বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বাড়ছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী

সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কিশোর বয়সেই পঙ্গু হচ্ছে অনেকে। দুর্ঘটনার অধিকাংশ রোগীই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্ত, এটি কখনো গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না

একলাছ হক | প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

ভয়ঙ্কর এক যানবাহনে পরিণত হয়েছে মোটরসাইকেল। রাজধানীসহ সারাদেশে সব এলাকাতেই মোটরসাইকেল এখন এক অতঙ্কের নাম। কিশোর-যুবকদের হাতে এটি এখন এক মরণ অস্ত্র হিসেবে দেখা যাচ্ছে। অপ্রাপ্ত বয়সে মোটরসাইকেল চালানো, বেপরোয়া গতি, নানা বিকৃত অঙ্গ-ভঙ্গিতে মোটরসাইকেল চালানোর কারণে সড়কেই ঝরে পড়ছে তাজা প্রাণ। এতে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও খালি হচ্ছে মায়ের বুক।

কিশোর-যুবকরা এ বয়সে মোটরসাইকেল কিনে দেয়ার জন্য পরিবারের অভিভাবকদের চাপ সৃষ্টি করেন। কিনে না দিলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। অনেকক্ষেত্রে অত্মহত্যার মতো কথা বলে পরিবারের অভিভাবকদের ভয় দেখিয়ে মোটরসাইকেল কিনে তারা। এছাড়াও অনেক পরিবারে প্রবাসী কেউ থাকলে তার নিকট থেকে টাকা নিয়ে মোটরসাইকেল ক্রয় করেন কিশোর-যুবকরা। মোটরসাইকেল কেনার পর শুরু হয় তাদের বেপরোয়া চলাচল। দ্রুত গতিতে চলাচল করার কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয় অনেক পথচারী। আর দুর্ঘটনায় ট্রাক, বাস, কাভার্টভ্যান ও বড় কোন যানবাহনের ধাক্কায় প্রাণ হারাতে হয় মোটরসাইকেল চালক ও সাথে থাকা আরোহীকেও। আশঙ্কাজনকহারে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর সংখ্যা। এ তথ্য জানিয়েছেন স্পাইন এন্ড অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) প্রতিদিনই গড়ে ১ হাজারের বেশি রোগী আসছেন। এদের অধিকাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার শিকার রোগীরা বেশিরভাগই কিশোর বয়সের। কিশোর বয়সেই অনেকের পা কেটে ফেলতে হয়েছে। অনেকে স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ববরণ করছেন। ঈদ ও ঈদ-পরবর্তী সময়ে মোটরসাইকেল নিয়ে দলবেধে ঘুরতে গিয়েও অনেকে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অকালেই ঝরে পড়ছে তাজা প্রাণ। এতে করে নিহতের পাশাপাশি গুরুতর আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেকে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মোটরসাইকেলের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আহতের বেশিরভাগই কিশোর যাদের বয়স ২০ বছরের কম। এছাড়া রাজধানীর বাইরে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অধিকাংশ মোটরসাইকেল চালকের নিবন্ধন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অনেকে রাজনৈতিক পরিচয়ে অথবা প্রভাবশালী পরিচয়ে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ান।

দিন দিন বেশি সিসির মোটরসাইকেল আমদানি হচ্ছে দেশে। বিভিন্ন ডিজাইন ও গতির উপর নির্ভর করেই নতুন নতুন মোটরসাইকেল কিনছেন তরুন প্রজন্ম। আর এসব বেশি সিসির মোটরসাইকেল অনুমোদন দেয়া সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার জন্য বিষফোঁড়া হিসেবেই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় মোটরসাইকেল চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ চায় সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়ন সংক্রান্ত কমিটির ১১১ দফা সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য গঠিত টাস্কফোর্স। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভা শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানানো হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। যৌক্তিক কারণ ছাড়া গত ঈদুল আজহার আগে তিন দিন, ঈদের দিন এবং ঈদের পরের তিন দিন- এই সাত দিন এক জেলা থেকে আরেক জেলায় মোটরবাইক চলাচল বন্ধ ছিল। পদ্মা সেতুতেও বন্ধ আছে মোটরসাইকেল চলাচল।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো মোটরসাইকেল চালানোর জন্য উপযোগী নয়। তবে মহাসড়কে আলাদা মোটরসাইকেলের জন্য লেন করা, গতি নির্দিষ্ট করার উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি। আমরা লক্ষ করছি পঙ্গু হাসপাতালে প্রতিদিন ২০০ মতো এবং ঢাকার বাইরে হাসপাতালগুলোতে যেসব দুর্ঘটনার রোগী ভর্তি হয় তার অধিকাংশই মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনায় অক্রান্ত। গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন না হওয়ায়, ভোগান্তি ও যানজট থেকে বাঁচতে মানুষ বিকল্প হিসেবে এসব ছোট পরিবহনের ব্যবহার অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে। মোটরসাইকেল কখনো গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে দেশে বর্তমানে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা ক্যান্সারের মতো বেড়েছে।

জানা গেছে, ইতোমধ্যে ৩৬ লাখের বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধনের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এর বিপরীতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া চালকের সংখ্যা ২৩ লাখ ৫০ হাজারের মতো। বাকী চালকেরই নেই মোটরসাইকেল চালানোর অনুমোদন। কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। মোটরসাইকেল উৎপাদন ও আমদানির ক্ষেত্রে সরকার নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, ফলে দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপকহারে বাড়ছে। এটা সরকারের আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। সরকারের উচিত গণপরিবহন উন্নত, সহজ ও সাশ্রয়ী করে এবং রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণ করে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা। গণপরিবহনে উৎসাহিতসহ নানা পদক্ষেপের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিআরটিএ’র মতে, গঠনগতভাবে মোটরসাইকেল অপেক্ষাকৃত একটি অনিরাপদ বাহন। এটি সাধারণত যুবক বা উঠতি বয়সীরা বেশি ব্যবহার করেন। তাদের মধ্যে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর প্রবণতা খুব বেশি। সম্প্রতি দেশের সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
এবারের ঈদযাত্রায় গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ঈদুল আজহায় যাতায়াতে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে ৭৭৪ জন। বিগত ঈদুল আজহার তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ২৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং নিহত বেড়েছে ৩১ দশমিক ৪১ শতাংশ। যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১১৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৩১ জন নিহত ও ৬৮ জন আহত হয়েছে, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫ দশমিক ৪২ শতাংশ, নিহতের ৩২ দশমিক ৯১ শতাংশ।

এক জেলা থেকে আরেক জেলায় মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ১৫৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয় ১২৩ জন, যা ঈদযাত্রায় মোট নিহতের ৩৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বিগত চার ঈদুল আজহার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার রেকর্ড ভেঙেছে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ঈদুল আজহার আগে-পরে ১২ দিনে (৫ জুলাই-১৬ জুলাই) দেশে ২৭৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১১ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ১ হাজার ১৯৭ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৪৩ ও শিশু ৫৮। ১৫৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয় ১২৩ জন, যা ঈদযাত্রায় মোট নিহতের ৩৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সড়কে মোটরসাইকেলের মুভমেন্ট পাস নামক উদ্ভট সিদ্ধান্তও ছিল এবার। এই সময়ে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালানোর পাশাপাশি নিয়ম না মানা এবং হেলমেট ব্যবহারে অনীহার কারণে ৪১৮টি দুর্ঘটনায় ৫৫ জন নিহত এবং ৩৬৮ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই বাইক লেন না থাকার কারণে প্রাইভেটকার, ট্রাক, বাস-মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন বাহনের পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার কারণে ঘটেছে।
সেভ দ্য রোড’র মহাসচিব শান্তা ফারজানা ইনকিলাবকে বলেন, যদিও ঈদযাত্রায় এক জেলা থেকে অন্য জেলায় মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ থাকার কথা বলা হয় তবুও দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোটরসাইকেল চলাচল করেছে। ৩৮ লাখের মতো মোটরসাইকেল চলাচল করে। সড়কের বেহাল দশা ও বিপজ্জনক গণপরিবহনের কারণেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে সরকারে মনিটরিং বাড়ানো প্রয়োজন। উন্নত দেশের মতো আলাদা সড়কে মোটরসাইকেলের জন্য বাইক লেন করা দরকার।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জীবনে এখন নিত্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
বেসিক টেকনিকস অব থোরাকো-লাম্বার স্পাইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. শাহ আলম বলেন, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী বাড়ছে সেটা আশঙ্কাজনক। এক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও সেবা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। নাহলে এতো সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গণি মোল্লাহ বলেন, রোগী যতই আসুক, কষ্ট সত্ত্বেও আমাদেরকে তো ম্যানেজ করতেই হবে। কারণ দুর্ঘটনায় হাত-পা ভাঙা এসব রোগীদের তো আর আমরা ফেরত দিতে পারব না। ঈদ একটি খুশির সময়। এই সময়ে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঈদের সময় যে পরিমাণ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে তা গত কয়েক বছরে হয়নি। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও সেবা দিচ্ছেন।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, উন্নত দেশে মোটরসাইকেল চালানোর সময় বিশেষ পোশাক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই রীতি নেই। প্রতিবছর পাঁচ লাখ মোটরসাইকেল বিপণন করে কোম্পানিগুলোর পাঁচ হাজার কোটি টাকা আয় হলেও দুর্ঘটনায় ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বেশি সিসির মোটরসাইকেল অনুমোদন দেয়ায় বিআরটিএর সমালোচনা করে তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে। জরুরি ভিত্তিতে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা উচিত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ২৮ জুলাই, ২০২২, ১০:৩৯ পিএম says : 0
These young people>> where they get money >>> they are the golden child of ruler. These boys are all gunda and chabaz.
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন