ্রই ক্লাইভের নিকট পৌঁছানো হয়। পরামর্শমত নবাবের সেনানায়কেরা পিছুতে থাকলে ইংরেজ সেনারা নতুন করে প্রচন্ড আক্রমণ চালায় এবং ফলে নবাব বাহিনী বিশৃঙ্খলভাবে যত্রতত্র পালিয়ে যায়। অপরাহ্ণ ৫টার দিকে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় এবং বিজয়ী ক্লাইভ বীরদর্পে তখনই মুর্শিদাবাদ যাত্রা করেন।

ষড়যন্ত্র এবং পরবর্তীকালে পলাশী বিপ্লব ইংরেজদের দ্বারা শুধু উদ্ভাবিত ও উৎসাহিতই হয়নি, বরং যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তারা দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের ব্রিটিশ পরিকল্পনা সমর্থন করতে প্রলুব্ধ করে। ইংরেজরা তাদের ষড়যন্ত্রের জোরে ও সিরাজউদ্দৌলাহর সভাসদদের বিশ্বাসঘাতকতার দরুণ পলাশীতে বিজয়ী হয়। নবাবের পরাজয় মূলত ছিল রাজনৈতিক, সামরিক নয়।

লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ২৩ জুন, ২০২২, ৬:২৬ পিএম says : 0
আমাদের দেশটারে মীরজাফর রায় চালাচ্ছে আর এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রতি এই সরকারের দমন-পীড়ন অসম্ভব ভাবে বেড়ে গেছে সুদ ঘুষ চাঁদাবাজি ধর্ষণ যিনা-ব্যভিচার হত্যা-গুম এগুলো সরকারের কাছে ঝাল মুড়ির মতো যা ইচ্ছা তাই করতে পারে এরা আমাদের কোন জীবনের নিশ্চয়তা নাই আমাদের কোনো ব্যক্তিগত সম্মান নাই আমাদের মেয়ে বোন মাদের ইজ্জতের সম্মাননায় তারা যখন তখন ইজ্জত কেড়ে নিতে পারে
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন