“স্বপন দেখি তারা কার আশে....
ফেরে আমার ভাঙা খাঁচার চার পাশে....!”
এই সুন্দর একতলা বাংলো টাইপের বাড়ির চারিদিকেই সুন্দর সব মরসুমী গাছ লাগানো বড় বড় শিমুল পলাশ গাছগুলো যেন রাঙিয়ে দিয়েছে পরিবেশকে। এই অঞ্চলটা একটু নিরিবিলি পাড়ার লোকজন প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষিত ‘একসে বড়কা এক সব সরকারি বেসরকারি সংস্থার উচ্চ পদের লোকদের বসবাস অনেকটা ক্লাব টাউনের মত পরিবেশ যে সংস্থা এই বাংলো টাইপ বাড়িগুলি করেছে তাদের আর্কিটেক্ট সংস্থার প্রচুর নাম দেশ বিদেশে।গ্রীষ্মের এই মনোরম পরন্ত বিকেলে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে হাল্কাভাবে শরীরকে দুলিয়ে আনমনে কি যেন ভাবছে সৌম্য সুন্দর সুঠাম লোকটি।এখন বাড়িতে দুজন সেই হরি কাকা আর একটি নতুন অতিথি।অনিমেষ ভাবে...!
গ্রীষ্মের এই তপ্ত উদাস বৈকালে,/ একলা পন্থ হেঁটে যায় ঐ দুরে।/একদল পাখি দিগন্তে যায় উড়ে,/মা তোমার কথাই যে মনে পরে বারে বারে।।
কি ভাবছে অনিমেষ রায়। তার ছোটবেলার কথা না বর্তমানকালের।ওর সম্বন্ধে কি আর বলি। ও আর অজিত মানে অজিতেশ দুই ভাই আর তাদের একমাত্র বোন রিতা। অনিমেষ অতন্ত মেধাবী ও শান্ত ভদ্র ছেলে হিসেবে পাড়ায় পরিচিত। রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র জীবনে অনিমেষ পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়ে এসেছে অন্য কোন রেজাল্ট হয়নি কখনো। কি পাড়ায় কি স্কুলের ডিবেট বা অঙ্কন প্রতিযোগিতা প্রতি প্রতিযোগিতায় সবেতেই প্রাইজ হাতে অনিমেষ দাঁড়িয়ে থাকত । শান্তি দেবীর মুখে আনন্দের হাসি লেগেই থাকতো।
কি ভালো মান মোর ভোরে দিল প্রাণ। যুগে যুগে বাবা ধরে রাখিস এই সন্মান।। /শান্তির চোখ আনন্দে চিক চিক করত।
পবিত্র রায় সরকারি কেরানি,ছোট থেকেই বাবার মুদির দোকান সামলিয়ে পরাশুনা করেছেন। এখন বি.এল.আর.ও দপ্তরে কাজ করেন।ছোট ভাই মা বাবা এই ছিল তার বিবাহ পূর্ব জীবন।ছোট ভাই খেলতে গিয়ে এমন চোট পায় যে একটি পা প্রায় অকেজো,পড়াশুনা আর করতে পারেনি বাবার দোকান দেখে। এতসবের মধ্যেও অনিচ্ছা সত্যেও শান্তি দেবীর সাথে বিবাহ হয়। কিন্তু সুখের মধ্যেও পরিবারের রোগ ব্যাধিতে পবিত্র রায় কাহিল হয়ে পরেছে।বাড়ির কাজে অফিসের পি এফ লোন এখন চলছে।ছেলে মেয়েদের টিউশন আর এক বোঝা। রুগ্ন শীর্ণ পবিত্র বাবু দিন দিন ঋণের জালে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন আর দশ বারো বছরের চাকরীতে এই ঋণ হয়তো শোধ কড়া যাবে না এটা প্রতি দিনের চিন্তা ছিল তবুও শান্ত ভদ্র ব্যবহারের জন্য তাকে অফিসে সবাই বড়বাবু বলেই মানাতো।
মেধাবী অনিমেষ মাধ্যমিক,উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় একের পর এক স্টার নিয়ে পাস করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে। বাবা ও মায়ের ইচ্ছে অনিমেষ বড় হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হোক।
তখন কত আর হবে অনিমেষের বয়স কুড়ি কি একুশ হঠাৎ এক ভোরে সূর্য তখনো ওঠেনি অনিমেষরা সবাই ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন বাবা পবিত্র চিৎকার করছে বাবা উঠে দেখ তোদের মা নেই।সবাই হতবাক মা কোথায় গেলেন!! না না তোদের মা শান্তি চির শান্তিতে চলে গেছে রে হায় হায় একি হল ভগবান! হাপুস নয়নে ছেলে মেয়েদের জাপটে ধরে কেঁদেই চলেছে। মাতৃহারা অনিমেষ দিশাহারা ছোট ছোট ভাই বোন আর বাবার অবস্থা দেখে পাগোল হবার অবস্থা তার উপর পড়াশুনার প্রচুর চাপ বাড়ির ছোট ঘরে নিজে যে টিউশন চালায় তার চাপ মাথা ঠান্ডা রেখে চালাচ্ছে।ভাই বোনের আবদার মা দেখতেন বাবার উপর আর বায়না চলে না ‘ওদের’ দাদাই এখন ‘মা’ যত সময় যায় দাদার মমতায় আর দু:খ বোঝাই যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ছোট বোনের গাল টিপে মাথায় হাত বুলিয়ে অনিমেষ দু কলি গেয়ে উঠে “তুই আমার ছোট বোন আদরের ছোট বোন।” এম এস সি পাশ করে আজ অনিমেষ ডাবলিউ বি সি এস অফিসার।পবিত্রর কর্মজীবন শেষ হবার আগেই নানান লোনে জর্জরিত যতটুকু পিএফ আর গ্র্যাচুয়িটির টাকা পাওয়া গেছে তা ধার শুধতেই শেষ।
আজ পবিত্রর কর্মজীবনের শেষ দিন ছিল।প্রচুর সম্বর্ধনা সাথে মিষ্টির প্যাকেট আর একটি চেক নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। বাবার যাতে কোন কষ্ট না হয় অনিমেষ একটি গাড়ী জোগার করেছিল ছোট ভাইকে আগেই বলেছিল বাবার সাথে আজ যেন সবসময় থাকতে আর বাবাকে অফিসের যাবার আগে প্রনাম করে বলে ‘ বাবা তুমি একদম চিন্তা করবে না আমিতো আছি’ দেখ সব ঠিক হবে আর কটা মাস যাক দেখবে সব দেনা শোধ করে দেব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন