প্রতিটি বল খেলেছেন মেধা ও গুণ বিবেচনা করে। দিয়েছেন ধৈর্যের চরম পরীক্ষা। এমন এক সময় এসে শফিক এই দৃষ্টান্ত রাখলেন যখন ইংলিশরা টেস্ট ক্রিকেটের চতুর্থ ইনিংসের সংজ্ঞাই বদলে দিচ্ছে। এই মাসেই ভারতের সাথে এজবাস্টনে বেয়ারস্টো ও রুট প্রায় ৮০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করে ৩৭৮ রানের লক্ষ্য ছুঁয়েছে মাত্র ৭৭ ওভারে। তার আগের মাসে ট্রেন্ট ব্রিজে টেস্টের পঞ্চম দিনে নিউজিল্যান্ডের দেওয়া ২৯৯ রান ইংলিশরা সফলভাবে তাড়া করেছিল মাত্র ৫০ ওভারে। সেই ম্যাচে বেয়ারস্টো প্রায় ১৫০ স্ট্রাইকরেট রেখে ১৩৬ রান করেছিল আর কাপ্তান স্টোকস ব্যাটিং করেছিলেন ১০৭ স্ট্রাইকরেটে। ঠিক এমন সময়ে দেখা মিলল ধীর-স্থির, মাটি আকড়ে রেখে টেস্ট খেলা একজন আব্দুল্লাহ শফিকের। যাকে পাকিস্তানের কাপ্তান বাবর আজম ভাবছেন ভবিষ্যতের সেরাদের একজন হিসেবে আর বিশ্ব ক্রিকেটের কিংবদন্তী ওয়াসিম আকরামের মতে গলে খেলা এই ওপেনারের ইনিংসটি পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্যতম সেরা।
শফিকের অনবদ্য ১৬০ রানের অপরাজিত ইনিংসের কল্যাণে গল টেস্টে রেকর্ড ৩৪২ রান তাড়া করে জয়ের বন্দরে পৌঁছেছে পাকিস্তান। সেই ইনিংসে প্রায় ৯ ঘন্টা ব্যাটিং করেছে ২২ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান। স্পিন স্বর্গ উইকেটে প্রায় ৫ সেশন ব্যাটিং করেছেন। টেস্টে বাবর আজমের দলকে চতুর্থ ইনিংসে খেলতে হয়েছিল ৭৬৪ বল যার মাঝে শফিক একাই সামলেছেন ৪০৮ বল। শতাংশের হিসেবে যা প্রায় ৫৩! ৫২৪ মিনিটের মহাকাব্যিক চতুর্থ ইনিংসের সফল রান তাড়ায় সময়ের হিসেবে দীর্ঘতম। ম্যাচের শুরুর এবং শেষর বলটি খেলেছেন এই ব্যাটসম্যান। টেস্টে ক্রিকেটের প্রতি কতটা তাড়না থাকলে এমন ব্যাটিং প্রদর্শন সম্ভব হয় তা প্রথাগত শব্দে প্রকাশ করা কঠিন। মসলিন পৃথীবির সেরা কাপড় কিন্তু কঠিন অধ্যবসায়ের এই শিল্প সাধন যেমন সবার সাধ্যের মধ্যে পড়ে না ঠিক তেমনই গলে স্বাগতিক স্পিনারদের নীল বিষের সামনে এত প্রতিকূলতায় টিকে থেকে, ঘামে-শ্রমে এমন ইনিংস নির্মাণও আজকাল আর দেখা যায় না।
২০০০ সালের আগ থেকেই জাগমহন ডাল মিয়ার ক্রিকেট বিশ্বায়নের মূল মন্ত্রই ছিল বেশি রানের জন্য ব্যাটিং সহায়ক উইকেট। সেই টোপ গেলে সারা ক্রিকেট দুনিয়া। আর তাতেই ধীরে ধীরে কমতে থাকে ধৈর্যশীল টেস্ট ইনিংসের সংখ্যা। গলে শফিকের ৪০৮ বলে অপারাজিত ১৬০ রান চতুর্থ ইনিংসে বল খেলার বিবেচনায় সর্বশেষ ২২ বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রথমটি তারই কাপ্তান বাবরের। গত মার্চে করাচিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৬ রান করেছিলেন ৪২৫ বলে। সেই ইনিংসেও শফিকের ৩০৫ বলে ৯৬ রান করে দলকে ম্যাচ বাঁচানোয় দারুণ ভূমিকা রাখেন। অভিষেকে বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৬৬ বলে ৫২ ও ১২৯ বলে ৭৩ রান করে চিনিয়েছিলেন নিজের জাত।
মাত্র ৬ টেস্ট খেলা শফিক ৮০ গড়ে করেছেন ৭২০ রান। ক্যারিয়ারের এই সময়টায় (৬ টেস্ট) তার উপরে যারা আছেন তাঁদের নামগুলো পড়ুন একবার- ওয়েস্ট ইন্ডিজের জর্জ হ্যাডলি ৭৩০, সর্বকালের সেরা ডন ব্র্যাডম্যান ৮৬২ ও কিংবদন্তী সুনীল গাভাস্কার ৯১২। শফিকের ব্যাটিং নিয়ে বাবর আজম বলেন, ‘সে যেভাবে খেলা তা খুবই নিখুঁত, সে যেভাবে মনযংযোগ ঘরে রাখে তা পরিষ্কার করে দেয় যে এধরনের ইনিংস সামনে আরও আসছে। সে মাত্র ৬টি ম্যাচ খেলেছে তাই তাকে এখনই সেরা বললে তা খুব দ্রুত হয়ে যাবে। তবে আমার আশা ও ধারণা সে সেরাদের একজন হতে পারে।’ ওয়াসিম আকরাম এক টুইটে বলেন, ‘অসাধারণ ইনিংস। আমি বহুদিন পর কোন পাকিস্তানির থেকে এমন ইনিংস দেখলাম। টেস্টে আমার দেখা পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের খেলা অন্যতম সেরা ইনিংসগুলোর একটি এটি।’
স্টিভ ওয়াহ টেস্টে সাড়ে তিন রেটে রান তোলার একটা মানসিকতা স্থাপন করেছিলেন অজিদের মাঝে। পন্টিং সেই ধারা বজায় রেখেছিলেন। অজিদের একচেটিয়া আধিপত্য শেষ হইয়েছে বেশ আগেই। এরপর এবছর থেকেই বেয়ারস্টো-স্টোকস আগ্রাসনটা দেখাচ্ছেন টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে স্পর্ষকাতর স্থান ‘চুতর্থ ইনিংসে’। তাছাড়া পাল্টা আক্রমণকে ইংলিশরা টেস্টে শিল্পের কাছাকাছিই নিয়ে যাচ্ছেন নতুন ভাবে। ঠিক সেরকম সময়েই শফিকের পথচলা শুরু। যেখানে তিনি খেলছেন সময় ও পরিস্থিতি মাথায় রেখে একদম শুদ্ধতম টেস্ট মেজাজে। একজন ব্যাটসম্যানকে তার গোটা ক্যারিয়ারে এমনিতেই মুখোমুখি হতে হয় বহু প্রতিকূলতার। সেই ঝুট-ঝামেল অতিক্রম করে এবং হালের স্টাইল থেকে নিজেকে আলাদা রেখে কিংবা এর সাথেই খাপ খাইয়ে নিয়ে নিজেকে সেরাদের একজনে কাতারে নিয়ে যেতে শফিককে পাড়ি দিতে হবে আরও বহুপথ। তিনি তা কতটুকু করতে পারবেন তা সমইয়ের হাতেই ছেড়ে দেই আমরা। আপতত কেবল উপভোগ করি তার কার্যকরী ও বিশুদ্ধ টেস্ট শৈলি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন