মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

উন্নয়ন ও দুর্নীতি একসঙ্গে চলতে পারে না

মো. শাহাদাত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০২২, ১২:০৪ এএম

আমাদের দেশে অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু উন্নয়ন আরো টেকসই হতো যদি দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারতাম। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দুর্নীতি মোকাবেলা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সরকার, প্রশাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান- সবক্ষেত্রেই দুর্নীতির সয়লাব। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য ছোট-বড় সামর্থ্য অনুযায়ী সহজেই দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ছি। দুর্নীতি আমাদের জন্য অভিশাপ জেনেও লোভ সামলাতে না পেরে আমরা জাতীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছি।

দুর্নীতি বলতে আমরা বুঝি নিয়ম বহির্ভূত ব্যক্তি কিংবা দলীয় স্বার্থে বা অর্থের লোভে স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো কাজ করা। এটা একটা অপরাধমূলক এবং নীতিবিবর্জিত ঘৃণিত কাজ। আদর্শ ও নৈতিকতা হারিয়ে সামান্য অর্থ কিংবা স্বার্থের লোভে মানুষ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশে এক সময় সর্বত্র শোনা যেত জনসংখ্যা উন্নয়নের বাধা। আর এখন শোনা যাচ্ছে, দুর্নীতি জাতীয় উন্নয়নের এক নম্বর শত্রু। বাড়ির ভেতর থেকে শুরু করে চায়ের স্টল, সেমিনার-সভা, বক্তৃতার মঞ্চ ছাড়াও টকশোতে সারাদিন চলছে দুর্নীতির আলোচনা। দুর্নীতিবাজরা সংখ্যায় বেশি না। তারা আমাদের সমাজেরই গুটি কয়েক প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তি। তাদের আমরা চিনি এবং ভালো করে জানিও। কিন্তু আমরা নৈতিকভাবে এতোটাই দুর্বল যে তাদের সমাজ থেকে বয়কট কিংবা ঘৃণা করতে পারছি না।

দুর্নীতি জাতীয় উন্নয়নের অন্তরায়। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য যত বড় এবং সমৃদ্ধ পরিকল্পনা করা হোক না কেন যদি এতে দুর্নীতির সংস্পর্শ থাকে তবে সে উন্নয়ন ফলপ্রসু হয় না। ছোট পরিকল্পনা এবং বাজেট অল্প হলেও একটা কাজ যদি দুর্নীতিমুক্ত হয় তবে তা হবে জননন্দিত এবং ফলপ্রসু। জাতীয় উন্নয়নকে সমৃদ্ধ করতে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সরকার প্রয়োজন। শুধু সরকার কিংবা প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত হলেই আবার হবে না, জনসাধারণকেও দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। একটা দেশ বা সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা অনেক কঠিন, তবে অসম্ভব না। যাদের পূর্বপুরুষ অপকর্ম ও অন্যায়ের সাথে জড়িত তাদের বংশধর ভালো হবে, এটা আশা করা যায় না। যেমন- বাংলাদেশ টানা কয়েকবার দুর্নীতিতে শীর্ষে ছিলো। আমাদের ধর্মে বলা আছে, দুর্নীতি করা এবং এর প্রশ্রয় দেয়া একটা পাপের কাজ। অথচ আমাদের অনেক ‘ধার্মিক’ ব্যক্তিও বিভিন্নভাবে দুর্নীতির সাথে জড়িত। দুর্নীতি হচ্ছে নিঃশব্দে কুরে খাওয়া ঘুণের মতো। তাই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়।

সরকার দেশের উন্নয়নে বরাদ্দ দিলেও তা জনসাধারণের কাছে ঠিকমতো পৌঁছে না। শিক্ষা, চিকিৎসা ও অবকাঠামোর উন্নয়নে ঠিকই বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু গ্রামীণ পর্যায়ে যেতে বরাদ্দ বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের অনেকেই বরাদ্দকৃত অর্থ নিজেদের জন্য বিশাল অঙ্কের ভাগ শুরু করে। ফলে উন্নয়ন দুর্বল হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পর্দা কেলেঙ্কারি, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বালিশ ক্রয়ের দুর্নীতি এবং ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রমাণ করে আমরা কতটা দুর্নীতির জালে বন্দি। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর সরকার বিভিন্ন সময়ে লকডাউন দিয়ে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষের সহায়তা করার জন্য অর্থ ও খাদ্য বরাদ্দ দিলেও তা স্থানীয় প্রশাসন ও নেতারা আত্মসাৎ করে। কোভিড-১৯ যেখানে আমাদের সহনশীল ও নীতিবান হতে শেখায় সেখানে আমরা গরীবদের সামান্য ত্রাণ দুর্নীতি করে নিজেদের ঘরে তুলে নিচ্ছি।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার। প্রশাসন ও সরকারি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য সরকার শুদ্ধাচার কৌশল গ্রহণ করেছে। মানব সেবায় নিয়োজিত থেকে কোন ধরনের অপকর্ম ও দুর্নীতির সাথে জড়াবে না এমন শপথ করিয়ে কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অফিসে ঢুকতে চোখে পড়ে ‘আমার অফিস দুর্নীতি মুক্ত’। কিন্তু সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ভিতরে ঠিকই চলে দুর্নীতির হাট। বর্তমানে পাসপোর্ট অফিস ও বিআরটিএ অফিসে টাকা ছাড়া কাজ হয় না। এখানে চলে বড় ধরনের দুর্নীতি। আজ চাকুরির নিয়োগে চলছে বাণিজ্য। শিক্ষায় চলছে দুর্নীতি। পছন্দের ব্যক্তিকে চাকুরি দিতে উপর মহল থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে। দুর্নীতির মহড়া চলছে কিন্ডার গার্ডেন স্কুল থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বিশ্ববিদ্যালয়েও। যে শিক্ষক দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেন তিনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না তাঁর নিয়োগে দুর্নীতি হয়নি। মেধা আজ অর্থ ও ক্ষমতার কাছে অসহায়। একটা দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে সে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর। আজ উচ্চ শিক্ষায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার কথা বলা হয় না। দুর্নীতিবাজরা ভর্তি বাণিজ্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দিচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি তথা অর্থ ও ক্ষমতার প্রভাব খাটানোকে আজ কেউ অন্যায় মনে করে না। ফলে আমরা সবার জন্য শিক্ষা অর্জন করতে পারলেও মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছি। এতে জাতীয় উন্নয়ন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

বাংলাদেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ভালই হচ্ছে। দুর্নীতিমুক্ত রাখতে এ বিভাগে অনেক উদ্যোগ নেয়া হলেও এখানে চলে অনৈতিক লেনদেন। লাইনম্যানদের সাথে চুক্তি করে বিদ্যুৎ বিলের পরিবর্তন ঘটানো হয়। সিস্টেম লসের কথা বলে কর্মকর্তারা কোটি কোটি টাকা নিজের পকেটে ঢুকাচ্ছে। মেশিন ও বিদ্যুৎ সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতি চোখে পড়ার মতো। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর ঘাটে ঘাটে এখন দুর্নীতি। নতুন সংযোগ, মিটার লাগানো, বিদ্যুতের খুঁটি স্থানান্তর প্রভৃতি কাজে সাধারণ জনগণকে ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ শ্লোগান দিয়ে অনেক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা দুর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

যদি আমরা দেশের মহান পেশায় নিয়োজিত শিক্ষকদের কথা বলি তাহলে লজ্জায় মাথা নত হয়। সামান্য উপবৃত্তির টাকা নিজের পকেটে ঢুকাতে প্রাথমিক শিক্ষকদের মনে একটুও বাধে না। আবার অনেক বিদ্যালয়ের সভাপতি নিজের আত্মীয়-স্বজনদের অগ্রাধিকার দিয়ে উপবৃত্তির টাকা সংগ্রহ করে। শিক্ষক নিয়োগে আজ টাকার ছড়াছড়ি। অবৈধভাবে সনদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে অবসর ভাতা বা পেনশন উত্তোলনেও শিক্ষকরা আজ অনৈতিক পন্থা বেছে নিচ্ছেন। অনেক সময় হয়তো তাঁরা নিরূপায় হচ্ছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্নীতি করছে।

আমাদের দেশে গণতন্ত্রের চর্চা থাকলেও ভোটের সময় অবৈধ অর্থের লেনদেন হয়। প্রার্থী ও ভোটাররা অবৈধভাবে অর্থের বিনিময়ে ভোট কেনা-বেচা করে। ফলে প্রভাবশালী ও বিত্তবানরা ভোটে নির্বাচিত হয়। নির্বাচিত হওয়ার পর গরীব ও দরিদ্রদের সাহায্যের টাকায় নিজের পকেট ভর্তি করে। রাস্তা-ঘাট নির্মাণে যে বরাদ্দ আসে তা নিজের জন্য ব্যয় হয়। জনগণও তাদের কাছে নিরুপায়। কারণ ভোটের সময় তারা নিজেরা বিক্রি হয়েছিলো টাকার কাছে। গ্রামের মেম্বার থেকে শুরু করে এমপি নির্বাচন একই রোগে আক্রান্ত। ফলে আমাদের সমাজ থেকে দুর্নীতি নামক ভাইরাস দূর হচ্ছে না।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার তাঁরা মনে করেন, দুর্নীতির জন্য ৯০ শতাংশ দায়ী রাজনৈতিক নেতারা। তাদের নোংরা ও হিংসাত্মক রাজনীতি এবং হাঠাৎ করে ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষার কারণে দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে শুধু খাতা-কলম কিংবা বক্তৃতার মঞ্চ নয়, বাস্তবে রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক নেতা ও আমলারা দেশ চালাচ্ছে। তাঁরা যদি মনে করেন কাল থেকে দেশে কোন দুর্নীতি থাকবে না, তাহলে সত্যি দুর্নীতি দূর হবে। মানুষ বাস করবে শান্তিতে। দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হবে। আর এ উন্নয়ন টেকসই হবে।
সৃষ্টির আদিকাল হতেই দুর্নীতি চলে আসছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য এটি একটি জটিল ব্যাধি। সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতি দমন করা শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টি হলে দুর্নীতি দূর হবে। যেখানেই দুর্নীতি সেখানেই প্রতিরোধ তৈরি করতে হবে। যেখানে দুর্নীতি হয় সেখানে তাদের শাস্তি বিধানের চেয়ে যেন দুর্নীতি না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকৃত শিক্ষা এবং দুর্নীতি করলে কঠোর শাস্তির বিধান কার্যকর করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেশকে অতীতের গ্লানি থেকে মুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।
আমাদের রক্তে এবং রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবাহমান। দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করা কঠিন। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নীতি-নৈতিকতা চর্চা করলে সমাজ দুর্নীতিমুক্ত হতে পারে। পরিবার থেকে পিতা-মাতা যদি অন্যায় এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে গড়ে উঠতে সন্তানকে পরামর্শ দেন তবে সমাজ সুন্দরভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। আবার আইন থাকলে এর প্রয়োগ হচ্ছে ব্যক্তিভেদে। ফলে দুর্নীতিবাজরা আইনের ফাঁক দিয়ে সহজেই বের হচ্ছে। সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে।
দুর্নীতির শাস্তি কার্যকর করে ছোট বড় সকলকে আইনের আওতায় আনতে পারলে দুর্নীতি কমে যাবে। অবৈধ অর্থের উৎস অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বচ্ছতার সাথে কাজ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে শিশুকাল থেকেই নীতি-নৈতিকতা চর্চা করতে হবে। স্কুলের শিক্ষক যেন অনুকরণীয় হয় সেজন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের চরিত্রবানরূপে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হবে।

লেখক: অফিসার (আইটি), সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, গোমস্তাপুর শাখা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
hsahadat30@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন