শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

স্বেচ্ছাচারিতা না অদক্ষতা

কাকে ধরছে-কাকে ছাড়ছে দুদক?

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

অভিযোগের অনুসন্ধান হবে কি হবে না- এ প্রশ্নে অদক্ষতা এবং স্বেচ্ছাচারী আচরণ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)র অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটি (যাবাক)। সংস্থাটি তফসিলভুক্ত না হলেও কখনো কখনো অনুসন্ধান সুপারিশ করছে। আবার তফসিলভুক্ত অনেক অভিযোগই অনুসন্ধানের সুপারিশ না করে পাঠিয়ে দিচ্ছে এখতিয়ারহীন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে। এর ফলে অনেক নিরীহ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধানের নামে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অনেক অপরাধীও পাচ্ছেন এক ধরনের দায়মুক্তি। অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা জানান, এটি হতে পারে ‘যাবাক সেল’র অজ্ঞতা, অদক্ষতা কিংবা স্বেচ্ছাচারিতা। তবে সংস্থাটির মুখপাত্র, দুদক সচিব বলছেন, এমন সুনির্দিষ্ট ঘটনার কথা আমার জানা নেই।

দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি হয়েছে কি হয়নিÑ অনুসন্ধানের মাধ্যমে উদ্ঘাটনের দায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশনের। ‘অভিযোগ’ অনুসন্ধানযোগ্য কি-নাÑ সেটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য রয়েছে কমিটি। এই কমিটি ‘যাবাক’ নামেও পরিচিত। যাবাককে গুরু দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে কমিশন। যাবাকের সুপারিশ প্রাপ্তি সাপেক্ষে কমিশন অনুসন্ধান করা কিংবা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কমিশনের এই নির্ভরতাই বলছে, যাবাকসংশ্লিষ্টরা কমিশনের অত্যন্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত। তবে যাবাকের সাম্প্রতিক কিছু সুপারিশ কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্বশাসিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে করেছে বিতর্কিত। যা প্রকারান্তে কমিশনের ভেতরকার অদক্ষতা, অনভিজ্ঞতা, সমন্বয়হীনতা এবং অদূরদর্শিতার উৎকট বাস্তবতাকেই বিচ্ছুরিত করেছে।

দুদক সূত্র জানায়, বীমা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অর্থ আত্মসাৎ, সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন, জালিয়াতি দুর্নীতি দমন কমিশনের তফসিলভুক্ত অপরাধ। এ কারণে গত ৮ মার্চ ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শীর্ষ ৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পৃথক দু’টি মামলা করে। মামলা দু‘টির এখন তদন্ত চলছে। মামলা দু‘টিতে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ১০৯ ও ৪০৯ ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ধারা প্রয়োগ করা হয়। মামলা রুজুর আগে কমিশন দীর্ঘ অনুসন্ধান চালায়। এর আগে অভিযোগটি অনুসন্ধানের পক্ষে সুপারিশ করে অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটি (যাবাক)। অনুসন্ধানে দুর্নীতি হয়েছে-মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় কমিশন মামলা দায়েরের অনুমোদন দেয়।

পক্ষান্তরে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি: নামক আরেকটি বীমা প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াতির অভিযোগ ‘অনুসন্ধান যোগ্য’ই মনে করেনি ‘যাবাক’। কোনো ধরনের অনুসন্ধান না করে যাচাই-বাছাই পর্যায়েই একপ্রকার দায়মুক্তি দেয়া হয়। যাবাক অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তের জন্য অভিযোগটি কমিশনে সুপারিশ করেনি। বরং ফৌজদারি অপরাধের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ারই নেই; এমন একটি সংস্থার কাছে (বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ) ‘ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্ত’ অভিযোগটি ফেরত পাঠায়।

গত ৭ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে দেয়া ‘জরুরি’ পত্রটিতে (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.১৯৭.২২-২০৯৬০) স্বাক্ষর করেন ‘দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল’ সংক্রান্ত কমিটির আহ্বায়ক (পরিচালক) উত্তম কুমার মণ্ডল। বীমা প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তার নাম মো. জহির উদ্দিন। তিনি একাধারে প্রতিষ্ঠানটির কোম্পানি সেক্রেটারি, আইন কর্মকর্তা, উন্নয়ন ও প্রশাসন প্রধান, হেড অব এজেন্সি এবং হেড অব শেয়ার ডিপার্টমেন্ট। দুদকে দেয়া অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, চুরি, ছাড়পত্র জালিয়াতি এবং শেয়ার জালিয়াতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। মো. জহির উদ্দিনের বিরুদ্ধে করা অভিযোগটি দুদকে জমা পড়ে চলতিবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি। অভিযোগটি যাবাকের হাতে আসে চলতি বছর ১ মার্চ। অনুসন্ধান না করে আইডিআরএ‘র কাছে ফেরত পাঠানো হয় ৭ জুন। অথচ অভিযোগের বিষয়ে নিজেরা অনুসন্ধান না করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার কোনো বিধান দুদকের বিদ্যমান কার্যবিধিতে নেই। কমিশন যদি মনে করে বাইরের কাউকে দিয়ে অনুসন্ধান-তদন্ত করবেন তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিকে দুদক ইউ.ও. কিংবা আই.ও. নিয়োগ দিতে পারে। কিন্তু কোনো ধরনের এখতিয়ার প্রদান ছাড়াই দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের বিষয়ে ‘ব্যবস্থা’ নিতে সরাসরি পাঠিয়ে দেয়া হয় ‘আইডিআরএ’র কাছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তম কুমার মণ্ডল বলেন, অভিযোগের সঠিকতা নিরূপণে বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

এদিকে ঠিক বিপরীত অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায় দেশের ১১৬ আলেম, জনপ্রিয় বক্তা এবং ইসলামী চিন্তাবিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ২২১৫ পাতার কথিত ‘শ্বেতপত্র’ আমলে নিয়ে ত্বরিৎ অনুন্ধানের সুপারিশ করেন দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল’ সংক্রান্ত কমিটির আহ্বায়ক (পরিচালক) উত্তম কুমার মণ্ডল। প্রেষণে আসা এই পরিচালক একাধারে যাবাকের সদস্য সচিবও। তিনি মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খান বরাবর গত ২১ জুন সুপারিশ (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০৩.৩১.০১৯.২২.৫১) পাঠান। সুপারিশের ‘বিষয়’ হিসেবে উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন (১ম খণ্ড) ও বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন (২য় খণ্ড) এবং বাংলাদেশের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন (শ্বেতপত্রের ভূমিকা, সারাংশ ও সুপারিশ) প্রসঙ্গে।’ অর্থাৎ ঘাদানিক যে শিরোনামে কথিত ‘শ্বেতপত্র’ দুদকে জমা দিয়েছে উত্তম কুমার মণ্ডল সুপারিশে একই শিরোনাম ব্যবহার করেন। যদিও স্পর্শকাতর এই অনুসন্ধান থেকে পরে সরে আসে কমিশন। পরে জানা যায়, বেসরকারি ব্যক্তিদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে (লন্ডারিং) অনুসন্ধানের এখতিয়ার দুদকের নেই।

কারা করছেন যাচাই-বাছাই : সংস্থাটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দুর্নীতির অভিযোগ প্রাথমিকভাবে বাছাইয়ে একাধিক কমিটি প্রতিষ্ঠানটিতে সব সময়ই ছিল। কমিশন সাধারণত: দুদক আইনে অভিজ্ঞ, দক্ষ এবং সিনিয়র কর্মকর্তাদের বাছাই কমিটিতে রাখা হতো। একেকটি বাছাই কমিটিতে ৩ জন কর্মকর্তা থাকতেন। কিন্তু বিগত কমিশন ৩টি বাছাই কমিটি ভেঙে একটি কমিটি করে। বাড়ায় কমিটির সদস্য সংখ্যাও। ব্যাপক এখতিয়ার প্রদানের পাশাপাশি বাছাই কমিটির ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রশাসন ক্যাডারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। মহাপরিচালক (প্রেষণে আসা প্রশাসন ক্যাডার) এ কে এম সোহেল এই বাছাই কমিটির প্রধান। যাচাই-বাছাই কমিটির ভেতর ‘দৈনিক ও সাম্প্রতিক সেল’ নামে আরেকটি কমিটি রয়েছে। এ কে এম সোহেলসহ এখানে রয়েছেন ৮ কর্মকর্তা। কমিটির সদস্য সচিব পরিচালক (প্রেষণে আসা প্রশাসন ক্যাডার) উত্তম কুমার মণ্ডল। এছাড়া রয়েছেন প্রেষণে কর্মরত উপ-পরিচালক ইমরুল কায়েস ও মো. শিবলী সাদিক। দুদকের সহকারী পরিচালক এ কে এম ফজলে হোসেন, ফাতেমা সরকার, উপ-সহকারী পরিচালক সাবিকুন্নাহার এই সেলে থাকলেও তারা ক্লারিক্যাল কাজগুলো করেন।

সূত্রমতে, অভিযোগ অনুসন্ধানযোগ্য কি-নাÑ এই সিদ্ধান্তটি নিচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তারা। দুর্নীতি অনুসন্ধান-তদন্তের বিষয়ে মহাপরিচালকসহ কারোরই কোনো অভিজ্ঞতা নেই। একই কারণে দুদকের তফসিল সম্পর্কেও তারা অনভিজ্ঞ। যে কাজটি তারা দক্ষতার সঙ্গে করেন সেটি হচ্ছে, প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলো কি-না সেটি লক্ষ্য রাখা। যা কি না সংস্থাটির আইনে উল্লেখিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তফসিল (ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ, আত্মসাৎ, জাল-জালিয়াতি ও মানিলন্ডারিং)। অভিযোগ রয়েছে, যাবাক গত ৭ বছরে প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছেÑ এমন নজির বিরল। এর আগের কমিশন আমলে করা সুপারিশের ভিত্তিতে অনুসন্ধান শুরু হলেও সেটি মামলা অবধি গড়ায়নি। দুদকের কোনো কর্মকর্তা প্রশাসন ক্যাডারের কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ পাঠালেও তার ওপর নেমে আসে নানামুখি শাস্তির খড়গ। অর্থাৎ যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সবচেয়ে বড় এবং বেশি অভিযোগ, তাদের বিষয়েই যাবাক কোনো সুপারিশ করছে না। কোনো অনুসন্ধান ছাড়াই হয়ে যাচ্ছে নথিভুক্ত। এবং এই নথিভুক্তির কোনো রেকর্ডও রাখা হচ্ছে না। পক্ষান্তরে সুপারিশ করছে সরকারি অফিসের কেরাণী, রাজউক কর্মচারী, সিটি করপোরেশন কর্মচারী, উপজেলা হিসাব রক্ষক, ইউনিয়ন পরিষদ সচিব, ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ প্রশাসন ক্যাডার নন-এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। বেসরকারি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সুপারিশ দিচ্ছে ‘অবৈধ সম্পদ অর্জন’ অনুসন্ধানের। এভাবে কোনটির অসুন্ধান হবে কোনটির হবে নাÑ এই ‘পিক অ্যান্ড চ্যুজ’র কাজটি সম্পাদন করছে যাবাক।

সংস্থাটির সিনিয়র কর্মকর্তারা জানান, যাবাক সদস্যদের অনভিজ্ঞ, অদক্ষতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা। যে কারণে দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা এখন ক্রমশ: তলানির দিকে। ভুক্তভোগীদের কাছে এটি এক হয়রানিমূলক ও উন্নয়ন-প্রতিবন্ধক একটি সংস্থাও বটে।
তফসিলভুক্ত অপরাধের তথ্য সংবলিত অভিযোগ অনুসন্ধান না করে এখতিয়ারহীন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর বিষয়টি দুদকের কার্যবিধিতে রয়েছে কি-না- জানতে চাইলে সংস্থাটির সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। জেনে জানাতে হবে। দুদকের তফসিলভুক্ত কোনো অপরাধের অভিযোগ এখতিয়ারহীন প্রতিষ্ঠানে ফেরত পাঠানোর কথা নয়। এমনটি ঘটে থাকলে এ বিষয়ে কথা বলতে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রয়োজন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন