বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

রাজনৈতিক বংশের ক্ষমতার ক্ষুধা, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় ধ্বংস শ্রীলঙ্কা

দ্য গার্ডিয়ান | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০২২, ১২:০২ এএম

শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। দেশটির কোষাগার সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেছে এবং দেশটি জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধ আমদানি করতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের মতে, শ্রীলঙ্কা একটি ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট মোকাবেলা করছে; দিনে একবার খাবার জোগাতেও অনেককে লড়াই করতে হচ্ছে। অস্ত্রোপচার ও ক্যান্সারের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেছে, স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে এবং জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় পেট্রোল বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, ‘আমাদের অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।’
এটি শ্রীলঙ্কার জনগণকে একটি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের প্ররোচনা দিয়েছে, যা মূলত রাজাপাকসা পরিবারের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে, যারা গত দুই দশক ধরে দেশটির রাজনৈতিক ক্ষমতায় রয়েছে। গত মার্চ থেকে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। তার বড় ভাই এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসা ব্যাপক গণবিক্ষোভে ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন। তার ছোট ভাই বাসিল রাজাপাকসা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য যারা মন্ত্রিসভায় ছিলেন বা রাজনৈতিক পদে ছিলেন, তারাও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
ভেতর থেকে প্রত্যক্ষকারীদের মতে, শ্রীলঙ্কার বর্তমান সঙ্কটের শেকড়টি রাজাপাকসা পরিবারের মধ্যে নিহিত, যারা ক্ষমতাকে এমনভাবে কেন্দ্রীভূত করেছিল যে, দেশটি একটি স্বৈরাচারী পারিবারিক ব্যবসার মতো হয়ে উঠেছে এবং জাতিকে দেউলিয়া করে করে দয়োর জন্য কারও কাছে দায়বদ্ধ নয়। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পতন শুরু হওয়ার সাথে সাথে পরিবারটি অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং দুই ভাই গোতাবায়া এবং মাহিন্দার মধ্য কার একসময়ের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। কারণ তারা উভয়ই ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন। ৯ মে তিন দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে দেশের সবচেয়ে খারাপ সহিংসতা হিসেবে পারিবারিক বিভাজনটি রাস্তায় নেমে আসে।
মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রী, বিরোধী রাজনীতিবিদ, রাজাপাকসাদেরর সহকারী এবং আস্থাভাজনরা, যাদের মধ্যে অনেকের এখনও রাজাপাকসা পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের সাথে স্বার্থ এবং দৃঢ় সম্পর্ক নিহিত রয়েছে, তারা পরিস্থিতির জন্য পরিবারটির তথাকথিত কৌশলবিদ বাসিলের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগ পর্দার আড়ালে ক্ষমতার দালাল হিসাবে কাজ করা বেসিলের প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রিসভার উপর অতুলনীয় প্রভাব রয়েছে বলে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী দাবি করেছেন। তবুও অর্থনীতি চালানোর ক্ষেত্রে তিনি অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছেন এবং আসন্ন আর্থিক মন্দা সম্পর্কিত একাধিক সতর্কতা উপেক্ষা করেছেন।
২০১৯ সালের শেষের দিকে গোতাবায়া ক্ষমতা নেওয়ার অনেক আগেই শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সমস্যা শুরু হয়। ১৯৭৭ সাল থেকে পরবর্তী সরকারগুলি ঋণের একটি অনিশ্চিত ভিত্তির উপর দেশটিকে গড়ে তুলেছিল। অত্যধিক আমদানি রপ্তানিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং একটি প্রগতিশীল কিন্তু ব্যয়বহুল কল্যাণ রাষ্ট্র সেই ঘাটতিকে আরও প্রসারিত করে, যা আরও উচ্চ-সুদে ঋণের মধ্যমে প্রশমন করা হয়েছিল। প্রাক্তন জ¦ালানী মন্ত্রী উদায়া গামানপিলা বলেন, ‘এটি ছিল একটি টাইমবোম যা এপর্যন্ত কয়েক দশক ধরে জমা হয়েছে। সবকিছুই ধার করে বানানো হয়েছে, অর্জিত টাকা দিয়ে নয়।’
২০০৫ সাল থেকে, যখন মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন এবং পরিবারটি রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে, তারাও ব্যাপকভাবে ঋণ নিতে শুরু করে। প্রথমে তামিল সংখ্যালঘু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কার তিন দশকের গৃহযুদ্ধের জন্য অর্থ প্রদানের লক্ষ্যে, যা একটি নৃশংস পরিণতিতে পর্যবসিত হয়েছিল। তারপর, ২০০৯ সালে রাস্তা, বিমানবন্দর, স্টেডিয়াম এবং বিদ্যুত গ্রিডগুলির ‘সুপার-গ্রোথ’ উন্নয়নের জন্য। শ্রীলঙ্কার জিডিপি ২০ বিলিয়সস ডলার থেকে থেকে ৮০ বিলিয়ন ডলারে দাড়ায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় ১৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ নেওয়া হয়, এবং সমস্ত রাজাপাকসারা ঘুষ থেকে শুরু করে অর্থ পাচার পর্যন্ত ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়।
আন্তর্জাতিক সতর্কতা সত্ত্বেও বেসিলের পরামর্শে গোতাবায়া ২০১৯ সালে ব্যাপক শুল্কহ্রাস প্রয়োগ করেন, যার ফলে সরকারের রাজস্ব দুই বছরে এক ট্রিলিয়ন টাকারও বেশি কমে যায়। কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রীলঙ্কার পর্যটন এবং প্রবসী অর্থ প্রবাহও প্রায় স্তিমিত হয়ে যায়। এর মধ্যে বেসিলের অনুসারী গোতাবায়ার প্রাক্তন সচিব পি.বি জয়সুন্দরা আমদানি নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেন। এমনকি, ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়তে থাকার পরেও এবং ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সতর্কবার্তা দেওয়ার পরেও তিনি দেশের ঋণ পুনর্গঠন করতে আইএমএফের কাছে যান। তার বিরুদ্ধে নগদ প্রবাহের বিবৃতি সহ প্রেসিডেন্টকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়ার অভিযোগও রয়েছে।
২০২০ সালের সংসদীয় নির্বাচনে রাজাপাকসাদের দল এসএলপিপি পুনর্নিবাচিত হওয়ার পর সরকারের উপর তাদের দখল আরও শক্তশালী হয়। মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। তার ছেলে এবং উত্তরাধিকারী নমাল রাজাপাকসাকে মন্ত্রিসভায় আনা হয়েছিল এবং রাজাপাকসাদের ভাই বড় চামালকেও। শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক অসাঙ্গা আবেয়াগুনাসেকেরা বলেন, ‘রাজাপাকসারা সমগ্র দেশকে নিয়ন্ত্রণ করত। সরকারে স্বৈরাচারী, অতি-জাতীয়তাবাদী এবং ভারী সামরিকীকরণ ঘটে।’
বাসিল মন্ত্রিসভা এবং তার নজরদারিতে ভিন্নমত সহ্য করেননি। মন্ত্রিসভা এবং আর্থিক তদারকি কমিটিতে থাকা ব্যক্তিরা দাবি করেছেন যে, তাদের দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছিল। এদিকে, শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সমন্বয়হীনতা রাজত্ব করেছে। বেসিল এবং ব্যাঙ্কের গভর্নর অজিথ নিভার্ড ক্যাবরালের মধ্যে একটি স্পষ্ট ফাটল তৈরি হয়েছিল। কয়েক মাস কথা বলতে অস্বীকার তারা করেন এবং ক্রমবর্ধমান আর্থিক সমস্যার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করেন। ক্যাবরাল কোষাগারে শূন্যতা পূরেেণর জন্য অত্যধিক অর্থ ছাপতে শুরু করে, যা ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি ঘটায়।
গোতাবায়া ১৫টি বেসামরিক সরকারী মন্ত্রণালয় পরিচালনার জন্য সামরিক জেনারেলদের নিয়োগ করার পর সরকারী আমলাতন্ত্রও বিশৃঙ্খলতায় পর্যবসতি হয়, যা স্বৈরাচারী এবং অদক্ষ প্রমাণিত হয়েছিল। শ্রীরঙ্কার অতিত গৃহযুদ্ধের তুলনায় গোতাবায়ার অধীনে প্রতিরক্ষা ব্যয় বেড়ে যায়, কোষাগারকে আরও শুষ্ক করে দেয়। এর মধ্যে হঠাৎ করে সমস্ত রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করার ফলে কৃষিখাত ধ্বংস হয়ে যায়। ২০২২ সালের শুরুতে, এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, যে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি, বিশেষ করে এর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, একটি অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার সামনে আরও ঋণ নেওয়ার সমস্ত আন্তর্জাতিক বাজার বন্ধ হয়ে যায়। দেশটি ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে যখন খাদ্য, পেট্রোল এবং ওষুধ আমদানিতে অর্থ প্রদানের জন্য ভুগতে শুরু করে তখন লোকেরা দলে দলে বিক্ষোভ করতে শুরু করে। ফলে গোতাবায়া মহিন্দা ও বাসিলকে পদত্যাগের জন্য ব্যাপকভাবে চাপ দেন। এই নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে রাজাপাকসা পরিবার। ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ বেসিল, মাহিন্দার ছেলে নামাল এবং তাদের ঘনিষ্ঠ মন্ত্রিসভার সহযোগী ও মাহিন্দার শত শত অনুগত তৃণমূল সমর্থক হোতাবায়র বিরুদ্ধে বৈঠক করতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে জড়ো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিডিও ফুটেজ থেকে জানা যায় যে, পরিস্থিতি দ্রুতই হাতছাড়া হয়ে যায়। চিফ হুইপ জনস্টন ফার্নান্দো আহ্বান করেন, ‘আসুন একটি লড়াই শুরু করি। তার (প্রেসিডেন্ট) আমাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত।’ এরপর বেশ কয়েকজন এমপি’র নেতৃত্বে গেটের বাইরে আসা বেসিল-মাহিন্দার আর কিছু সমর্থক গ্যালে ফেসে সরকার বিরোধী প্রতিবাদ শিবিরের দিকে রওনা দেয় যেখানে কয়েক সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভের জন্য হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল। তারা সহিংসভাবে শত শত বিক্ষোভকারীকে মারধর করে এবং তাদের তাঁবু পুড়িয়ে দেয়।
গোতাবায়ার কাছে হামলার খবর পৌঁছলে তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি পুলিশ প্রধানকে হামলা থামানোর নির্দেশ দেন। পুলিশ এবং মন্ত্রীসূত্র মতে, পুলিশ প্রধান গ্যালে ফেস আক্রমণকারী জনতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত ছিলে। কারণ তার সিনিয়ররা বলেছিল যে, এটি মাহিন্দা এবং গোতাবায়ার মধ্যে একটি পারিবারিক বিষয় এবং পুলিশের নাক না গলানোই নিরাপদ। পুলিশ যতক্ষণে প্রতিক্রিয়া জানায়, ততক্ষণে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সহিংসতা শ্রীলঙ্কাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। জনতা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করে। ৭০ টিরও বেশি এসএলপিপি এমপি এবং রাজাপাকসা মিত্রদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং একজন এমপিকে জনতা পিটিয়ে হত্যা করে। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, জঙ্গি রাজনৈতিক সংগঠন সমন্বিত হামলা চালানোর সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে, যা দেউলিয়া দেশটিতে আরও কিছু সম্ভাব্য অরাজকতার বিজ বুনে দিয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Harunur Rashid ৮ জুলাই, ২০২২, ৩:৩৬ এএম says : 0
Next two country on the line for same fate. Wake up people, reject clan politics.
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন