শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

পশু ও মনের কোরবানি

শহিদুল ইসলাম নিরব | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০২২, ১২:০২ এএম

পবিত্র কোরানে অনেক ঘটনা ও শব্দ রূপক। আমরা যখন কবিতা লেখি তখনও অনেক রূপক ও উপমার আশ্রয় নিই। কোরবানি শব্দটিও রূপক। শব্টি ডাবোল মিনিং বেয়ার করে। শাহ্ সুফি সদরউদ্দিন আহমেদ চিশতীর রচিত কোরবানি’ বইটিতে ভেতরের দিকটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি পশু কোরবানির চেয়ে মনের পশুগুলিকে কোরবানির গুরুত্ব দিয়েছেন। মনের ভেতর যে পশুগুলো লুকিয়ে আছে সেই পশুগুলোকে কোরবানি করতে বলেছেন। তবে ইহা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, মনের পশুটিকেই কোরবানি করতে হয় এবং ইহাই মূল কোরবানির দর্শন। কিন্তু কোরবানির একটি অনুষ্ঠান যদি না থাকে এবং সেই অনুষ্ঠানটি পালন করতে গিয়ে যদি গৃহপালিত হালাল পশু হয় তবে খুবই ভাল। যদি কোরবানিটিকে দৃষ্টির দর্শনে নিষ্ঠুরতা বলে মনে করা হয়, তাহলে বলার কিছু থেকে যায়। কারবালার যুদ্ধে ইমাম হোসায়েন এবং আওলাদে রসুল এবং সাহাবা ও মদিনার আনসারগণ যে শহিদ হয়েছেন এটা কি একটি নিষ্ঠুর অনুষ্ঠান নয়? এই নিষ্ঠুর অনুষ্ঠানটি যে ঘটবে তা মহানবি সূর্যের আলোর চেয়েও বেশি পরিষ্কার দেখেছেন। তবুও অনুষ্ঠানটি যাতে না ঘটে তার জন্য আল্লাহর দরবারে কোন ফরিয়াদ করেননি। যদিও নবি ইব্রাহিম তাঁর পুত্র নবি ইসমাইলকে আল্লাহ্র হুকুমে কোরবানি করতে গিয়ে মনে মনে পুত্রকে জীবিত দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মুখে উচ্চারণ করেননি। তবুও আল্লাহ্ নবি ইব্রাহিমের মনের ইচ্ছাটিকে পূরণ করায় একটি গৃহপালিত পশু দ্বারা দুম্বা কোরবানি হয়েছিল। পশু কোরবানির অনুষ্ঠানটি অনেকের কাছে ভাল লাগার কথা নয়। কিন্তু অপ্রিয় সত্যটি হল অনুষ্ঠানটি চালু ছিল, আছে এবং থাকবে। যদি কোরবানির অনুষ্ঠানটি না থাকে, তাহলে মূল বিষয়টি হয়ে পড়ে বিমূর্ত তথা নিরাকার। সবার অনুভূতি এই বিমূর্তকে অনুভব করতে পারে না। তাই এই অনুষ্ঠানটির মাধ্যমেই কিছু লোক মূল দর্শনের গন্ধটি পায়। মহানবির কোন একটি বিষয়ের রহস্যপূর্ণ কথা শুনে সাহাবা আবু জর গিফারী অবাক হয়ে তিনবার প্রশ্ন করার পরও বলা হল আবু জরের নাকে আঘাত লাগলেও সত্য। তাই পশু কোরবানিটি অনেকের কাছে ভাল না লাগলেও তথা নাকে আঘাত করার মত সত্য। সুরেশ্বরী মাছ মাংস খেতেন না। সুরেশ্বরীর পির শাহ্ সুফি ফতেহ আলী শাহ্ এর নামে প্রতিবছর ওরশ পালন করেন এবং সেই ওরশে পশু জবাই করা, হত। একবার সুরেশ্বরী একটি পশুর গায়ে হাত রেখে বললেন যে, আমার মুরিদান তোকে খেতে চায়, তুই স্বাভাবিক অবস্থায় মারা গেলে শেয়াল শকুন খাবে, তার এখন মারা গেলে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবেরা খাবে। (মারাত্মক চিন্তার বিষয় এবং তিক্ত বাস্তব সত্য কথা।) এই কথাটি বলে তিনি অন্দরবাড়িতে চলে গেলেন। তারপর থেকে বাবা সুরেশ্বরীর মুরিদেরা আর পশু জবাই করেননি এবং আজ প্রায় সোয়াশ বছরে আর একটি পশুও জবাই করা হয় না। সুতরাং অনুষ্ঠানটি হল মূল দর্শনের লক্ষ্যে। যখন অনুষ্ঠান তার উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে তখন তার মূল্যটি হালকা - হয়ে পড়ে। একবার বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কাছে এক যুবক এসে আপেক্ষিক তত্ত্বের রহস্য জানতে চাইলো। যুবকটির বিদ্যার দৌড় কম থাকাতে তিনি বললেন, ‘দেখ বাবা, জ্বলন্ত চুলার সামনে এক মিনিট থাকলে মনে হবে অনেকক্ষণ বসে আছ। আবার তোমার প্রেমিকার কাছে এক ঘণ্টা বসে মধুর আলাপ করলে মনে হবে এক মিনিট বসে আছ। এটাই হল আপেক্ষিক তত্ত্ব। তাই আবার বলছি, কোরবানির মূল দর্শনে গৃহপালিত হালাল পশুটিও নেই এবং লৌহ খণ্ড দিয়ে বানানো তরবারিটিও নেই। “তাই হজরত আবু বকর, হজরত ইবনে আব্বাসের মত অনেক সাহাবা কখনোই পশু কোরবানি দিতেন না। কারণ হিসাবে যদি জনগণ এটাকে বাধ্যতামূলক অথবা অবশ্য পালনীয় সুন্নত হিসাবে ভেবে নেয়! (কিতাব-উল-উম্মা-ইমাম শাফি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৯)” “কোন কোন সাহাবা নিজে পশু কোরবানি না দিয়ে পশু কেনার টাকা গরিব ও অভাবী মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হজরত বেলাল। তিনি একটি মুরগি জবাই করতেন। প্রশ্ন করাতে তিনি বললেন যে, পশু কোরবানি করার চেয়ে ঐ পশু কেনার টাকা গরিবদের বিলিয়ে দিতে পছন্দ করতেন। হজরত বেলালের এ বিষয়টিকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন হজরত সাইদ বিন সুমাইয়া, ইমাম আতা, হজরত হাসান, ইমাম তাউস, হজরত জাবির বিন সাঈদ, ইমামুল কামা, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, ইমাম আবু সুলেমান। (জনাব সাদ উল্লাহ্-ইসলাম গবেষক)।” অনেকে দৃষ্টিভঙ্গির দর্শনে পশু কোরবানি করাটাকে এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু একটি বিমূর্ত সত্যকে বোঝাতে গেলে মূর্ত অনুষ্ঠানের প্রয়োজন। মূর্ত অনুষ্ঠান এবং বিমূর্ত সত্য দুটোকেই মেনে নিতে হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন