পবিত্র ঈদুল আজহা। আমাদের দেশে কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটা বিভিন্ন নামে পরিচিত। স্পেনে এটাকে ‘মেষ শাবকের উৎসব’ বলা হয়। মিশর, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এটাকে ‘ঈদে বাক্বারাহ’ বলা হয়। ইরানে ‘ঈদে কোরবান’ বলা হয়ে থাকে। তুরস্কে এটা ‘ত্যাগের দিন’ নামে পরিচিত। মরক্কোয় এটা ‘ঈদ উল কাবির’ নামে পরিচিত। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনে এটা শুধু ‘কোরবান’ নামে পরিচিত। আর ভারত ও পাকিস্তানে এটাকে ‘বকরা ঈদ’ বলা হয়ে থাকে। ইসলামের অন্যতম ইবাদত হলো এ কোরবানি। পূর্ববর্তী নবীদের উপরও এ বিধান চালু ছিল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক জাতির উপর কোরবানির বিধান রেখেছিলাম।’ (সূরা হাজ্জ: ৩৪) কোরবানির ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরবানি অনুষ্ঠিত হয়েছিল আদম (আ.) এর পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাধ্যমে। হাবিলের ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠার কারণে তার কোরবানি আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়েছিল। অপরদিকে কাবিলের অনাগ্রহ ও নিষ্ঠাহীনতার কারণে তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। (সূরা মায়েদা: ২৭)।
আর আজ থেকে ঠিক পাঁচ হাজার বছর আগের কথা। নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন হযরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)। আল্লাহর পথে তাদের ত্যাগ এবং উৎসর্গ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। সোনালী আবরণে রচিত আছে পিতা-পুত্রের নজিরবিহীন ঘটনা। “আর যখন পিতা-পুত্র দুজনেই আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করলো। জবাই করার জন্য পিতা যখন পুত্রকে উপুড় করে শোয়ালো। তখন আমি ডাকলাম, হে ইব্রাহিম! নিশ্চয়ই তোমার স্বপ্নকে তুমি সত্যে পরিণত করেছো। আমি বিশিষ্ট বান্দাকে এরুপ পুরস্কার প্রদান করে থাকি। আর প্রকৃতপক্ষে এটি একটি বড় পরীক্ষা।’ (সুরা সাফফাত: ১০৩ -১০৬)। এ ঘটনার কারণে হযরত ইবরাহীম (আ.) বিশ্বব্যাপী ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। সনাতন ধর্মের অনুসারীরাও তাকে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে অনুসরণ করে থাকে। দেখা যায়, সব ধর্মের লোকেরা নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কোরবানি করে থাকে। যদিও সব ক্ষেত্রে কোরবানি বলা হয় না। তবে উর্দু, ফার্সি ও আরবি ভাষায় কোরবানি শব্দটিরও ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। হিন্দু ধর্মে পাঠা বলির কথা সর্বজনবিদিত। এখানে দেবির উদ্দেশ্যে পাঁঠা বলি দেয়া হয়।
হিন্দু ধর্মের অর্থবেদ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘আদিকালে ব্রহ্মার দুই পুত্র ছিল। ১. অথর্ব এবং ২. অঙ্গিরা। ব্রম্মা ঐশী আদেশ মোতাবেক জ্যেষ্ঠ পুত্র অথর্বকে বলি দিতে উদ্যত হন। শাস্ত্রে এটা পুরুষ মেধযজ্ঞ নামে পরিচিত। তারই ধারাবাহিকতায় অদ্যাবধি নরবলির জায়গায় পশু বলি দ্বারা উহা উদযাপিত হয়ে আসছে।’ (অথর্ববেদ: দশম কান্ড, ২৬-৩৩ মন্ত্র) আলোচ্য মন্ত্রে ব্যবহৃত ব্রম্মা শব্দটি মূলত ইব্রাহিম শব্দের পরিবর্তিত রূপ, যা হিন্দু ধর্মের সাহিত্য ও ধর্মীয় রচনাবলীতে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। আবার এটা ইহুদী এবং খ্রিস্টানগণ তাদের ধর্মীয় সাহিত্যে আব্রাহাম ও ব্রাহাম ব্যবহার করে থাকে। মুসলিম বিশ্বে তিনি জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ.) নামেই সমধিক পরিচিত। এ একই ধারাবাহিকতায় ইহুদি ধর্মেও কোরবানি প্রথা প্রচলিত আছে। হুবহু মুসলমানদের মতো না হলেও এ ধর্মে কয়েক ধরনের কোরবানি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো: পোড়ানো কোরবানি, শস্য কোরবানি, গুনাহের কোরবানি, যোগাযোগ কোরবানি ও দোষের কোরবানি। (লেবীয় পুস্তক: ২৩:১৩, ৭:৩১, ৫:১৬, ১৬:১২ ও ২:১২-১৬)
খ্রিস্টান ধর্মের কিতাবুল মুকাদ্দাসে উল্লেখ রয়েছে যে, ইউসুফ ও মরিয়ম ঈসা মসীহর জন্মের সময় দুটি কবুতর কোরবানি করেছেন। সেই থেকে গ্রিসে পশু উৎসর্গ একটি কমন প্রথা হিসেবে প্রচলিত। সেখানে সাধারন মানুষের পক্ষ থেকে একেশ্বরবাদী অর্থোডক্স চার্চে বকরি ও মুরগি দেয়া একটি প্রাচীন রীতি। এছাড়া খ্রিস্টানতত্ত্বের কেন্দ্রে আত্ম বলিদান ও শহীদের ধারণা এখনও বিদ্যমান। আদিপুস্তক ১৪:১৮ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, ‘এই হচ্ছে আমার শরীর যা ঈশ্বরের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। আর এই হলো রক্ত যা পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা’। এছাড়া প্রাচীনকালে বিভিন্ন মহাদেশে, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এবং বিভিন্ন ধর্মে বলিদান প্রথা প্রচলিত ছিল।
ইসলামী পরিভাষায় কোরবানি অর্থ হলো ত্যাগ স্বীকার করা। এর আরেকটি অর্থ নৈকট্য লাভ। আর এ ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমেই কেবলমাত্র আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। আর ত্যাগের ধারনাটা জগত সংসারের সব জায়গাতেই বিদ্যমান। স্বামী-স্ত্রীতে ত্যাগের মানসিকতা না থাকলে সংসার থাকেনা। ব্যবসা-বাণিজ্যে ত্যাগ না থাকলে ব্যবসায় উন্নতি আসে না। রাজনীতিতে ত্যাগী নেতা না থাকলে দল সেখানে অচল। অফিসে ত্যাগ না থাকলে ভালো এ.সি.আর পাওয়া যায় না। বসের সান্নিধ্য পেতে ত্যাগের বিকল্প আর কিছুই হয় না। পার্থিব এ দুনিয়াতে কর্মচারীরা ত্যাগের বিনিময়ে নেতা ও বসের নৈকট্য লাভ করে থাকে। অর্থাৎ পৃথিবীতে ত্যাগ স্বীকারের মানদণ্ডেই মানুষকে মূল্যায়ন করা হয়। ঠিক তেমনি আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কটাও ত্যাগের মাধ্যমেই নির্মিত ও নির্ণীত হয়। আল্লাহর হুকুম পালন করতে যেমন প্রয়োজন ত্যাগ। আবার নিষেধ বর্জন করতেও প্রয়োজন ত্যাগ। মুসলমান হবার প্রথম শর্ত নামাজ আদায়। আরামের ঘুম ত্যাগ না করে শীত-গ্রীষ্মের ফজরের নামাজ আদায় করা যায় না। যাকাত এবং হজ্জ আদায় করতে প্রয়োজন মানসিক, শারীরিক এবং অর্থনৈতিক ত্যাগ। আল্লাহর কাছে যে যত বেশি প্রিয় তাকে ততো বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ সার্বক্ষণিকই আল্লাহর গোলাম ও প্রতিনিধি। আর পৃথিবীর প্রথম প্রতিনিধি হচ্ছেন আদম (আ.)। আর নবী ও রাসুলের মধ্যে সর্বশেষ প্রতিনিধি মহানবী মুহাম্মাদ (সা.)। মহানবীর (সা.) মৃত্যুর পর তাঁর উম্মতগণের উপর এ প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যত প্রতিনিধি প্রেরিত হয়েছেন তাদের সকলকেই আল্লাহ পরীক্ষা নিয়েছেন। অথচ তাঁরা ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ও নির্বাচিত বান্দা। ছিলেন সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। অথচ তাদেরকেই না আল্লাহ সব ধরনের পরীক্ষা নিয়েছেন! তিনি তাদেরকে খাদ্য সংকটের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়েছেন, রোগ-শোক দ্বারা পরীক্ষা নিয়েছেন, জান-মালের ক্ষতির সম্মুখীনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়েছেন। রাজশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে পরীক্ষা নিয়েছেন। জালিম রাজারা তাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে। মিথ্যা অভিযোগে তাদেরকে অভিযুক্ত করেছে। অনেক নবীকে হত্যা করা হয়েছে। কারাগারে অন্তরীণ করা হয়েছে। দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। আর এমনই এক অত্যাচারী রাজা ছিলেন নমরুদ। আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন ইরাকে। আর নমরুদের প্রধান পুরোহিত ছিল আজর। আর আজরের ঔরসেই জন্ম নিয়েছিলেন হযরত ইবরাহীম আ.। তিনি চারিদিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মূর্তি পূজার উৎসব দেখতে পেলেন। এর অসারতা প্রমাণের জন্য একদিন তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন। অতঃপর মূর্তিগুলো ভেঙে দিলেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে হযরত ইব্রাহিম আ. এর বিচার হলো। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাকে দেয়া হলো মৃত্যুদন্ড। জনসম্মুখে তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করবার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে যেন এ জাতীয় আচরণ করার দুঃসাহস কেউ না দেখাতে পারে। আল্লাহর প্রতি হযরত ইব্রাহিম আ. এর দ্বিধাহীন বিশ্বাস, আনুগত্য আর ত্যাগ তাকে আগুন থেকে রক্ষা করল। তিনি তার জাতির হেদায়াত প্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনা দেখলেন না। তাই তিনি অজানা গন্তব্যে রওনা দিলেন। অথচ তার কাছে নাই কোনো পয়সা-টাকা-কড়ি। নেই আশ্রয় নেয়ার মত কোনো ঠিকানা। আর রুজি-রুটিরতো কোনো চিন্তাই ছিলনা। কেবলই আল্লাহর উপর বিশ্বাস এবং ভরসা ছিল তার একমাত্র অবলম্বন। এটা ছিল তাঁর জীবনের প্রথম পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেন। ৮৬ বছর বয়সে তিনি দ্বিতীয় পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি হন পুত্র ইসমাইলের বাবা। নির্দেশ আসে দুগ্ধপোষ্য এ ইসমাইল ও স্ত্রী হাজেরাকে নির্জন স্থানে রেখে আসার। এ পরীক্ষায়ও তিনি পাস করেন। পুত্র ইসমাঈল দৌড়াদৌড়ি করার বয়সে উপনীত হলেন। অতঃপর নির্দেশ আসে তাকে কোরবানি করবার। বাবা ছেলেকে নির্দেশের কথা অবহিত করেন। ছেলের সোজা জবাব, ‘আব্বা! আপনি তাই করুন যা করতে আপনি আদিষ্ট হয়েছেন।’ (আস সাফফাত: ১০২) উল্লেখিত ঘটনা প্রমাণ করে যে, হযরত ইব্রাহিম আ. আল্লাহর প্রেরিত একজন বান্দা, নবী, রাসূল ও তার নির্বাচিত প্রতিনিধি। সর্বপ্রথম তিনি নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছেন। নিজের রুটি-রুজির চিন্তাকে পরিহার করে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করেছেন। আল্লাহর ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। নিজের সন্তান এবং স্ত্রীর প্রতি মায়া ও ভালোবাসা ত্যাগ করেছেন। আর এভাবে বিশ্বব্যাপী হযরত ইব্রাহিম আ. আল্লাহর উপর ভালোবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যেহেতু তিনি অনেক বড় ত্যাগ করেছেন। সেহেতু তিনি অনেক বড় পুরস্কারও পেয়েছেন। তাকে মুসলিম মিল্লাতের পিতা ঘোষণা করা হয়েছে। কাবা শরীফে ইব্রাহিমী পরিবারের স্মৃতি সংরক্ষিত ও সম্পৃক্ত রাখা হয়েছে। সরকারিভাবে তার অনেক স্মৃতি এখানে সুরক্ষিত রয়েছে, যা হজের অনুষ্ঠানাবলীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। হজ্জের সময় হাজিগণ ইব্রাহিমের (আ.) পরিবারের স্মৃতিকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন। হাজীগণ মাকামে ইব্রাহীমে সালাত আদায় করেন। সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সায়ী করেন। জমজম কূপের পানি পান করেন। মিনায় কোরবানি করেন। আর কেয়ামত পর্যন্ত বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ ইব্রাহিমের স্মৃতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ ও বরণ করেই যাবেন। হাজীগণ ইব্রাহিমের এ স্মৃতিকে বুকে ধারণ ও লালন করবেন। এ স্মৃতি লালন ও পালনের মাধ্যমে তারা লাভ করবেন এক বেহেশতী প্রেরণা। আর তাইতো শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সুন্নাতের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ঈদের দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। সামর্থ্য থাকা সত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করবে না সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে। (ইবনে মাজা: ৩১২৩) কোরবানিদাতাকে কোরবানির পশুর শরীরের পশমপরিমাণ সওয়াব দেয়া হবে।’ (ইবনে মাজা: ৩১২৭)
কোরবানিদাতা কোরবানির সময় নিম্নোক্ত ঘোষণা দিয়েই কোরবানি শুরু করেন, ‘আমার নামাজ, আমার যাবতীয় ইবাদত, অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু কেবল আল্লাহর জন্য।’ (সূরা আন‘আম: ১৬২)। অন্যান্য ধর্ম এবং সংস্কৃতির সাথে ইসলামে কোরবানির এটাই হলো মৌলিক পার্থক্য।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, দা‘ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
dr.knzaman@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন