রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

গাছ আমাদের বন্ধু

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক | প্রকাশের সময় : ২৩ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

গাছ আমাদের পরম বন্ধু, মানুষ ও পরিবেশের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। খাদ্য, বস্ত্র, পুষ্টি, বাসস্থান, ওষুধপত্র, অথের্র যোগানদাতা হিসেবে বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষা ও উন্নয়নে বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাণিজগতের অস্তিত্ব উদ্ভিদ জগতের ওপর নিভর্রশীল এবং এ যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তা ছাড়া পৃথিবীকে বাসযোগ্য অবস্থানে গড়ে তোলা বা কোনো দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অবশ্যই ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা জরুরি। কিন্তু আমাদের রয়েছে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন মাত্র ১০ ভাগ বনভূমি এবং ৭ ভাগ গ্রামেগঞ্জে রোপিত বা সৃজিত বনভূমি। যে দেশে বনভূমি যত বেশি সে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের বনভূমি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। বৃক্ষ গ্রিন হাউসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে, প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান দেয়, অক্সিজেন সরবরাহ করে, বাতাসের অতিরিক্ত কাবর্ন ডাইঅক্সাইড শোষণের মাধ্যমে পরিবেশ নিমর্ল রাখে, ক্ষতিকর দূষিত বাতাস শোধন করে জীবজগৎকে রক্ষা করে, সুশীতল ছায়া দেয়, মাটির ক্ষয় রোধ করে, মাটিতে জৈব পদাথর্ যোগ করে মাটির উবর্রতা রক্ষা করে, মাটিতে উপযুক্ত পরিমাণ পানি ধরে রাখে, জ¦ালানি সরবরাহ করে, জীবন রক্ষাকারী মূল্যবান ওষুধের কাঁচামালের যোগান দেয়, পশু-পাখি ও অন্যান্য বণ্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে, প্রাকৃতিক দুযোর্গ ঝড়-ঝঞ্ঝা জলোচ্ছ্বাস বন্যা রোধ করে, বাড়ি তৈরিতে ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় শৌখিন ও মূল্যবান আসবাবপত্র তৈরিতে, লবণাক্ততা রোধ করে, মানুষের আপদকালে বীমাতুল্য কাজ করে, মাটির ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে নিয়ে মাটিকে বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার রাখে, বাতাস পরিষ্কার রাখে, বায়ুম-লের তাপ কমিয়ে আবহাওয়া ঠা-া রাখে, বায়ু দূষণকারী পদার্থ যেমন-কাবর্ন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড শোষণ করে এবং গাছের পাতা ঝড়-বাতাসের গতিকে রোধ করে, বৃষ্টির সৃষ্টি করে ও মরুময়তা রোধ করে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতিকে মায়াময় ও সৌন্দযর্ময় রূপে সাজিয়ে তোলে।

পযার্প্ত পরিমাণ বনভূমি ও বৃক্ষ না থাকার কারণে আমাদের প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক উষ্ণতা দিন দিন কেবল বৃদ্ধি পাচ্ছে, মরুময়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাতাসে কাবর্ন-ডাইঅক্সাইড বৃদ্ধি পাচ্ছে, জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর ক্লোরোফ্লোরো কাবর্ন, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ অনেক অনেক গুণ বেড়ে যাচ্ছে, বায়ুম-লের ওজন স্তরে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে- ফলে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসছে। এসিড বৃষ্টি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেরু অঞ্চল ও এন্টারটিকা মহাদেশের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবতের্নর ফলে আগামী ২ দশকের মধ্যে সারা বিশ্বের ৬০০ মিলিয়ন মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে গবেষক ও বিশ্লেষকদের ধারণা। জলবায়ু পরিবতর্নজনিত কারণে বতর্মানে বাষির্ক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১২৫ মিলিয়ন মাকির্ন ডলার যা ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৪০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে এবং জলবায়ু পরিবতের্ন ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। দৈনন্দিন বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নিবির্চারে বৃক্ষ নিধনের ফলে জীববৈচিত্র্য আজ মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন। পশু-পাখির প্রজনন ব্যাহত হওয়ার ফলে সুন্দর বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ আজ বিলুপ্ত প্রায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে হাজারো প্রজাতির পশু-পাখি ও জলজ প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ৫ হাজার প্রজাতির গাছের মধ্যে ১০৬টির অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত। ৬৩২টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২টি প্রজাতি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত এবং ৩০টি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ১১০টি পশু প্রজাতির ৪০টির কোনো অস্তিত্ব নেই। ৭৮০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৪টির অস্তিত্ব নেই বললে চলে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষি উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ২২ শতাংশ কৃষি জমি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

একটি গাছ ১০টি এয়ারকন্ডিশনারের সমপরিমাণ শীতাতপ আবহাওয়া তৈরি করে, ৭৫০ গ্যালন বৃষ্টির পানি শোষণ করে, বায়ুম-ল থেকে ৬০ পাউন্ডের বেশি ক্ষতিকারক গ্যাস শুষে নেয়। ১ গ্রাম পানি বাষ্পীভবনে ৫৮০ ক্যালরি সৌরশক্তি ব্যয় করে এবং ১টি বড় গাছ দিনে ১০০ গ্যালন পানি বাতাসে ছেড়ে দেয়। ১ হেক্টর সবুজ ভূমি থেকে উদ্ভিদ প্রতিদিন গড়ে ৯০০ কেজি কাবর্ন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে ও সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকালে ৬৫০ কেজি অক্সিজেন দান করে। ১টি মাঝারি আকৃতির আমগাছ ৪০ বছরে ১৪ লাখ টাকা মূল্যের অক্সিজেন তৈরি করে। ৫ হেক্টর পরিমাণ বনভূমি থাকলে ৩-৪ ডিগ্রি পরিমাণ তাপমাত্রা হ্রাস পায় এবং বাতাসের আদ্রর্তা বৃদ্ধি পায়। বৃক্ষ ৮৫-৯০% শব্দ শোষণ করে নিয়ে শব্দ দূষণ রোধ করে। ১ লাখ ইট পোড়াতে গিয়ে ২৫০০ মণ জ¦ালানি কাঠ দরকার হয় এবং রান্নার কাজে আমাদের দেশে প্রতিবছর দরকার হয় প্রায় ১০৭ কোটি মণ জ¦ালানি কাঠ।

সাধারণত বষার্র প্রারম্ভে বৃক্ষচারা রোপণের প্রস্তুতি শুরু হয়। উপযুক্ত সময় হিসেবে জুন থেকে আগস্ট মাস উত্তম। বৃক্ষচারা রোপণের আগে আদর্শ ও মানসম্মত চারা নিবার্চন করতে হবে। সে লক্ষ্যে বিশ্বস্ত সরকারি বা বেসরকারি নাসার্রি হতে চারা ক্রয় করতে হবে। বৃক্ষের চারা রোপণের ক্ষেত্রে স্থান নিবার্চন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক স্থান বুঝে সঠিক জাতের বৃক্ষচারা রোপণে প্রকৃতি পরিবেশ সৃজন, ফলন ও বৃক্ষরোপণের প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে অন্যথায় কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করি বাড়ির উত্তর-পশ্চিমে উঁচু বড় জাতের বৃক্ষ। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ছোট মাঝারি আকারের বৃক্ষ লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে-পেয়ারা, ডালিম, কুল, সফেদা, নারিকেল, সুপারি ও উন্নত জাতের কলমচারা, নিম, শরিফা, আতা, সবরিকলা, আনাজিকলা, বাতাবিলেবু, বকফুল, তেজপাতা, দারুচিনি, কামরাঙ্গা, কদবেল, গোলাপজাম, লটকন প্রভৃতি জাতের বৃক্ষচারা লাগানো যেতে পারে। বসতবাড়ির কিনারায় লেবু, আমড়া, সজিনা, নারিকেল, সুপারি প্রভৃতি গাছ লাগানো ভালো। পুকুর পাড়ে নারিকেল, সুপারি, তাল, খেজুর, কাঁঠাল, জাম, সজিনা, কলা, অজুর্ন, নিমগাছ লাগাতে পারেন। ফসলের ক্ষেতের আইলে সজিনা, খেজুর, আমলকী, নিম প্রভৃতি গাছ রোপণ করা যায়। রাস্তা, রেললাইন, বাঁধ ইত্যাদি স্থানের জন্য নিম, জাম, কাঁঠাল, শিশু, একাশিয়া, অজুর্ন, বকুল, ছাতিম, মেহগনি, জারুল, নারিকেল, কৃষ্ণচূড়া, বাবলা প্রভৃতি গাছ ব্যবহার করা যায়। অফিস প্রাঙ্গণের জন্য নারিকেল, সুপারি, সফেদা, নিম, বকুল, জামরুল, আমলকী, অজুর্ন, হরীতকী, বহেরা, লেবু, আম, জাম, কাঁঠাল প্রভৃতি গাছ ব্যবহার করা যায়।

জলবায়ু পরিবতর্নজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা ও ক্রমবধর্মান জনসংখ্যার চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমাদের দেশে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই এবং তার-ই ধারাবাহিকতায় সরকারি পযার্য় থেকে বেসরকারি পযার্য়ের বিভিন্ন সংগঠন বৃক্ষরোপণে উৎসাহ প্রদানসহ জাতীয়পযাের্য় বিভিন্ন কমর্সূচি পালন করছেন। তাই আসুন বেশি করে বৃক্ষ চারা রোপণ করি এবং আমরা আমাদের বাসযোগ্য আগামী বিশ্ব গড়ে তুলি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন