বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিদ্যুতে ক্যাপাসিটি চার্জ রহিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৫ জুলাই, ২০২২, ১২:০৪ এএম

দেশে বিদ্যুতের সংকট প্রকট। সংকট মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার যতটা সম্ভব কম করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। শহরে-গ্রামে সর্বত্র নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। জ্বালানি সংকটের জন্য বিদ্যুতের এ সংকট দেখা দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহ ব্যহত হওয়ায় তেল-গ্যাসের দামও আকাশ ছুঁয়েছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের সবদেশেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সেক্টর মূলত গ্যাস ও তেলের ওপর নির্ভর। তেল শতভাগ এবং গ্যাস আংশিক আমদানি করতে হয়। একারণেই বিদ্যুতের ওপর চাপটা বেশি পড়েছে। সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিতে চাইছে তা ইতিবাচক। বিদ্যুৎ এমন একটি অপরিহার্য উপকরণ, যা ছাড়া এখন কোনো কিছুই চলে না। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, দৈনন্দিন জীবনযাপন সব কিছুই বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। এ মুহূর্ূূতে তাই কর্তব্য হলো, পরিস্থিতি সামাল দিয়ে চলা এবং দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। অবশ্য বিদ্যুৎ সংকটের এটা প্রধান কারণ হলেও একমাত্র নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে যে অসামঞ্জস্য বিদ্যমান, সেটাও একটি বড় কারণ। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। আর সরবরাহের সক্ষমতা ১২ হাজার মেগাওয়াটের মতো। সঞ্চালন লাইনের অভাব এর জন্য দায়ী। এ কারণে সক্ষমতার একটা বড় অংশ কোনো কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। তা অকার্যকর রাখতে হচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের দুর্বল ও অবাস্তব পরিকল্পনার দায় রয়েছে এখানে।

সবচেয়ে দুঃখ ও উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগানোর অপরগতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন বন্ধ। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে, লোকবল বসে থাকছে। ওদিকে সরকার রেন্টাল, কুইক রেন্টালসহ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য যে চুক্তি করেছে, তাতে সরকারের বেশুমার ক্ষতি হচ্ছে। চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার বিধান রয়েছে। যে বিধানের বিশেষ দিক হলো, কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হোক বা না হোক, বাধ্যতামূলকভাবে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। আর এই চার্জ চুক্তির মেয়াদকাল পর্যন্ত দিয়ে যেতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক-বান্ধব এই বিধান বা শর্ত সম্পর্কে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠলেও এ সম্পর্কে সরকারের কোনো বিকার নেই। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে খুব কম বিদ্যুৎই কেনা হচ্ছে। অধিকাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্রই বন্ধ। বন্ধ থাকলেও অর্থাৎ এক মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন বা সরবরাহ না করেও তারা সরকারের কাছ থেকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনে নিচ্ছে। এক খবরে জানা গেছে, গত ৯ মাসে সরকার বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ১৬,৭৮৫ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিশোধ করেছে। অন্য এক খবর মোতাবেক, ইতোপূর্বে সরকার এ বাবদ ৭০,০০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এই বিপুল অংকের টাকা অপচয় ও লুটপাট হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্য। সরকার এই অপচয় ও লুটপাটের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিকদের বেশিরভাগই সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অথবা সমর্থক। তাদের সুবিধা দেয়া বা খুশি রাখার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার একপেশে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অন্য এক খবরে জানা গেছে, ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তাতেও ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার শর্ত রাখা হয়েছে। এও জানা গেছে, নতুন আরো তিনটি কোম্পানির সঙ্গে অনুরূপ চুক্তি করা হচ্ছে। এছাড়া কয়েকটি রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ না কিনে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যে ক্যাপাসিটি চার্জ গোনা হচ্ছে, তা জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা। এভাবে জনগণের টাকা পানিতে ফেলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

খাদ্য নিরাপত্তার মতই গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি নিরাপত্তা। তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরাপত্তা ব্যহত বা ক্ষুণ্ন হলে কী দশা হয়। শ্রীলংকার দিকে তাকালেই তা উপলব্ধি করা যায়। জ্বালানি তেলের সংকট থেকেই শ্রীলংকার সংকট শুরু। তারপর তার লাগাতার বিস্তৃতি ঘটেছে। আরো অনেক দেশে জ্বালানি তেল ও আনুষঙ্গিক সংকট বাড়ছে। বাড়ছে গণক্ষোভ ও অসন্তোষ। জ্বালানি তেল উৎপাদন, পরিবহন ইত্যাদির জন্য অতীব প্রয়োজন। একথা অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেল-গ্যাসের ব্যবহার বেশি। গ্যাস দেশের নিজস্ব সম্পদ হলেও তার অভাব রয়েছে। এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তেল। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলের ব্যবহার কমিয়ে গ্যাস ও অন্যান্য উপকরণের ব্যবহার বাড়ানো উচিত। গ্যাসের অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি, চুরি-অপচয় এবং শ্বেতহস্তী লালন-পালনের খেসারত দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে এবং নিরূপায় গ্রাহক দাম দিতে বাধ্য হচ্ছে। দাম বাড়ানোর সময় একই কথা বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতে লোকসান কমাতে দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। ইনকিলাবের খবর থেকে জানা যায়, ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে পিডিবির লোকসান হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ বাহুল্য, যতদিন বিদ্যুতের চুরি-অপচয় বন্ধ না হবে, যতদিন ক্যাপাসিটি চার্জের নামে অর্থ বিতরণ রহিত না হবে ততদিন বিদ্যুতের লোকসানও বন্ধ হবে না এবং গ্রাহক সাধারণের দুর্ভোগ ও বাড়তি অর্থব্যয় কমবে না। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, বিদ্যুৎ খাতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ইতোমধ্যে প্রায় দু’লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে। এই বিশাল ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হবে ২০২৪ সাল থেকে। তখন এই খাতের অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেটাই প্রশ্ন। সরকার, সরকারের নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। যে কোনো মূল্যে ও ব্যবস্থায় জ্বালানি নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন