শিরক অর্থ হচ্ছে- অংশীদার, ভিন্ন ভিন্ন ইলাহিতে বিশ্বাস হওয়া, মিশ্রণ, সংমিশ্রণ, একটি বস্তুর মালিকানায় দু’জনার অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা, আল্লামা রাবেগ ইস্পাহানী (র.) তাঁর ‘মুফরাদাত’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, শিরকের অর্থ- দু’সত্বাধিকারের সংমিশ্রণ, সমকক্ষ স্থীর করা ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়- কোনো জিনিসকে আল্লাহর সত্তা, গুন অথবা কোনো কর্মের সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করাকে শিরক বলা হয়। পরিভাষায় অন্যভাবে বলা যায়- আল্লাহ তায়ালার সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করাকে শিরক বলা হয়।
আর মুশরিক অর্থ- যে আল্লাহর ক্ষমতায় অন্য কারো অংশীদারিত্ব সাব্যস্ত করল। শিরকের প্রকারভেদঃ- শিরক প্রধানত দুই প্রকার- ১) শিরকে আকবর ২) শিরকে আসগর। ১। শিরকে আকবর: আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরিক সাব্যস্ত করা, এ শিরককে শিরকে আকবর বলা হয়। ২। শিরকে আসগর: ইবাদতের মধ্যে কেবল মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য শামিল রাখা। অথবা কোনো বিষয়ে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুকে প্রভাবকে জ্ঞান করা। প্রত্যেক প্রভাবের ধারণা রাখা। শিরকে আকবর চার ভাগে বিভক্ত : ১। সত্তাগত অংশীদারিত্ব। আল্লাহর সত্তা মত কাউকে বা কোন শক্তিকে মনে করা। ২। গুনাবলিতে শিরক। আল্লাহ তা’য়ালার গুনাবলির মতো অন্য কারো গুনাবলি আছে এ আকিদা পোষণ করা। ৩। আইনগত অধিকারে কাউকে শরিক করা। সৃষ্টি জগতের পরিচালনায় আইন প্রণয়ণের অধিকারে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা। ৪। ইবাদতের মধ্যে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (স) নাফরমানী করে কোনো মাখলুকের আনুগত্য করা।
শিরকে আকবর: আল্লাহর একত্ব বা তাওহীদের পর্যায় তিনটি। প্রতিপালনের শিরক: আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সৃষ্টি বা প্রতিপালনের বিষয়ে আল্লাহর সাথে শরিক করা। যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো মধ্যে সৃষ্টি, সংসার, প্রতিপালন, রিজিক দান, জীবন দান, মৃত্যু দান, বিশ্ব পরিচালনা, মঙ্গল অমঙ্গল ইত্যাদি ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা। নাম ও গুনাবলির শিরক: মহান আল্লাহর পূর্ণতার গুনাবলি ও মহা সম্মানিত পবিত্র নাম সমূহ রয়েছে। এসকল গুন বা নামের ক্ষেত্রে কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহর সমকক্ষ বা আল্লাহর সাথে শরিক করা এ পর্যায়ের শিরক।
ইবাদতের শিরক: ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বলে বিশ্বাস করা বা আল্লাহ ছাড়া কাহারো ইবাদত করাকে আবাদতের শিরক বলা হয়। শিরকে আসগর: এ শ্রেণির শিরক অধিকাংশ সময় ইবাদত ও মুআমালা -এর ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়। তবে এতে কোন সময় বড় শিরকও পাওয়া যায়। এ শ্রেণির শিরক মহা পাপ হলেও এটা প্রথম প্রকার শিরকের তুলনায় হালকা। শিরকে আসগর এর প্রকারসমূহ : শিরকে আসগরকে নিম্মোক্ত প্রকারসমূহে সীমাবদ্ধ করা যায়- ১. কথাগত শিরক : যা মুখের দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন- ক.‘আল্লাহ এবং আপনি যা চান’। হযরত কুতাইলা (রা) হতে বর্ণিত। রাসুল (স) ইরশাদ করেন, মুসলিমদের মধ্যে যারা শপথ করতে চায়, তারা যেন বলে ‘কা’বা ঘরের রবের শপথ’। আর যেন বলে- আল্লাহ যা চান, এরপর আপনি যা চান। (নাসাঈ)। খ. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর নামে শপথ করা। রাসুল (স) ইরশাদ করেছেন- যে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করালো সে শিরক করলো।
২. কার্যগত শিরক : এমন শিরক যা কর্মের দ¦ারা সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন- রিয়া অর্থাৎ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত বন্দেগী করা। রাসুল (স) বলেছেন- আমি তোমাদের উপর শিরকে আসগর বা ছোট শিরকের ব্যাপারে অত্যন্ত ভয় করছি। প্রশ্ন করা হলো তা কি? তিনি বললেন, তা রিয়া বা লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করা। (সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহিব, হাদীস ৩২)। শিরকে খফির আলোচনা : ড. ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মদ আল বুরাইকান তার ‘আল-মাদখাল’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন- ‘গোপন শিরক হচ্ছে হৃদয়ের এমন ইচ্ছা বা মুখের কথা যাতে আল্লাহর সাথে গায়রুল্লাহ সমান হয়ে যায়। রাসুল (স) বলেন- শিরক কঠিন কালো পাথরের উপর কালো পিঁপড়ার গুটি গুটি পায়ে চলার চেয়েও সুক্ষ্ম ও গোপন। (যয়িফ আত-তারগীব ওয়াত তারহিব, ২য় খণ্ড ২৬৯ পৃষ্টা, হাদীস ১৭৮৭)। রাসুল (স) অন্যত্র ইরশাদ করেন- হে লোক সকল! তোমরা নিজেদেরকে গোপন শিরক থেকে রক্ষা কর। তাঁরা (সাহাবায়ে কেরাম রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (স)! গোপন শিরক কি? তিনি বললেন, কোনো ব্যক্তি সালাত আদায় করার জন্য দাঁড়াল। অতপর পরিশ্রম করে সুন্দর করে নামাজ আদায় করলো। কেননা সে দেখছে মানুষ তার প্রতি লক্ষ্য করছে। এটাই গোপন শিরক। (সহিহ ইবনে খুজাইমা, ২য় খণ্ড ৬৭ পৃষ্টা, হাদীস ৯৩৭)।
নিম্নে সমাজে প্রচলিত শিরকি কথা বা কাজ উল্লখ করা হলো- ১. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তিকে ইলাহ বলে স্বীকার করা বা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ইবাদতের যোগ্য মনে করে গ্রহণ করা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- তোমরা দুই ইলাহ গ্রহণ করোনা; তিনিই একমাত্র ইলাহ। সুতরাং তোমরা আমাকেই ভয় করো। (সূরা নাহল, আয়াত ৫১)। অপর আয়াতে বলা হয়েছে-আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। অতএব আমারই ইবাদাত করুন। (সূরা ত্বহা, আয়াত ১৪)।
এভাবে পবিত্র কুরআনে বহু জায়গায় কোনো ব্যক্তিকে ইলাহ বলে স্বীকার করা বা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ইবাদতের যোগ্য মনে করে গ্রহণ করা নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। কেননা, উপরোক্ত দু‘টি আয়াত দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় মহান আল্লাহ আমাদের একমাত্র ইলাহ এবং ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। তাঁর সাথে অন্য কাউকে অংশীদারিত্ব করাই শিরক।
২. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো/কিছুর নামে শপথ করা। হযরত সাঈদ ইবনে আবূ উবাইদাহ (রহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) এক ব্যক্তিকে এভাবে শপথ করতে শুনলেন, ‘না! এ কাবার শপথ।’ তখন ইবনে উমার (রা) তাঁকে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে শপথ করলো, সে শিরক করলো। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩২৫১)।
৩. বেদ ফাল (শুভাশুভ বা ভবিষ্যৎ কথন ও কুলক্ষণ-সুলক্ষণ) গ্রহণ করা। হাদীসে এসেছে- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, কোনো বস্তুকে কুলক্ষণ মনে করা ‘শিরক’, কোনো বস্তুকে কুলক্ষণ ভাবা শিরক। এ কথা তিনি তিনবার বললেন। আমাদের কারো মনে কিছু জাগা স্বাভাবিক, কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা করলে তিনি তা দূর করে দেবেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৯১০)। সুনানে ইবনে মাজাহ-এ একই রাবীর বর্ণনায় প্রায় একই শব্দে আরেকটি হাদীস আমরা লক্ষ্য করতে পারি। হযরত আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, অশুভ লক্ষণ (বিশ্বাস করা) শিরকী কাজ। রাবী বলেন, আমাদের মধ্যে অশুভ লক্ষণের ধারণা আসে। তবে আল্লাহর উপর ভরসার দ্বারা তা দূরীভুত হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ৩৫৩৮)।
৪. যাদু-মন্ত্র করা। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি গিরা দিয়ে তাতে ফুঁক দেয় (যাদু মন্ত্র পড়ে ফুঁক উদ্দেশ্য), সে যাদু করলো। আর যে যাদু করলো; সে মুশরিক (যে শিরক করে তাকে মুশরিক বলে) হলো। আর যে ব্যক্তি গলায় কিছু (তামীমা- জড় পদার্থ বা কোরআন হাদীস বহির্ভূত শব্দ) ঝুলায়, তাকে সেই জিনিসের উপর ন্যস্ত করা হয়। (সুনান নাসাঈ, হাদিস ৪০৭৯)।
৫. ইবাদতের উদ্দেশ্যে কােনো ব্যক্তি বা বস্তুর নামের জিকির (স্মরণ বা ডাকা) করা। তুমি আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডেকো না। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংসশীল। বিধান তাঁরই এবং তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। (সূরা কাসাস, আয়াত ৮৮)। অন্যত্র ইরশাদ করেন- এই যে মসজিদসমূহ আল্লাহরই জন্য। সুতরাং আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে ডেকো না। (সূরা জিন, আয়াত ১৮)।
জেনে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের স্রষ্টা মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা। সুতরাং ইবাদত, জিকির (স্মরণ, ডাকা, আহ্বান করা, মোনাজাত) তাঁরই কাছে করতে হবে। আর যমিন মানুষের জন্য আল্লাহর স্মরণে উন্মুক্ত। কিন্তু তা উপেক্ষা করে জ্ঞানের অপরিপক্কতার কারণে বরকতময় মনে করে কিছুকিছু স্থানকে এবং তার নির্মাতার নামে জিকির করা হয়ে থাকে। যা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখিত দু‘টি আয়াতে সে দু‘টি বিষয়ে পাঠকদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
৬. আপদবিপদ বালামুসিবত দূরীভূত করার জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা। আল্লাহ ছাড়া এমন কাউকে ডেকো না, যে তোমার উপকার করতে পারবেনা এবং ক্ষতিও করতে পারবে না। তুমি যদি এমন করো, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি জালিমদের (মুশরিকদের) অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা ইউনুস, আয়াত ১০৬)।
৭. হায়াত, রিজিকের জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ডাকা। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করছো, তারা তোমাদের রিযিকের মালিক নয়। কাজেই আল্লাহর কাছে রিযিক তালাশ কর, তাঁর ইবাদত করো এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। (সূরা আনকাবুত, আয়াত ১৭)। সকল সৃষ্টির স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা। কেমন বিবেকহীন হলে হায়াত কামনা করতে পারে আরেকজনের কাছে? কেননা, জীব জড় যা-ই হোক সব ধ্বংসশীল। কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত ডাকলেও তারা আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিতে পারবে না। তাই কারো কাছে হায়াত চেয়ে নিচক জ্ঞানের পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি মুশরিক হওয়া থেকে বিরত থাকা চাই। কোরআনের ভাষায়- তার চেয়ে অধিক ভ্রান্ত আর কে হতে পারে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ছাড়া এমন সত্তাকে ডাকে যে সত্তা কেয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিতে পারবে না? (সূরা আহক্বাফ, আয়াত ৫)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন