নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে বিদেশি ঋণ। হুহু করে বাড়ছে ডলারের দাম। এ অবস্থায় বিদেশী ঋণ এখন কতটা জরুরি? আইএমএফ’র ঋণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস বলেছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে ভবিষ্যতে যদি ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি বাড়ে, সেজন্য মূলত অর্থ মন্ত্রণালয় আলোচনা সাপেক্ষে সহায়তা চেয়েছে। এটি সহজ শর্তের ঋণ। বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধিকবার এ ধরনের ঋণ সহায়তা আইএমএফ’র কাছ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, কোভিডকালীন বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও আইএমএফ সবার কাছ থেকে বাজেট সহায়তা নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম মনে করছেন, রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি আর ডলার সঙ্কটের এ সময়ে বিকল্প নেই সরকারের হাতে।
সূত্র মতে, ভালোই ছিল অর্থনীতি। করোনাকালেও বহু দেশ যখন টিকে থাকার লড়াইয়ে তখন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ঈর্ষণীয়। এমনকি রফতানি, প্রবাসী আয় আর বিদেশি মুদ্রার মজুতও রেকর্ড গড়ছিল নিয়মিত বিরতিতে। কিন্তু হঠাৎই যেন ছন্দপতন!
২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি ছুঁয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। কিন্তু তার চেয়েও ২৩ বিলিয়ন বেশি চলে গেছে ১১ মাসের আমদানি বাবদ। ফলে বছরের হিসাব শেষ হওয়ার আগেই রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি ঘাড়ে নিয়ে এগোচ্ছে অর্থনীতি। তার ওপর ডলারের আকাশছোঁয়া দাম আর জ্বালানি আমদানিতে অতিরিক্ত ব্যয় ওলট-পালট করে দিচ্ছে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা। এমন অবস্থায় খানিকটা স্বস্তি পেতেই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দ্বারে বাংলাদেশ।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, আমাদের ইমপ্রুভ অনেক বেড়ে গেছে, রফতানি বাড়তি হলে ইমপোর্ট বাড়বে। আমাদের অর্থনীতির যে সামর্থ্য তাতে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর একেবারে দ্বিমত নেই। তাই আমি মনে করি যত দ্রুত ঋণ নেয়া যায় তত তাড়াতাড়ি ডলার সঙ্কট কেটে যাবে।
এই মুহূর্তে ঋণের আলোচনায় সবার আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। যাদের কাছ থেকে আগামী তিন বছরে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার সহজ ঋণ চেয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের কাছেও চাওয়া হয়েছে আরও পৌনে দুই বিলিয়ন। সমস্যা হচ্ছে, এই ঋণের বিপরীতে জ্বালানিতে ভর্তুকিতে কমানো, ডলারের দরে সীমা তুলে দেয়া, কর ব্যবস্থায় সংস্কারসহ বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিচ্ছে আইএমএফ। যা পূরণ করা জরুরি হলেও কতটা সম্ভব হবে সেই প্রশ্নও আছে। যদিও ওই সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণের সম্পর্ক বহু দিনের। কিন্তু বাড়তি আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে বর্তমান বাস্তবতা।
আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিসের সিঙ্গাপুরে স্বাধীন বিশ্লেষক ক্যামিলে চৌটার্ড বলেছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন কমে গেছে। সার্বভৌম বাহ্যিক ঝুঁকির সূচক নিচের দিকে রয়েছে। আর তাই ক্যামিলে চৌটার্ড বলেন, আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক রক্ষাকবচ তৈরি করতে চাচ্ছে বাংলাদেশ। আর এ কারণেই কঠিন শর্ত হলেও আইএমএফ’র দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
মুডিস’র মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের আগে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রত বর্ধমান ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিভিন্নভাবে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মুডিসের ক্যামিলে চৌটার্ড বলেন, চলতি হিসাব ঘাটতিতে বাজে অবস্থা তৈরি হয়ে যেতে পারে। কারণ, রেমিট্যান্স কমেছে। রফতানি চাহিদাও বেশি নয়। আর খাদ্য ও জ্বালানি মূল্যের গতিও ঊর্ধ্বমুখী। আর সাম্প্রতিক বন্যার কারণে পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ অবস্থার দিকে চলে গেছে।
অর্থ বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আগামী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এর পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ঋণ নেয়া হবে এক লাখ ২৬ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ঋণ নেওয়ার টার্গেট রয়েছে ৯৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাজেটে মোট অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের অংশ মধ্য মেয়াদে ধীরে ধীরে কমবে এবং বৈদেশিক অর্থায়নের হার বাড়বে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়ন মোট অর্থায়নের ৪৫ শতাংশে পৌঁছাবে। আগামী তিন বছরে বৈদেশিক উৎস থেকে অনুদানের পরিমাণ সামান্য প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে যাবে। অপর দিকে, একই সময়ে বাৎসরিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ক্রমেই বাড়তে থাকবে।
চলতি অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। আগামী ২০২৩-২০২৪ এবং ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে যা হবে যথাক্রমে ২০ হাজার ৪৬ কোটি টাকা এবং ২২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। তবে বাজেটে বিদেশি ঋণের প্রক্ষেপণ যাই ধরা হোক, সেই হারে কিন্তু কখনও ঋণ পাওয়া সম্ভব হয়নি। যেমন সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বিদেশি নিট ঋণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে তা সংশোধন করে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরা হয় ৭৭ হাজার ২০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, বিদেশি ঋণের জন্য এখন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এই দুই সংস্থা থেকে উল্লেখযোগ্য ঋণ পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। যেমনÑ আইএমএফের কাছ থেকে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট স্থিতিশীল রাখতে আগামী তিন অর্থবছরে ৪৫০ কোটি ডলার পাওয়া যেতে পারে। বিশ্বব্যাংকের কাছেও বাজেট সহায়তায় ঋণ চাওয়া হবে। অনেকটা স্বল্প সুদে এ ঋণ পেলে ঘাটতি বাজেট বাস্তবায়নে সুবিধা হবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিরাপদ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। সেটা নির্ভর করছে এসব ঋণ কতটা দ্রুত সময়ে পাওয়া যায় তার ওপর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন