সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দুই কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক আলম খান ও অভিনয়শিল্পী শর্মিলী আহমেদ ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিউন। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় আলম খান এবং খুব ভোরে শর্মিলী আহমেদ মারা গেছেন। আলম খান এভং শর্মিলী আহমেদ দুজনই ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। এ দুই বরেণ্য ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বাদ আসর দ্বিতীয় জানাজা শেষে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে জুমার নামাজের পর উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টর মসজিদের অভিনেত্রীর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে বাদ আসর আলম খানের প্রথম জানাজা হয় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। এরপর তার কফিন ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত মসজিদুল আউলিয়া হযরত খাজা শাহ মোজাম্মেল হক (র.) প্রাঙ্গণে। সেখানে জান্নাতুল ফেরদৌস কমপ্লেক্সে স্ত্রীর কবরের পাশেই তাকে দাফন করার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে আলম খানকে বলা হয় সুরের জাদুকর। তার সুরে গান গেয়ে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন অনেক শিল্পী। তিনি পপসম্রাট আজম খানের বড় ভাই এবং এ সময়ের জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালক আরমান খানের পিতা। আলম খান ১৯৪৪ সালের ২২ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের বানিয়াগাথি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সংগীতজ্ঞ আলম খানের পুরো নাম খুরশিদ আলম খান। পিতার নাম আফতাব উদ্দিন খান। মায়ের নাম জোবেদা খানম। গুলবানু খানের সাথে দাম্পত্য জীবনে দুই ছেলে আরমান খান ও আদনান খান এবং এক কন্যা আনিকা খানের জনক তিনি।
ওরে নীল দরিয়া, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস, আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, কি জাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা, তুমি যেখানে আমি সেখানে, সবাই তো ভালবাসা চায় এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সুর করেছেন আলম খান।
আলম খানের ছোটবেলা থেকে গানের প্রতি ভালোবাসা ছিলো অন্যরকম। সেই জের ধরেই গানের ভুবনে প্রবেশ। ১৯৭০ সালে আবদুল জব্বার খানের ‘কাঁচ কাটা হীরে’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। তারপর অসংখ্য ছবির সংগীত পরিচালনা করেন। সৃষ্টি করেন একের পর এক শ্রুতিমধুর এবং জনপ্রিয় গান।
আলম খানের সুর ও সংগীত পরিচালনায় সৃষ্ট অসংখ্য গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরও কিছু গান হলো- ভালবেসে গেলাম শুধু, চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা, আমি একদিন তোমায় না দেখিলে, তেল গেলে ফুরাইয়া, আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী, জীবনের গল্প বাকি আছে অল্প, মনে বড় আশা ছিল, সাথীরে যেও না কখনো দূরে, বেলি ফুলের মালা পরে, কাল তো ছিলাম ভাল, চুমকি চলেছে একা পথে, ভালবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া, তুমি কি এখন আমারই কথা ভাবছো, আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটাইরে ইত্যাদি। আলম খান দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ‘বড় ভাল লোক ছিল’ (১৯৮২), ‘তিন কন্যা’ (১৯৮৫), ‘সারেন্ডার’ (১৯৮৭), ‘দিনকাল (১৯৯২) এবং ‘বাঘের থাবা’ (১৯৯৯) ছবিগুলোতে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে ২০০৮ সালে পেয়েছেন ‘কি জাদু করিলা’ ছবির জন্য।
মঞ্চ, টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্রের বরেণ্য অভিনয়শিল্পী শর্মিলী আহমেদ অভিনয় শুরু করেন মাত্র চার বছর বয়স থেকে। শর্মিলী আহমেদের প্রকৃত নাম মাজেদা মল্লিক। ১৯৪৭ সালের ৮ মে তার জন্ম। রাজশাহী বেতারের শিল্পী ছিলেন তিনি। শর্মিলী আহমদের তনিমা নামের এক মেয়ে আছেন। তার ছোট বোন আরেক অভিনেত্রী ওয়াহিদা মল্লিক জলি।
ষাটের দশকে চলচ্চিত্রাঙ্গনে নাম লেখান শর্মিলী। এর মধ্যে অবশ্য প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঠিকানা’ (উর্দু ভাষায় নির্মিত) আলোর মুখ দেখেনি। তবে সুভাষ দত্তের ‘আলিঙ্গন’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ এবং ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্র দিয়ে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। শর্মিলী আহমেদের স্বামী রকিবউদ্দিন আহমেদও ছিলেন পরিচালক। তার নির্মিত ‘পলাতক’ ছবিতে অভিনয় করেছেন শর্মিলী আহমেদ। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে আরও কিছু উর্দু ছবিতেও তিনি অভিনয় করেন। স্বাধীনতার পর ‘রূপালী সৈকতে’, ‘আগুন’, ‘দহন’-এর মতো জনপ্রিয় সব চলচ্চিত্রে ছিল তার সরব উপস্থিতি। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ নাটক ও ১৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয়জীবনে মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের বৈচিত্রপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন এ অভিনেত্রী।
ক্যারিয়ারের শুরুতে শর্মিলী আহমেদ ছিলেন ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী। পরবর্তীকালে ছোট পর্দার মা, দাদি কিংবা ভাবির চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের মনে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন