প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার তার সবচেয়ে চরম কিছু নির্বাচনী প্রচারণা থেকে সরে এসে হিলারি ক্লিনটনকে জেলে পাঠানোর শপথ বাদ দিয়েছেন, সন্ত্রাসবাদী সন্দেহভাজনদের নির্যাতনের ফল সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে মন খোলা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
নির্ধারিত, বাতিল ও পুনর্নির্ধারিত হওয়ার পর দি নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সাথে ঘণ্টাব্যাপী ব্যাপকবিষয়ক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বহুকাল ধরে আমেরিকান প্রেসিডেন্সিকে রূপদানকারী ঐতিহ্যবাহী কিছু নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রথার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করলেও ক্ষমা প্রার্থনা করেননি।
তিনি নানা ধরনের মন্তব্য করেন যার অনেকগুলোই ছিল স্ববিরোধী। তিনি মিসেস ক্লিনটনের ব্যাপারে উদার মনোভাব প্রদর্শন করেন আর তার বিজয়ের ব্যাপারে গর্ব প্রকাশ করেন। তিনি তার কিছু অবস্থানের ব্যাপারে খোলা মনের পরিচয় দেন, কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে ছিলেন অনমনীয়।
তিনি বলেন, তার ব্যবসা সা¤্রাজ্য ও তার হোয়াইট হাউসের মধ্যে সীমারেখা টানার কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা তার নেই। তিনি স্বীকার করেন যে, ট্রাম্প ব্র্যান্ড আগের চেয়ে এখন অবশ্যই বেশি চাহিদাকৃত ব্র্যান্ড হয়েছে। তিনি বলেন, তিনি নিজেকে ব্যবসা থেকে পৃথক করে নেয়ার পথ বের করার চেষ্টা করবেন। ব্যবসা পরিচালনা করবেন ছেলেমেয়েরা।
তিনি তার প্রধান স্ট্র্যাটেজিস্ট স্টিফেন কে ব্যাননের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী অভিযোগের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তাকে একজন ভদ্রলোক বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রচলিত প্রথাবহির্ভূত প্রচারণাকর্মে সমর্থন দিতে ব্যর্থ রিপাবলিকানদের ব্যঙ্গ করেন।
দি নিউইয়র্ক টাইমসের প্রকাশক আর্থার সালজবার্গার জুনিয়রের ১৭তলায় অবস্থিত বোর্ডরুমে মধ্য দুপুরের বৈঠকে ট্রাম্প তার নতুন চাকরির ব্যাপারে ভীত বললেও তাকে আত্মবিশ^াসী মনে হচ্ছিল। তিনি বলেন, এটি এক অভিভূতকারী বিষয় হলেও তিনি এর ফলে অভিভূত নন।
এ সাক্ষাৎকার ট্রাম্পের অবস্থানের অনিশ্চয়তা প্রদর্শন করেছে।
তিনি বলেন, হিলারি ক্লিনটনের ব্যক্তিগত ইমেইল সার্ভার ব্যবহার বা ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের আর্থিক কর্মকা-ের জন্য তার বিচারের লক্ষ্যে চাপ সৃষ্টি করায় তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি বলেন, আমি হিলারিকে আঘাত দিতে চাই না, আসলেই না।
বন্দী নির্যাতন বিষয়ে ট্রাম্প বলেন, মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের সাবেক প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেরিন কোর জেনারেল জেমস এন ম্যাটিসের সাথে কথা বলার পর বন্দীদের ওয়াটারবোর্ডিংয়ের ফল বিষয়ে তিনি তার মনোভাব পরিবর্তন করেছেন।
ট্রাম্প বলেন, আমি কখনোই একে কার্যকর হিসেবে দেখিনি। তিনি বলেন, ম্যাটিস সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের সাথে আস্থা সৃষ্টি ও সহযোগিতার মধ্যে অধিকর ফল দেখেছেন। তিনি বলেছেন, আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট ও দু’টি বিয়ার দিন, আমি অনেক ভালো ফল দেবো।
ট্রাম্প বলেন, আমি এই জবাবে অত্যন্ত অভিভূত হয়েছি। তিনি বলেন, বহু লোক যেমনটি ভাবছে নির্যাতন সে রকম পার্থক্য সৃষ্টি করতে যাচ্ছে না।
ট্রাম্প বারংবার বলেন যে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে ম্যাটিসকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি এ সময় একজন জেনারেলেরই এ পদে থাকা দরকার।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে গত বছর প্যারিসে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসার অঙ্গীকারের পুনরাবৃত্তি করতে অস্বীকার করে বলেন, আমি খুব তীক্ষèভাবে এটা দেখছি। প্যারিস চুক্তির এক তীব্র সমালোচককে তার অন্তর্বর্তী টিমে নিয়োগ করা সত্ত্বেও ট্রাম্প বলেন, এ ব্যাপারে আমার মন খোলা এবং পরিষ্কার বাতাস ও স্ফটিক স্বচ্ছ পানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি চরম অবস্থান নিতে চান না। তিনি গত সপ্তাহান্তে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত এক শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী সম্মেলনের তীব্র নিন্দা করেন। এ সম্মেলনে আগতরা নাজি স্যালুট দেয় ও ইহুদিদের সমালোচনা করে।
সংবাদমাধ্যমের সাথে তার বিরোধ ও কুৎসা আইন কঠোর করার অঙ্গীকার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপের কথা না বলে গ্রুপকে বলেন, আমি মনে করি আপনারা খুশি হবেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের বিরুদ্ধে প্রায়ই আক্রমণ এবং ‘ব্যর্থ নিউইয়র্ক টাইমস’ বলে উল্লেখ করলেও ট্রাম্প সাক্ষাৎকারকালে পত্রিকার প্রশংসা করেন এবং একে মহান, মহান আমেরিকার রতœ, বিশ^রতœ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, তিনি মনে করেন যে, দি টাইমস নির্বাচন প্রচারণাকালে তার প্রতি খুব কঠিন ছিল।
অন্যান্য ক্ষেত্রে সমালোচনার জবাব দিতে বলা হলে তিনি ছিলেন অনমনীয়। তিনি স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও আইনের নৈতিকতা প্রসঙ্গে প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ঘোষণা করেন যে, আইন সম্পূর্ণরূপে তার পক্ষে। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না।
তিনি বলেন, তার ব্যবসা বিক্রি করা খুবই কঠিন, কারণ তা রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। তিনি বলেন, তিনি কিছু করতে পছন্দ করেন সরকারে তার কাজ থেকে ব্যবসাকে পৃথক করার জন্য একটা ব্যবস্থা করবেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, তিনি তার ব্যবসার ব্যবস্থাপনা ছেলেদের কাছে অর্পণ করেছেন। নৈতিকতা আইনজীবীরা বলেছেন, স্বার্থের দ¦ন্দ্ব ঠেকাতে তা যথেষ্ট নয়।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, তিনি তার ব্যবসায়িক অংশীদারদের এখনো হোয়াইট হাউসে তার সাথে অন্তরঙ্গ ছবি তোলার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। সমালোচকরা তাকে তার ইচ্ছার বাইরে কিছু করার জন্য চাপ দিচ্ছেন যার মধ্যে রয়েছে তার ব্যবসা পরিচালনাকারী সন্তানদের সাথে নিজের ব্যবধান সৃষ্টি।
অফশোর উইন্ড ফার্মসের বিরুদ্ধে তার বিরোধিতা প্রদর্শনের জন্য তিনি গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্য ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টির নেতা নাইজেল ফারেজের সাথে বৈঠককে ব্যবহার করেছেন বলে প্রকাশিত খবরের বিরোধিতা তিনি করেননি। ট্রাম্প অনেক দিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন যে, উইন্ড ফার্মস অ্যাবার্ডিনশায়ারে তার গলফকোর্স থেকে দৃশ্যের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, আমি বিষয়টি তুলে ধরেছি। তা করেছেন উইন্ড ফার্মসের ব্যাপারে নীতি উদ্বেগের কারণে, ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়।
তার জামাতা জ্যারেড কুশনারকে হোয়াইট হাউসের একটি চাকরিতে নিয়োগে তিনি কেন্দ্রীয় স্বজনপ্রীতি-বিরোধী আইনে বাধা পাবেন বলে ধারণাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তিনি বলেন, তিনি বিরোধ সৃষ্টি এড়াতে চান ও পরিবর্তে কুশনারকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ দূত নিয়োগ করতে চান। তিনি বলেন, একজন পর্যবেক্ষণশীল ইহুদি হিসেবে কুশনার ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ নিরসনে অত্যন্ত সহায়ক হতে পারেন।
ট্রাম্প বলেন, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি স্থাপনকারী প্রথম ব্যক্তি হতে পারলে আমার ভালো লাগবে। কুশনার এ ব্যাপারে ভালো করবেন এবং তিনি এ অঞ্চল সম্পর্কে জানেন। তিনি বলেন, বহু লোক, আসলে বড় বড় লোকরাও আমাকে বলেছেন যে এটা অসম্ভব, আপনি এটা করতে পারবেন না। আমি তাদের সাথে একমত নই। আমি মনে করি আপনি শান্তি স্থাপন করতে পারবেন। আমার বিশ্বাস করার কারণ আছে যে আমি তা পারব।
ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে সাধারণভাবে কথা বলেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্টের দেশ নির্মাতা হওয়া উচিত নয়। তিনি ইরাকে যুদ্ধ করা আমাদের ইতিহাসের এক বড় ভুল বলে তার নির্বাচনী প্রচারণার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন এবং বলেন, সিরিয়ায় চলা সহিংস গৃহযুদ্ধ কিভাবে মোকাবেলা করবেন সে বিষয়ে তার কিছু খুব সুনির্দিষ্ট ও শক্তিশালী চিন্তা আছে। কয়েক দফা অনুরোধ করা হলেও তিনি সে চিন্তা সম্পর্কে কিছু বলতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, সিরিয়াতে যে পাগলামি চলছে আমাদের তা বন্ধ করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত বলেন, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাথে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, তিনি ও পুতিন একসাথে হলে সুন্দর হবে। তবে সম্পর্কের উষ্ণতাকে সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করার ধারণা হিসেবে আখ্যায়িত করাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করার হিলারি ক্লিনটনের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তার যে সমালোচনা করা হয়, ট্রাম্প সে কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বর্ণবাদী ও সেমিটিজম বিরোধী বলে অভিযুক্ত তার প্রধান স্ট্র্যাটেজিস্ট মনোনীত ব্যাননের সপক্ষে জোরালো কথা বলেন। ব্যানন এই গীষ্মে তার ওয়েবসাইট ব্রেইটবার্ট নিউজকে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আল্ট-রাইটয়ের প্ল্যাটফর্ম আখ্যায়িত করেন। ট্রাম্প বলেন, ব্যানন তার নিয়োগের ব্যাপারে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে তাকে চিনি। আমি যদি তাকে বর্ণবাদী বা আল্ট-রাইট হিসেবে ভাবতাম তাহলে তাকে নিয়োগের চিন্তাও করতাম না। ট্রাম্প বলেন, আমার মনে হয় তার সাথে অন্যায্য আচরণ করা হচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্ণবাদী ও সেমিটিক-বিরোধী বিষয় প্রকাশকারী বেইটবার্টের পক্ষ সমর্থন করে বলেন, তা দি টাইমস থেকে পৃথক নয়, শুধু অনেক বেশি রক্ষণশীল।
ট্রাম্প বলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে ব্যাপক দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তোলার আশা করেন। তিনি বলেন, আমি আসলেই তাকে অনেক পছন্দ করি এবং আমি একটু বিস্মিতই যে, আমি আপনাদের বলছি যে আমি তাকে ভালোবাসি।
তিনি গর্বের সাথে সেসব রিপাবলিকানের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের কথা বলেন যারা তার কাছ থেকে দূরে গিয়েছিলেন ও তারপর নিজেদের দৌড়ে হেরে যান। তিনি বলেন, তাদের একজন নিউ হ্যাম্পশায়ারের সিনেটর মিস কেলি আয়োট তার প্রশাসনে একটি চাকরি পেতে ভালোবাসতেন। আমি তাকে বলেছি যে না, ধন্যবাদ। তিনি আমাকে ভোট দিতে অস্বীকার করেছিলেন। মিস কেলি নিউ হ্যাম্পশায়ারের গভর্নর ম্যাগি হাসানের কাছে পরাজিত হন।
ট্রাম্প নেভাদার প্রতিনিধি জো হেকের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, হেক একটি বেলুনের মতো চুপসে গেছেন।
তিনি বলেন, তার বিস্ময়কর বিজয়ের জন্য রিপাবলিকান নেতারা তার কাছে ঋণী। এখন তারা আমার ভালোবাসায় পড়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন